dhibor-britanto-class-9
WB-Class-9

ধীবর বৃত্তান্ত

বাংলানবম শ্রেণি – ধীবর বৃত্তান্ত [dhibar-brittanto] (গদ্য)

লেখক পরিচিতি

প্রাচীন ভারতের অন্যতম একজন বিখ্যাত কবি কালিদাস। তিনি সংস্কৃত ভাষায় বহু কাব্য রচনা করেছিলেন। তার রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মেঘদূতম, রঘুবংশম, কুমারসম্ভবম, ঋতুসম্ভার, পুষ্পবাণ বিলাস ইত্যাদি। তিনি অভিজ্ঞানম শকুন্তলা, বিক্রমোবর্সী, মালবিকাগ্নিমিত্রম নামে তিনটি নাটক রচনা করেন। এছাড়া তিনি দুটি আখ্যান কাব্য যথা দ্বাদশ পুত্তলিকা ও নরোদয় রচনা করেছিলেন।

কিংবদন্তী অনুসারে জানা যায় তিনি প্রথম জীবনে ‘গণ্ডমূর্খ’ ছিলেন। বিদুষী রাজকন্যা বিদ্যাবতীর সাথে তার বিবাহ হয়। কালিদাসের মূর্খতার কথা জানতে পেরে বিদ্যাবতী তাকে প্রবল ভর্ত্সনা করেন। প্রচণ্ড দুঃখের ফলে তিনি জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে গেলে, দেবী সরস্বতী তাকে বর প্রদান করেন। দেবীর বরে তিনি বিদ্বান হন এবং সংস্কৃত ভাষায় বিভিন্ন কাব্য রচনা করেন। কবি কালিদাসের আবির্ভাবের সময় কাল নিয়ে মতভেদ আছে। তবে মনে করা হয় তিনি বিক্রমাদিত্যের সভার নবরত্নের অন্যতম ছিলেন। তাঁর লেখাতেও বিক্রমাদিত্যের রাজধানী উজ্জয়িনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া বানভট্ট রচিত হর্ষচরিতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।


ধীবর বৃত্তান্ত সম্পূর্ণ আলোচনা ↓


শকুন্তলার জন্মবৃতান্ত

ঋষি বিশ্বামিত্রের কঠিন তপস্যায় দেবতারা ভীত হয়ে পড়েন। তাই দেবরাজ ইন্দ্র ঋষির ধ্যন ভঙ্গ করার জন্য ইন্দ্রের রাজসভায় নৃত্য পরিবেশনকারী, নৃত্য পটিয়সী অপ্সরা মেনকাকে ঋষি বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভঙ্গ করতে পাঠান। মেনকার দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরে মেনকার নৃত্যকলায় ঋষির ধ্যনভঙ্গ হয় এবং  তাঁরা গান্ধর্ব মতে বিবাহ করেন। এরপর তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু কন্যার জন্মের পর অপ্সরা মেনকা পুনরায় স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করেন এবং কন্যাকে মালিনী নদীর তীরে রেখে যান।

প্রতিদিনের অভ্যাস মতো কণ্ব ঋষি মালিনী নদীতে স্নান করতে এসে শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনে শিশু কন্যাটিকে দেখতে পান। বনের পাখিরা শিশুটিকে রোদের তাপ রক্ষা করার জন্য তাকে আড়াল করে রেখেছিল। “শকুন্ত” কথাটির অর্থ পাখি। শিশুটি পাখিদের দ্বারা পরিবৃতা ছিল, তাই ঋষি কণ্ব তার নাম রাখেন শকুন্তলা। কণ্ব ঋষি শকুন্তলাকে তার আশ্রমে নিয়ে যান। ঐ আশ্রমে শিশুটি বনের পশু-পাখিদের সাথে বড় হতে থাকে। শকুন্তলার দুই প্রিয় সখী ছিল প্রিয়ংবদা ও অনসূয়া।



ধীবর বৃত্তান্ত নাট্যাংশের পূর্বকথা

শকুন্তলা মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে পশুপাখি এবং তার দুই সখীর সাথে বড় হতে থাকে। এদিকে, তৎকালীন  হস্তিনাপুরের পুরু বংশীয় রাজা ছিলেন দুষ্মন্ত। একদিন তিনি মৃগয়ায় (শিকারে) বেরিয়েছিলেন, পথে তিনি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন। খাদ্য ও পানীয়ের সন্ধানে তিনি উপস্থিত হন মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে। সেই সময়ে মহর্ষি আশ্রমে অনুপস্থিত ছিলেন।

Separation-and-Reunion-of-Dushyanta-and-Shankuntala-in-Seven-Acts
রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা

রাজা শকুন্তলাকে দেখেন ও তার পরিচয় সম্বন্ধে অবগত হন। এরপর রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে গান্ধর্ব মতে বিবাহ করেন। কিছুদিন আশ্রমে বাস করার পরে তিনি তাঁর রাজধানীতে ফিরে যান, তিনি যাবার সময় শকুন্তলাকে কথা দিয়ে যান যে অতি সত্বর দূত পাঠিয়ে শকুন্তলাকে তাঁর রাজ্যে নিয়ে যাবেন।

Shakunthala-lost-in-thoughts-by-Raja-Ravi-Varma
চিন্তান্বিত শকুন্তলা (সৌজন্যে – RaviVarma.org)

দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হবার পরেও শকুন্তলাকে নিতে কোনো দূত আসে না। একদিন শকুন্তলা স্বামী চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন, এমন সময় ঋষি দুর্বাসা আশ্রমে আসেন এবং বারংবার ডাকা সত্বেও কোনো সাড়া না পেয়ে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন। ক্রোধান্বিত ঋষি দুর্বাসা এর ফল স্বরূপ শকুন্তলাকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, শকুন্তলা যার  চিন্তায় মগ্ন থাকার ফলে ঋষির উপস্থিতি বুঝতে পারেননি, সেই ব্যক্তি শকুন্তলাকে বিস্মৃত হবেন। এই ভয়ংকর অভিশাপের পরিণতি অনুমান করে, শকুন্তলার সখীগণ  ঋষি দুর্বাসার সেবাযত্ন করেন এবং শকুন্তলাকে এই ভয়ানক অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য অনুরোধ করেন। অবশেষে শকুন্তলার প্রিয় সখী প্রিয়ংবদার অনুরোধে ঋষি বলেন যে যদি শকুন্তলা,  দুষ্মন্তের কোন স্মৃতি চিহ্ন দেখাতে পারেন তবেই দুষ্মন্তের পূর্বস্মৃতি মনে পড়বে অর্থাৎ তাঁর অভিশাপের প্রভাব দূর হবে।

রাজধানীতে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে রাজা দুস্মন্ত শকুন্তলার হাতে একটি আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন। এটিই ছিল তাঁর নিদর্শন বা স্মারক চিহ্ন।

মহর্ষি কণ্ব তীর্থ থেকে ফিরে এসে শকুন্তলাকে পতিগৃহে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। পতিগৃহে যাত্রাপথে শচীতীর্থে স্নানের পর অঞ্জলি দেওয়ার সময় শকুন্তলার হাত থেকে পতি দুষ্মন্তের দেওয়া একমাত্র স্মারক চিহ্ন আংটিটি জলে পড়ে যায়। এরপরে, আংটিটি একটি মাছ গিলে ফেলে

এদিকে শকুন্তলা রাজসভায় পৌঁছালে ঋষি দুর্বাসার শাপ অনুসারে রাজা দুষ্মন্ত পূর্ব-স্মৃতি বিস্মৃত হন। শকুন্তলাকে দেখেও রাজা পূর্বের কোন কথা মনে করতে পারেন না। আংটি হারিয়ে যাবার কারণে শকুন্তলাও রাজাকে কোন নিদর্শন দেখাতে পারেন না। রাজসভায় প্রবল অপমানিতা হয়ে শকুন্তলা ফিরে আসেন।

সেই আংটি যা মাছ ভক্ষণ করেছিল,সেই মাছটি পরে একটি ধীবর অর্থাৎ জেলের জালে ধরা পড়ে। পরে সেই মাছটি কাটতে গিয়ে ধীবর  আংটিটি পান। সেই আংটি বাজারে  বিক্রির জন্য নিয়ে গেলে, রাজ শ্যালক ও দুই রক্ষী তাকে আংটি চুরির অপরাধে  গ্রেপ্তার করে। এখান থেকেই নবম শ্রেণির পাঠ্য ‘ধীবর বৃতান্ত’ নাট্যাংশ শুরু হচ্ছে।

নাট্যাংশে চারটি চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম জন ধীবর, যাকে ‘পুরুষ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় জন রাজ শ্যালক, তৃতীয়জন রক্ষী – সূচক ও চতুর্থ জন রক্ষী জানুক।

ধীবর বৃত্তান্ত নাট্যাংশের পরবর্তী ঘটনাঃ

রাজা যখন শকুন্তলাকে চিনতে অস্বীকার করলেন, তখন শকুন্তলার মা মেনকা শকুন্তলাকে স্বর্গের অমরাবতীতে নিয়ে যান।

Menaka-and-Sakunthala-by-Raja-Ravi-Varma
শকুন্তলা ও মেনকা (সৌজন্যে -RaviVarma.com)

আংটি দেখে দুষ্মন্তের শকুন্তলার স্মৃতি  মনে পড়ার পর, দেশ জুড়ে শকুন্তলার খোঁজ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ইন্দ্রের আমন্ত্রণে রাজা দুষ্মন্ত স্বর্গে যান। স্বর্গ থেকে ফেরার পথে কশ্যপ ঋষির আশ্রমে একটি সাহসী বালককে সিংহের সাথে খেলতে দেখেন। সেই বালকই ছিল দুষ্মন্তের পুত্র ভরত। পুত্র সহ শকুন্তলাকে নিয়ে রাজা দুষ্মন্ত রাজ্যে ফিরে আসেন।  দুষ্মন্তের পুত্র ভরতের নামেই  আমদের দেশের নাম ভারতবর্ষ হয়।


[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌত বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবন বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]

ধীবর বৃত্তান্ত নাট্যাংশের সারসংক্ষেপ

বিশিষ্ট ধ্রুপদী সংস্কৃত কবি কালিদাসের নাটক ‘অভিজ্ঞানম শকুন্তলা’ নামক সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থের একটা ছোট অংশ নাটকাকারে নবম শ্রেণির পাঠ্যাংশের অন্তর্গত করা হয়েছে। এটির তর্জমা করেছেন সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী। নাট্যাংশটি ধীবর মাছের পেট থেকে আংটি পেয়ে বাজারে বিক্রি করতে যাওয়ার সময় রাজার শ্যালক দুই রক্ষী সহ তাকে গ্রেপ্তার করে, হাত বেঁধে নিয়ে যাওয়ার সময় থেকে শুরু হয়।

রাজার শ্যালক রাজপ্রাসাদের বাইরে ধীবরকে দাঁড় করিয়ে রাজাকে আংটি দেখাতে নিয়ে যায় এবং ফিরে এসে রাজার প্রতিক্রিয়া জানায়। রাজার শ্যালক বলেন যে ধীবরের সব কথাই সত্য এবং ঐ আংটিটি দেখে রাজার কোন প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে গেছে। রাজা খুশী হয়ে ধীবরকে পারিতোষক প্রদান করেছেন। পরিতোষকের পরিমাণ দেখে দুই রক্ষী ঈর্ষান্বিত হলে ধীবর তাঁর প্রাপ্ত অর্থের অর্ধভাগ তাদের প্রদান করে এবং রাজার শ্যালকের বন্ধুত্ব লাভ করে।

বিশেষ আলোচনা

‘ধীবর – বৃত্তান্ত’ নাট্যদৃশ্য অবলম্বনে ধীবর চরিত্রের আলোচনা।

‘ধীবর – বৃত্তান্ত’ নাট্যদৃশ্যের প্রধান চরিত্র হল ধীবর। এই নাট্যাংশটি তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। নাট্যাংশটি থেকে আমরা ধীবর চরিত্রের বেশ কিছু দিক লক্ষ্য করতে পারি।

আত্মমর্যাদাবোধ – নাট্যাংশে যখন রাজ-শ্যালক তাকে তাঁর জীবিকা সম্পর্কে ব্যাঙ্গ করে তখন ধীবর সেই কথার তীব্র প্রতিবাদ করে। মনে রাখতে হবে ধীবর তখন বন্দী, বন্দী হওয়া সত্ত্বেও সে তার বক্তব্য রাখতে পিছপা হয় না। সে বলে “যে বৃত্তি নিয়ে মানুষ জন্মেছে, সেই বৃত্তি নিন্দনীয় হলেও তা পরিত্যাগ করা উচিৎ নয়।” এই বক্তব্যর মধ্যে দিয়ে ধীবরের চরিত্রের দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে।

সততা – ধীবরের কথোপকথনের মধ্যে সততার ছাপ স্পষ্ট। ধীবর প্রথম থেকেই তার পরিচয় সঠিক ভাবে দিয়েছে, সে কি করে, কোথায় থাকে, আংটিটি কিভাবে পেয়েছে ইত্যদি সে কোন ভাবেই গোপন করেনি। এমনকি আংটি প্রাপ্তির ঘটনা বলার পর, ধীবর বলে ‘এখন মারতে হয় মারুন, ছেড়ে দিতে হয় ছেড়ে দিন। কিভাবে এই আংটি আমার কাছে এসেছে তা বললাম।’

স্পষ্টভাষী – ধীবর স্পষ্টভাষী। তাকে গ্রেফতার করার পর দুই রক্ষী যখন তাকে কিভাবে মারা হবে তা আলোচনা করছে, তখন ধীবর বলে ওঠে – ‘মহাশয়, বিনা দোষে আমাকে মারবেন না’। আবার যখন রাজ – শ্যালকের কথায় ধীবরকে ছেড়ে দেওয়া হয় তখন স্পষ্টভাবে সে বলে “প্রভু, আজ আমার সংসার চলবে কিভাবে?”।

এইভাবে ‘ধীবর – বৃত্তান্ত’ নাট্যাংশে ধীবরের চরিত্রের বিভিন্ন দিকগুলি ফুটে উঠছে।

পরবর্তী পর্ব → ইলিয়াস গল্পের আলোচনা

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX_Beng_Dhibar-britanto