এই প্রবন্ধটি JUMP ম্যাগাজিন আয়োজিত প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭, শুক্রবার। ভারতের বুকে উঠল স্বাধীন দেশের রক্তিম সূর্য।
যে সূর্যের স্বপ্ন দেখে গিয়েছিলেন মঙ্গল পান্ডে থেকে ক্ষুদিরাম বসু, বাঘাযতীন থেকে মাস্টারদা সূর্য সেন, সরোজিনী নাইডু থেকে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মহাত্মা গান্ধী থেকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও কোটি কোটি ভারতীয়। শত শত মায়ের কোল খালি হয়ে গেছে, চোখের জল আর রক্তে কর্দমাক্ত হয়েছে ভারতমাতার মাটি। তাও স্বাধীনতা আসেনি, অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রিটিশ রাজের চরমপন্থা ও দমননীতি।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার ১৯০ বছর শেষে ভারত স্বাধীনতার স্বাদগ্রহণ করতে পারল। কিন্তু স্বাধীন দেশের পতাকা?
সেটা কি অধরাই থেকে গেল? না, তার পেছনেও আছে এক লম্বা কাহিনী।
স্বাধীন দেশের পতাকা সম্বন্ধে বলতে গেলে যেতে হবে ভারতের ইতিহাসের একদম গোড়ায়।
সেটা ১৮৫৭ সাল। মহাবিদ্রোহের আঁচে কেঁপে গেল ব্রিটিশদের ভিত। ভারত শাসনের দায়িত্ব নিলেন মহারানী ভিক্টোরিয়া। আগে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন পতাকা ব্যবহৃত হত। কিন্তু মহারানী ভিক্টোরিয়া দায়িত্ব নেওয়ার পর ঠিক হল গোটা দেশের একটাই পতাকা ব্যবহার হবে। এই পতাকাই ব্রিটিশদের অন্যান্য উপনিবেশ যেমন দক্ষিণ অফ্রিকা, কানাডায় ব্যবহার করা হত। বিংশ শতকের শুরুর দিকে ভারতের জন্য একটি অদ্বিতীয় পতাকার চিন্তাভাবনা শুরু হয়।
এক্ষেত্রে প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ নেন স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা মার্গারেট এলিজাবেথ নোব্ল তথা ভগিনী নিবেদিতা। ১৯০৪ সালে তিনি একটি পতাকা তৈরি করেন, রক্তিম এক পতাকার কেন্দ্র ছিল বজ্রচিহ্ন ও তার চতুর্দিকে ছিল আটটি প্রদীপ।
১৯০৬ সালে এই পতাকা জাতীয় কংগ্রেসের সামনে রাখাও হয়, কিন্তু একাধিক পতাকার প্রস্তাবের মাঝে এই পতাকা অন্ধকারে তলিয়ে যায়, তবে ভারতের বুকে প্রথম পতাকা উত্তোলন হয় ১৯০৬ সালেই। কলকাতার পারসিবাগানে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এক আন্দোলনে এর ব্যবহার হয়। ত্রিবর্ণ এই পতাকার তিনটি রং হিসাবে ব্যবহার হয়েছিল কমলা, হলুদ ও সবুজ।
১৯০৭ সালে ভারতের বিপ্লববাদের জননী ভিখাজি রুস্তম কামা ও তার সহযোগী সর্দার সিং রাণা ফরাসী সোশ্যালিস্ট পার্টির হিসাবে জার্মানির স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত সন্মেলনে যোগ দেন। সেখানে ‘মাদাম কামা’ ভারতের স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে ‘বন্দেমাতরম্’ লেখা তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকার বিবর্তনের পথিকৃৎ যে আমাদের প্রিয় বাংলা তথা কলকাতা তার প্রমাণ পতাকার ইতিহাসই দেয়।
এই কারণেই বোধহয় গোপালকৃষ্ণ গোখলের সেই বিখ্যাত উক্তিটি সার্থক – “What Bengal thinks today, India thinks tomorrow”
পতাকার জন্য এই আন্দোলন আবার নতুন গতি পায় ১৯১৭ সালে, বাল গঙ্গাধর তিলক ও অ্যানি বেসান্তের নেতৃত্বে সংঘটিত হোমরুল আন্দোলন জন্ম দেয় এক নতুন নিশানের। পাঁচটি লাল ও চারটি সবুজ রঙয়ের সারি দিয়ে তৈরি এই নিশানের এককোণে ছিল গ্রেট ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা (ইউনিয়ন জ্যাক), অপর কোণে ছিল সপ্তর্ষিমণ্ডলের ন্যায়ে সাজানো সাতটি তারা, রংয়ের প্রয়োগ ও সজ্জাতে আধুনিকতা ও নতুনত্বের মিশেল দেখা গেলেও এই পতাকা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। সম্ভবত এক কোণে থাকা ইউনিয়ন জ্যাকের জন্যই।
এর ঠিক এক বছর আগে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া তাঁর তৈরি করা পতাকা উপস্থাপন করেন। গান্ধীজীর পরামর্শে তিনি পতাকার কেন্দ্রে চরকার সংযুক্তি ঘটালেও তা সরকারিভাবে গৃহীত হয় না। কিন্তু বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে, এর আগে তৈরি করা পতাকাগুলির একেকটির বর্ণ ছিল একেকটি ধর্মের পরিচায়ক। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা বহু সম্প্রদায়কে খুশি করতে পারেনি। বিভিন্ন সম্প্রদায় পতাকায় বিভিন্ন বর্ণ সংযুক্তির দাবি জানায়। এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতি ১৯৩১ সালে একটি সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেন।
পতাকায় সম্প্রদায়কে প্রাধান্য না দেবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং পতাকা হিসেবে নির্বাচিত হয় সম্পূর্ণ গেরুয়া একটি পতাকা, যার এককোণে ছিল প্রগতির স্মারকরূপে একটি বাদামী চরকা। তবে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয় করাচী অধিবেশনে। নির্বাচিত হয় সেই পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়ারই তৈরি গেরুয়া, সাদা, সবুজ বর্ণ সহযোগে তৈরি তেরঙ্গা যার কেন্দ্রে ছিল ছিল নীল চরকা। এইসময় দেশের বিভিন্নপ্রান্তে বিভিন্ন পতাকা ব্যবহৃত হত।
সুভাষচন্দ্র বসুর তৈরি আজাদ হিন্দ্ ফৌজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সেই তেরঙ্গাই ব্যবহার করা হত। কেবলমাত্র চরকার পরিবর্তে ছিল লম্ফমান বাঘ ও লেখা ছিল ‘আজাদ হিন্দ’। ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৪, আজাদ হিন্দ বাহিনী ব্রিটিশ রাজের বজ্রমুষ্টি থেকে ছিনিয়ে নিল মণিপুরের মৌরাং ও নাগাল্যান্ডের অর্ধাংশ। মৌরাংয়ে সেদিনই ভারতের বুকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর তেরঙ্গা উত্তোলন করলেন কর্নেল সৌখত আলি মালিক। এই ঘটনা আজও ভারতের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে খোদাই করা আছে, কারণ এটিই ছিল ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম বিজয়।
মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতে সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে গণপরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ২৩শে জুন পতাকা নির্বাচনের জন্য তৈরি হয় কমিটি ও ১৪ই জুলাই তারা সিদ্ধান্তে আসে যে জাতীয় কংগ্রেসের পতাকাই হবে ভারতবর্ষের পতাকা। ২২শে জুলাই জওহরলাল নেহেরু এই পতাকা রাখেন গণপরিষদের সামনে। কোনরকম তর্কবিতর্ক ছাড়াই জাতীয় পতাকা হিসাবে নির্বাচিত হয় এই তেরঙ্গা। তবে জাতীয় কংগ্রেসের পতাকার কেন্দ্রে ছিল নীল চরকা আর এর ছিল ২৪টি দণ্ডযুক্ত অশোকচক্র। তেরঙ্গার গেরুয়া রং আমাদের দেশের গভীর ত্যাগের পরিচায়ক, সাদা সততার প্রতীক আর সবুজ উদ্ভিদ সমাজ আর দেশের মাটির সাথে আমাদের নাড়ির টানকে বোঝায়। আর কেন্দ্রে থাকা অশোকচক্র বোঝায় গতিশীলতাকে।
২০০২ সালের ২৬শে জানুয়ারি পতাকার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য দিন। মহামান্য সুপ্রিম কোট নির্দেশ দেয় এই তেরঙ্গা ব্যবহার করা যাবে যেকোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কারখানায়। তবে পতাকার প্রতি অসন্মান করা যাবে না।
দেশের পতাকা জাতির আশা, স্বপ্ন, ঐতিহ্যের বাহক। দীর্ঘকাল ধরে এই পতাকাকেই পূর্ণ গৌরবে ওড়ানোর জন্য বলিপ্রদত্ত হয়েছে। তাই চলুন না, দেশপ্রেমের আগুনে দগ্ধ হতে হতে আজ তেরঙ্গাকে স্যালুট করে গলা ফাটিয়ে বলি, ‘বন্দেমাতরম্’!
তথ্য সূত্র
- আধুনিক ভারতের ইতিহাস ও পরিবেশ (দশম শ্রেণি) – ডঃ প্রণব চট্টোপাধ্যায়
- ভারত ও বিশ্বের ইতিহাস (২০১৬) – জীবন মুখোপাধ্যায় ও ডঃ সুভাষ বিশ্বাস
- A National Flag for India: Rituals, Nationalism and the Politics of Sentiment – Arundhati Virmani
- Reverence, Resistance and Politics of Seeing the Indian National Flag (page 1-52) – Sadhan Jha
- The Last Days of the Raj – Trevor Royle
- The forgotten army India’s armed struggle for independence – Peter W. Fay
লেখক পরিচিতি
মিত্রজিৎ নাহা একজন দশম শ্রেণির ছাত্র। বর্তমানে মিত্রজিৎ উত্তরপাড়া চিলর্ড্রেন্স ওন হোম বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। এই প্রবন্ধটি JUMP ম্যাগাজিন আয়োজিত প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
আমি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানিধিকারী দশম শ্রেণীর ছাত্র মিত্রজিৎ নাহার প্রবন্ধটি পাঠ করেছি এবং সে খুবই সুন্দর ভাবে গুছিয়ে লিখেছে । সেই স্বাধীনতার বিদ্রোহী মনোভাব থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকার তাৎপর্য এক অনবদ্য চিত্র তুলে ধরেছে।