নিস্তব্ধ দুপুরবেলায় বৃষ্টিঝরা গাছটার নীচে বসে থাকতে থাকতে ঝুমুরের মনটা ক্ষণে ক্ষণে উদাস হয়ে যাচ্ছিল।
বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল পাঁচ বছর আগে যেদিন প্রথম নূপুরদিদির সঙ্গে এ বাড়িতে এসেছিল, সেদিনটার কথা। সেই শীতের দুপুরে এই গাছটাকে দেখিয়ে নূপুরদিদি বলেছিল, এই গাছটাকে চিনিস?
এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Samania saman – বাংলায় ‘বৃষ্টিঝরা’। সঙ্গে সঙ্গে শীতের দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ধারার মতো ঝরে পড়েছিল বৃষ্টি ঝরার ঝিরিঝিরি পাতা। তারপর বৃষ্টিঝরার পত্রস্নাত কত নিস্তব্ধ দুপুর কেটেছে নূপুরদিদির সঙ্গে গল্প করে।
নূপুরদিদির মুখে শুনেছে চিপকো আন্দোলনের কথা, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের কথা।
পরিবেশের জন্য মানুষের আত্মত্যাগ। হিন্দি শব্দ ‘চিপকো’ বা কন্নড় শব্দ ‘আপিক্কো’র আভিধানিক অর্থ আলিঙ্গন করা। এই আন্দোলন ব্যাপক রূপ নিয়েছিল 1972-73 সালে। কিন্তু আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল সেই 1927 সালে; বৃটিশ আমলে বৃটিশরা প্রণয়ন করল অরণ্য আইন; নিষিদ্ধ হয়ে গেল আদিবাসী মানুষের বনের জিনিস ব্যবহার। এমনকি গরীব মানুষের অরণ্যে প্রবেশও নিষিদ্ধ হল। ক্ষোভ ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হতে থাকল। ফলতঃ 1950-এ তিলারিতে ঘটল জনসমাবেশ। সতেরোজন শহীদ হলেন। মহাত্মা গান্ধীর শিষ্যা সরলা বেনের নেতৃত্বে অরণ্য আইনের প্রতিবাদে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন শুরু হল।
ইতিমধ্যে বৃটিশ রাজের অবসান ঘটেছে।
কিন্তু নতুন সমস্যা সৃষ্টি করল একদল অর্থলোলুপ ঠিকাদার আর শিল্পপতিরা। এলাহাবাদের একটি খেলনা প্রস্তুতকারক সংস্থার ঠিকাদাররা নির্বিচারে ঐ অঞ্চলের গাছ কাটতে শুরু করল। সাধারণ মানুষ বাধা দিতে গেলেন। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হল না।
তাহলে কি এই নৃশংস বর্বরদের হাত থেকে গাছেদের বাঁচাবার আর কোন উপায় নেই?
উপায় কিন্তু বার করেছিলেন সেখানকার আদিবাসী, তথাকথিত অনুন্নত মানুষেরাই। গ্রামবাসীরা গাছগুলিকে আলিঙ্গন করে রাখে যাতে ঠিকাদাররা গাছ কাটতে না পারে।
1978 সালে আন্দোলন দমনের নামে শুরু হল পুলিশি বর্বরতা। নির্বিচারে গুলি চলল আদিবাসী মেয়েদের উপর। কিন্তু বন্দুকের গুলিও তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। দাবানলের মতো আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল গোপেশ্বর থেকে টেহরী, উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।
এই চিপকো আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুন্দরলাল বহুগুণা, চন্ডীপ্রসাদ ভট্ট প্রমুখ। 1983 সালে কর্ণাটকের সিরাসী অঞ্চলের সলকসী বনাঞ্চলে চিপকো আন্দোলনের আদলে শুরু হয় আপিক্কো আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছিল জনগণেরই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন, “উত্তরপ্রদেশের হিমালয় পর্বতমালা থেকে আগামী পনেরো বছর যেন কোন বৃক্ষচ্ছেদন না করা হয়”। গাছকাটা বন্ধের জন্য বিশেষ আইন জারি হয়েছিল।
অনেকদিন হল নূপুরদিদিরা এখান থেকে চলে গেছে।
ঝুমুর কিন্তু ভুলতে পারেনি এই বৃষ্টিঝরা গাছটাকে। মরচে ধরা গেটটা টপকে, আগাছার জঙ্গল মাড়িয়ে দুপুর হলেই চলে আসে এখানে। ‘রূপকথা শোনা নিভৃত সন্ধ্যাবেলা’র মতো নূপুরদিদির মুখে গল্প শোনা দুপুর গুলোও জীবন থেকে চলে গেছে। কিন্তু আজও রয়ে গেছে সেই বৃষ্টিঝরা, নিস্তব্ধ দুপুর, দূর থেকে ভেসে আসা ঘুঘুর ডাক, আর মিষ্টি মধুর স্মৃতি।
একদিন নূপুরদির মুখে শুনেছিল নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের কথা।
নর্মদা বললেই মনে পড়ে যায় মধ্যপ্রদেশের অমরকন্টক থেকে শুরু হয়ে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এক স্রোতস্বিনীর কথা যার দু’ধারে যেমন উঠেছে বহু সমৃদ্ধশালী নগর, আবার স্থানে স্থানে দুর্ভেদ্য অরণ্যে বাস আদিবাসী ‘ভিল’ ‘গণ্ড’দের। এই ভিলদের কথাতেই মনে পড়ে বহু রাজপুত গাথা।
এই নর্মদার ওপরও শুরু হল মানুষের অত্যাচার।
প্রায় 2700 মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও 50 লক্ষ হেক্টর জমিতে জল সিঞ্চন করার উদ্দেশ্যে 135টি মাঝারি ও 3000টি ছোট বাঁধ তৈরীর পরিকল্পনা নেওয়া হল। যার মধ্যে প্রধান সর্দার সরোবর ও নর্মদা সাগর। কিন্তু পরিবেশবিদরা দেখালেন এতে আনুমানিক খরচ 25,000 কোটি টাকা। প্রতি বছর এই খরচ বাড়বে।
কিন্তু তার ফলশ্রুতি কি?
এতে 3.5 লাখ হেক্টর জঙ্গল চলে যাবে জলের তলায়। 56 হাজার হেক্টর উর্বর জমি নষ্ট হয়ে যাবে, 10 লক্ষেরও বেশী লোক হবে বাস্তুহীন। শুরু হল নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন। পুরোধা বাবা আমতে ও মেধা পাটেকর। 1987 সাল থেকে শুরু হয়েছে তাদের আন্দোলন।
কিন্তু ঝুমুরের মন বলে, যবেই আন্দোলনের মীমাংসা হোক, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন পরিবেশ বান্ধব মানুষেরই জয় হয়, যেমন হয়েছিল চিপকো, আপিক্কো, কেরালার সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলনে – ভাবতে ভাবতে উদাস হয়ে যায় ঝুমুর। কেরালার উত্তরে গভীর গহন অরণ্য। নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ, তাই নাম সাইলেন্ট ভ্যালি। কথিত আছে পাশা খেলায় রাজ্যহারা পাণ্ডবরা এই বনেই আশ্রয় নিয়েছিল। 1973 সালে এখানে কুন্তিপুরা নদীর ওপর একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরী করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরিবেশবিদদের প্রচেষ্টায় 1980 সালে এই পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়।
ঝুমুরের চিন্তার জাল হঠাৎ ছিঁড়ে গেল মরচে ধরা গেটটা খোলার শব্দে।
এ বাড়িতে দুবছর হল কেউ গেট খুলে ঢোকেনি। তাড়াতাড়ি দৌড়ে দেখতে গেল ঝুমুর। কয়েকজন কাঠুরে গোছের লোক, হাতে শাবল, কাস্তে, কুডুল। একজনকে চিনতে পারল, ঝুমুর – গগনদা। ওদের বাগান পরিষ্কার করে।
ঝুমুরকে দেখেই গগনদা বলে উঠল, “দিদিমণি, নতুন লোক আসছে এ বাড়ীতে, আমাদের বলেছে সব গাছপালা কেটে ফেলতে”।
সব গাছপালা! মানে আগাছা তো?
আজ্ঞে না, বড় ছোট সব গাছই। বড় গাছ সব চড়া দামে বিক্রি হবে।
ঝুমুরের মাথার মধ্যেটা ঝিমঝিম করছে। এত সুন্দর বাগনটা দুদিনের মধ্যে মরুভূমি হয়ে যাবে। মেহগনি গাছটা থেকে কাঠবেড়ালীটা ঝুমুরের পায়ের কাছে লাফিয়ে পড়ল। দূর থেকে শোনা গেল চিলের কান্না, করুণ সুরে ডেকে উঠল বৌ কথা কও। বৃষ্টিঝরা গাছটার জন্য আজ ঝুমুরের চোখ দিয়ে নেমে এল বারি ধারা। হায় বৃষ্টিঝরা! হায় সোনালী দুপুর! যদি পারত চিপকো আন্দোলনের মত করে বৃষ্টি ঝরা গাছটাকে বাঁচাতে!
দুপুর গাড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। বৃষ্টিঝরাকে শেষ বারের মতো বিদায় জানিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসছিল ঝুমুর। এমন সময় শুনল – “আরে, ঝুমুর যে” – অনিমেষকাকুর গলা।
-তুমি এখানে কি করছ, কাকু?
–আমিই তো এই বাড়িটা কিনেছি, তাই আজ মিতা লাগিয়েছি গাছপালা কেটে বাড়িটা সাফ করার জন্য। একটা ক্ষীন আশার আলো জাগল ঝুমুরের মনে। – আচ্ছা বড় গাছগুলোকেও কেটে ফেলতে বলেছ? অন্তত বৃষ্টিঝরা গাছটাকেও কি…..
– ওসব বৃষ্টিঝরা কি রোদঝরা, ওসব আমি বুঝি না। ভাল দাম পাচ্ছি। ওসব জঙ্গল একেবারে বিদায়। আমি কি আমাজনের জঙ্গলে থাকতে এসেছি নাকি?
ঝুমুর আর কথা বাড়াল না।
অবরুদ্ধ কান্নায় গলাটা ধরে আসছিল। বাড়ির পথে চলতে শুরু করল ঝুমুর। এমন সময় আবার অনিমেষকাকুর ডাক – তুমি বিজ্ঞানের ছাত্রী না, শোন, আজকে লাইব্রেরীতে আমায় একটা সেমিনারে বক্তব্য রাখতে হবে, শুনতে যেও, Interest পাবে।
আরো পড়ুন
বিষয়টা কি? নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে ঝুমুর।
আমি যে বিষয়টা নিয়ে বক্তব্য রাখব সেটা হল Trees : Our friends.
পড়ন্ত বিকেলে দূরের চায়ের দোকান থেকে তখন ভেসে আসছে জনপ্রিয় একটা গানের সুর “মানুষ খুন হলে পরে, মানুষই তার বিচার করে, নেইকো খুনীর মাপ, তবে কেন পায় না বিচার নিহত গোলাপ”।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা