ইতিহাস – দশম শ্রেণি – বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলনঃ বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (পর্ব – ২)
গত পর্বে আমরা বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে জানবো।
ছাত্র সমাজের ভূমিকা স্বাধীনতা আন্দোলনে অনস্বিকার্য। উনবিংশ শতকের গোড়ায় ডিরোজিওর সময় থেকেই ছাত্রসমাজ রাজনীতি, সমাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে। বিশ শতকের শুরু থেকে এই সচেতনতা ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন কার্যকলাপে পরিণত হয়।
বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের চরিত্র নিয়ে আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ও ছাত্রসমাজ
বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পর থেকেই বাংলাসহ একাধিক স্থানে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতার বিভিন্ন কলেজে ব্রিটিশ দ্রব্য বয়কট আন্দোলন শুরু হয়। গোলদিঘির প্রাঙ্গণে কলকাতার প্রায় সব কলেজের ছাত্ররা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে 31শে জুলাই জড়ো হয়। আন্দোলনের মাত্রা বাড়লে ব্রিটিশ দ্রব্যের পাশাপাশি ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থা বয়কটের দাক দেওয়া হয়। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে ছাত্ররা পরীক্ষা দিতেও অস্বীকার করে।
এই আন্দোলনের বিধ্বংসী রূপ ব্রিটিশদের চিন্তায় ফেলে। তাই এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করতে তৎকালীন শিক্ষাসচিব আর. ডব্লিউ. কার্লাইল একটি সার্কুলার জারি করে, যা কার্লাইল সার্কুলার নামে পরিচিত।
এই সার্কুলারে বলা হয়েছিল,
• এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলে সরকারি স্কুল কলেজ থেকে সেই সকল ছাত্রছাত্রীদের বহিস্কার করা হবে।
• আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রদের বৃত্তি (যারা বৃত্তি পেত) বন্ধ করে দেওয়া হবে।
• এমনকি স্কুলগুলির অনুমোদনও কেড়ে নেওয়া হবে।
[পূর্ববঙ্গেও এরকমই একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছিল, যা লিয়ন্স সার্কুলার নামে পরিচিত।]
এই সার্কুলারের বিরোধিতা করে শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু 1905 সালে ‘অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সার্কুলারের প্রতিবাদে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির ডাক দেন বিপিনচন্দ্র পাল। সুবোধচন্দ্র মল্লিকের আর্থিক সহায়তায় 1906 সালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ। যার ফল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও ছাত্রসমাজ
বঙ্গভঙ্গ রোধের পর ছাত্র আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লেও গান্ধীজীর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনের হাত ধরে এই ছাত্র সমাজ পুনরায় জাগরিত হয়। 1920 সালে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হলেও আন্দোলনের প্রথম দিকে ছাত্রসমাজ সেইভাবে অংশ নেয়নি, কিন্তু 1921 এর গোড়া থেকেই ছাত্রদের ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা বয়কটের প্রবণতা বাড়তে শুরু করে।
সিটি কলেজ থেকে বঙ্গবাসী, সাউথ সাবারবান থেকে স্কটিশচার্চ, প্রেসিডেন্সী ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (কিছু স্নাতকোত্তর বিভাগ বাদে) সহ প্রায় সব কলেজের ছাত্ররা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
তবে ছাত্রদের রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার এই ঘটনাকে তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তীব্র নিন্দা করেছিলেন।
আইন অমান্য আন্দোলন ও ছাত্রসমাজ
নুন একটি অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য, যা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই গ্রহণ করেন। তাই পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের লক্ষ্যে গান্ধীজী আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করেন লবণ আইন ভঙ্গ করার মাধ্যমে। আর তার এই আন্দোলনে গোটা ভারতের ছাত্রসমাজ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। বিভিন্ন সমসাময়িক সংবাদপত্র যার প্রামাণ্য বহন করছে।
বাংলায় আন্দোলনের মাত্রা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। বেথুন, প্রেসিডেন্সী, স্কটিশের বহু ছাত্রছাত্রী সত্যাগ্রহী আন্দোলন শুরু করে, পুলিশের তাদের ওপর নির্মমভাবে লাঠিচার্জ করে। যার জেরে ছাত্রসমাজের জনরোষ আরো বেড়ে যায়। লবণ আইন ভঙ্গ করে গোটা দেশের ছাত্র সমাজ গান্ধীজীর আন্দোলনকে আলাদা মাত্রা এনে দেয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা এমন জায়গায় পৌছয়, যে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে বৈঠক করতে। 1931 সালে গান্ধি-আরউইন চুক্তি আন্দোলনে বিরতি আনে। এই আন্দোলনের জেরে লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক সংগঠিত হয়।
সশস্ত্র আন্দোলন ও ছাত্রসমাজ
1902 সালে অনুশীলন সমিতি গড়ে ওঠার মাধ্যমে বাংলার ছাত্র তথা যুবসমাজ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হতে শুরু করে। সেই সময় ভারতমাতার যে সকল বীর সন্তান নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী। 1908 সালে কিংসফোর্ডকে হত্যা করার প্রচেষ্টা করে পুলিশের হাতে ধরা পরেন ক্ষুদিরাম বসু, তাঁর ফাঁসী হয় এবং প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন।
ভারত মাতার আরেক প্রবাদপ্রতিম সন্তান সূর্য সেন। যিনি অবিভক্ত বাংলায় ‘মাস্টারদা’ নামে পরিচিত। তাঁর সশস্ত্র বিপ্লব মূলত চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে বিস্তৃতি লাভ করেছিল। তিনি ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর জীবনে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ও চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ অন্যতম সেরা কীর্তি। এই চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পড়েই তিনি গ্রেপ্তার হন ও বিচারে 1934 সালের 12ই জানুয়ারি তাঁর ফাঁসী হয়।
কিন্তু তাঁর আন্দোলন থেমে যায়নি, তাঁর অনুপ্রেরণায় বহু ছাত্রছাত্রীসহ তরুণসমাজের (প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, আনন্দ গুপ্ত, অনন্ত সিংহ প্রমুখ) এক বিরাট অংশ অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এছাড়া যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বুড়িবালামের যুদ্ধ, সুশীল সেনের বন্দেমাতরম স্লোগান, বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা, আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা প্রভৃতিতে বাংলার যুবসমাজ তথা ছাত্রসমাজের ব্রিটিশ বিরোধিতা আজও স্মরণীয়।
এই সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকার গুপ্ত দল মুক্তি সংঘ। সেই দলেই যুক্ত হন মিডফোর্ড মেডিকেল স্কুলের ছাত্র বিনয়কৃষ্ণ বসু। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল লোম্যান ও পুলিশ সুপার হাডসনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর জীবনের বিখ্যাত কীর্তি ‘অলিন্দ যুদ্ধ’। 1930 সালের 8ই ডিসেম্বর বিনয় বসু এবং তাঁর দুজন সঙ্গী দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্ত রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করে সিম্পসনকে হত্যা করেন। এই সময় পুলিশ তাদের ধরে ফেললে শুরু প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
বিনয়, বাদল, দীনেশ তিনজনেই আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তৎক্ষণাৎ বাদল মারা যান, বিনয় হাসপাতালেই মৃত্যুবরণ করেন এবং দীনেশের ফাঁসী হয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও ছাত্রসমাজ
সশস্ত্র বিপ্লব, গণরোষ, গোটা দেশের সর্বত্র আন্দোলন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটিশদের অবস্থা ঘরে বাইরে সর্বত্রই শোচনীয় করে তোলে। 1942 এর 9ই আগস্ট গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক ব্রিটিশ শাসনে শেষ পেরেকটিও পুঁতে দেয়। গোটা ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পাবার বাসনায় উত্তাল হয়ে ওঠে। আর এই আন্দোলনের মূল কাণ্ডারি ছিল ভারত বর্ষের ছাত্রসমাজ।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
আন্দোলন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই কংগ্রেসের তাবড় তাবড় নেতারা গ্রেপ্তার হন। আর এইরুপ নেতৃহীন অবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা নেমে আসে গোটা দেশে। সরকারি স্কুল, কলেজ, অফিস আক্রমণ, স্থানে স্থানে আন্দোলন, বিশাল মিছিল, সরকার বিরোধী নানাবিধ কর্মযজ্ঞে গোটা ভারত মেতে ওঠে। এই আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অনস্বিকার্য। 13ই আগস্ট কলকাতায় পুলিশের গুলিতে পাঁচজন প্রতিবাদী ছাত্র শহীদ হলে সারা বাংলায় 15ই আগস্ট ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।
এরপরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঘটনার প্রতিবাদে (1945 শে আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার, রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে) বিক্ষিপ্ত ছাত্র আন্দোলন সমগ্র দেশে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। তাই বিশ শতক জুড়ে ছাত্র অভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ- চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ
লেখিকা পরিচিতি
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X_hist_7b