শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: বাংলা। দাঁড়াও (পদ্য)
দাঁড়াও কবিতার আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে ↓
কবি পরিচিতি
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের এক অন্যতম পরিচিত নাম হল শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কাজের গণ্ডি কবিতার বাইরে প্রাসারিত হলেও, তিনি মূলত তাঁর রচিত কবিতাগুলির জন্যই বাঙালি জাতির হৃদয়ে চিরকালীন স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর রচিত কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হল – ধর্মে আছো জিরাফেও আছো, সোনার মাছি খুন করেছি, এই যে আমি পাথরে, ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সম্ভবত তাঁর সেরা সৃষ্টি হল ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’; এই কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান।
দাঁড়াও কবিতার উৎস
বর্তমান আলোচ্য ‘দাঁড়াও’ কবিতাটি ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
দাঁড়াও কবিতার সারাংশ
পৃথিবীর জীবকুলের মধ্যে উন্নততর প্রাণী হল মানুষ। কোটি কোটি বছরের প্রচেষ্টায় মানুষ তার আজকের রূপ পেয়েছে, গড়ে তুলেছে তার সভ্যতা।
কিন্তু মানুষ আজ কি অবস্থায় আছে?
সে আজ অসহায়, দুঃখী, একলা। অবাক করা ব্যাপার হল মানুষের এই যন্ত্রণার কারণ কিন্তু মানুষ নিজেই। স্বার্থপর, লোভ – সর্বস্ব মানুষ তার নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অপর মানুষকে বিপদের সামনে নিয়ে আসছে। কবি বলেছেন, আমাদের প্রকৃত মনুষ্য ধর্ম পালন করে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
প্রকৃত মানুষ কে?
সেই আদিম সময় থেকে মানুষ একসাথে বাস করছে। নিজ সুখ, নিজ দুঃখ, নিজ আনন্দ একসাথে ভাগ করে নিচ্ছে। নিজ শ্রমের ফসল অন্যকে তুলে দিচ্ছে। একসাথে দল বেঁধে সব বিপদকে জয় করছে। সাহচর্য, সহমর্মিতা – এগুলিই মনুষ্য ধর্মের পরিচয়। কিন্তু আজ সেই মানুষ বড় অচেনা। কারণ বিশ্বজুড়ে মানুষই, মানুষের জন্য ফাঁদ পাতছে, এক মানুষই অন্য মানুষের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই কবির আজ সেই মনুষ্য ধর্মের কথা দিন – রাত মনে পড়ছে। যে মানুষ একলা – দীন – দুঃখী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে।
মানুষ কিভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াবে?
একজন মানুষ অপর মানুষের দুঃখে পাশে এসে দাঁড়াবে, স্বার্থহীন ভাবে, সকল বাঁধা – বিপদকে সরিয়ে দিয়ে কেবল মাত্র ভালোবেসে পাশে দাঁড়াবে। কারণ মানব জাতি আজ বড় দুঃখে আছে, আমাদের বৃহত্তর সমাজের কথা ভেবে – আগলহীন হয়ে সমগ্র জাতির পাশে দাঁড়াতে হবে।
দাঁড়াও কবিতার সরলার্থ
মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।
মানব জাতি আজ বড় বিপদের সম্মুখীন। আমরা জানি, কান্না হল দুঃখের বহিঃপ্রকাশ। ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’ এই কথাটির মধ্য দিয়ে কবি সমগ্র জাতির দুঃখের কথা তুলে ধরেছেন।
কিন্তু মানুষ কেন দুঃখে আছে?
এই সমগ্র পৃথিবীতে যত মানুষ আছে; আমরা সকলেই এক। সব মানুষের ধমনীতে লাল রক্ত বইছে। সব মানুষই দুঃখ পেলে পেলে কাঁদে, আনন্দে হেসে ওঠে।
কিন্তু আমরা আমাদের মানুষ পরিচয় নিয়ে কি আদৌ গর্বিত?
সম্ভবত না। আমরা এই মানুষের উপরে কোন সময় দেশের, কোন সময় ধর্মের, কোন সময় জাতের – বর্ণের তকমা এঁটে দিই। ঐ তকমা অনুযায়ী মানুষের বিচার করি। আমরা নিজেদের মনুষ্য ধর্মের কথা না ভেবে নিজেকে ক্ষুদ্র ‘তকমার’ গণ্ডিতে আবদ্ধ করে দিই। অপরের দুঃখ দেখলে আমরা তার কষ্টের কথা আর উপলব্ধি করতে পারি না।
অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের দুঃখের জন্য কিন্তু মানুষই দায়ী।
যেমন দুই দেশের মধ্যে যখন যুদ্ধ হয়। এক দল মানুষ – অপর দলকে হত্যা করে। দুটি দল ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাগরিক হলেও আদতে তারা মানুষ। কিন্তু সেই মানুষের পরিচয় তারা ভুলে যায়, তারা নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে ফাঁদ পাতে।
কবি বলছেন, আমাদের প্রকৃত মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। পাখি ধরার ফাঁদ সরিয়ে, পাখি যেমন উড়ে যায়; ঠিক তেমন ভাবে পাতা ফাঁদকে উপেক্ষা করে আমাদের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মতো মনে পড়ছে
সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।
সকাল – সন্ধ্যা – রাত এই নিয়ে একটা সমগ্র দিন তৈরি হয়। কবি মানুষের দুঃখে বড় অসহায় বোধ করেছেন। তিনি সারাটা সময় ধরে প্রকৃত মনুষ্য স্বত্বাকে মনে করছেন। কারণ মনুষ্য জাতি আজ বড় অসহায় – একলা। মনুষ্য জাতির আজ প্রকৃত মানুষের সাহচর্যের প্রয়োজন।
আরো পড়ুন → গাছের কথা | ত্রৈরাশিক | পদার্থের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।
আমরা কিভাবে মনুষ্য ধর্ম পালন করবো তার হদিশ কবি এই কবিতার তৃতীয় স্তবকে দিয়েছেন। নদীতে যখন জলস্ফীতিহয়, তখন জলের তোড়ে সব ভেসে যায়। ঠিক তেমন ভাবেই আমাদের সব ক্ষুদ্র তকমার আগল ভেঙে দিয়ে, সব স্বার্থ সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সব মানুষকে ভালোবেসে – সব হিসাব কে সরিয়ে দিয়ে, শুধুমাত্র আমাদের মানুষ পরিচয়কে সামনে নিয়ে বৃহত্তর সমাজের অংশ হতে হবে। কারণ মনুষ্য জাতি আজ বড় অসহায় – একলা। আর আমাদের তার পাশে দাঁড়াতে হবে।
দাঁড়াও কবিতার মূল বক্তব্য
আফ্রিকার একটি প্রাচীন ভাষার নাম বান্টু (Bantu) ভাষা; সেই ভাষার একটি প্রবাদ হল ‘Ubantu’। ইংরেজিতে এই Ubuntu শব্দের মানে ‘I am because you are.’ এর বাংলা তর্জমা করলে দাড়ায় – আমার অস্তিত্ব আছে কারণ তোমরা আছ।
মানুষ একা বাঁচতে পারে না। একসাথে দল বেঁধে সময়ের এক একটি পর্ব পার করে সভ্যতার এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে মনুষ্য সমাজ। কিন্তু আজ মানুষ পরিবর্তিত হয়েছে। নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য অপর মানুষের জন্য সে ফাঁদ পাতছে – তাদের সর্বনাশ করছে। মানুষ নিজের দুর্দশা নিজেই ডেকে আনছে। এর থেকে মুক্তির রাস্তাও কবি আমাদের বলেছেন। আমাদের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, মনুষ্য ধর্ম পালন করে স্বার্থকে দূরে সরিয়ে রেখে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা