taper-poricholon
Article (প্রবন্ধ)

তাপের পরিবহন – সংক্ষিপ্ত ধারণা ও সেই ধারণার প্রয়োগ



“The science is often mixed with knowledge. This is a big misunderstanding. Science is not only knowledge, but also consciousness, i.e. ability to use knowledge”- Vasily Klyuchevsky” ~ Vasily Klyuchevsky

বিজ্ঞান, কেবল কোনো কিছু সম্পর্কে জ্ঞানলাভ নয় তার পাশাপাশি চেতনা অর্থাৎ লব্ধ জ্ঞানটি প্রয়োগ করার সামর্থ। আমাদের উদ্দেশ্য বিজ্ঞানের ধারণাগুলোকে শুধুমাত্র জানা নয় বরং তার সাথে সাথে সেই ধারণার প্রয়োগ করতে পারা।

কিভাবে করা যেতে পারে বিজ্ঞানের ধারণার প্রয়োগ?

চলুন তাহলে দেখা যাক:

শুরু করা যাক আমাদের সকলের জীবনের সাথে কম – বেশি ভাবে জড়িত পানীয় –চা দিয়ে। আমাদের বাড়ির প্রায় প্রত্যেক সদস্যদের প্রতিদিনের কাজের সূত্রপাত ঘটে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার মাধ্যমে। প্রাতঃভ্রমণে বেরোলে দেখতে পাওয়া যায় চায়ের দোকান গুলোতে জমে উঠেছে ‘চায়ের আসর’। এই চা হলো একটি পানীয় যেটি তৈরিতে প্রয়োজন হয় গরম বা ফুটন্ত জল, ‘তাপ’ ছাড়া যেটি প্রস্তুত করা অসম্ভব। তাহলে এবার আমাদের মনে স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্ন জাগছে যে তাপ কি? আর কেনই বা এই তাপ জলকে গরম করছে?

তাপ ও তাপমাত্রা

খুব সহজ ভাবে বলতে পারি যে তাপহলো একপ্রকার শক্তি, যেটির গ্রহণে পদার্থের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটে বর্জনে তাপমাত্রা হ্রাস হয় কোনো একটি বস্তুতে হাত দিলে যদি আমাদের উষ্ণ লাগে তখন আমরা বলি যে ওই বস্তুর তাপমাত্রা বেশি বা বস্তুটি গরম, আর যদি শীতল লাগে তখন বলি যে ওই বস্তুর তাপমাত্রা কম বা বস্তুটি ঠান্ডা। সুতরাং, তাপমাত্রা  হচ্ছে কোনো বস্তু কতটা গরম বা ঠান্ডা, তার পরিমাপ

যেমন আমরা যদি আগুনের শিখায় কোনো স্টিলের পাত্রকে ধরি তাহলে কিছুক্ষণ পর পাত্রটিতে হাত দিলে দেখবো যে সেটি গরম লাগছে অর্থাৎ পাত্রটির তাপমাত্রা বেড়ে গেছে, এক্ষেত্রে আগুনের শিখা পাত্রটিকে তাপ প্রদান করছে।

এবার জানবো তাপের সঞ্চালন সম্পর্কে, কারণ ‘তাপের সঞ্চালন’ না ঘটলে চা তৈরি করার জন্য জলকে কোনোদিনই গরম করা যেত না।

 তাপের সঞ্চালন কি এবং কিভাবে  ঘটে?

তাপের সঞ্চালন বলতে উষ্ণতর (যার তাপমাত্রা বেশি) স্থান থেকে শীতলতর (যার তাপমাত্রা কম) স্থানে তাপের গমন বা চলাচলকে কে বলা হয়ে থাকে।  তাপের এই  সঞ্চালন মূলত তিন ভাবে সংগঠিত হয়ে থাকে -পরিবহন ,পরিচলন ও বিকিরণ। তবে আমরা এখানে কেবল তাপের পরিবহন সম্বন্ধে জানবো ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেটির প্রয়োগ কিভাবে করা যায় সেটিও দেখবো ।

তাপের পরিবহন

পরিবহন শব্দটি আমাদের সকলের শোনা, আমরা যখন  এক স্থান থেকে  অন্য স্থানে গমন করি তখন আমরা বাস, ট্রেন বা প্লেন প্রভৃতি এর মাধ্যমে যাই অর্থাৎ এগুলি আমাদের এক স্থান থেকে অপর একটি স্থানে নিয়ে যেতে সাহায্য করে এককথায় আমাদের পরিবহন করে নিয়ে যায়, তাই এদের বলা হয় পরিবহন মাধ্যম। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমাদের পরিবহন ঘটছে একটি পরিবহন মাধ্যমের সাহায্যে, ঠিক একই ঘটনায় ঘটে তাপের ক্ষেত্রেও, তাপ যখন উষ্ণতর স্থান থেকে শীতলতর স্থানে গমন করে তখন একটি পরিবহন মাধ্যমের দরকার পড়ে এবং তাপের ক্ষেত্রে এই পরিবহন মাধ্যমের কাজ করে বস্তু মধ্যস্থ ইলেক্ট্রনসমূহ (electrons)।

subscribe-jump-magazine-india

সুতরাং, ইলেক্ট্রনসমূহ দ্বারা যখন উষ্ণতর স্থান থেকে শীতলতর স্থানে তাপের সঞ্চালন ঘটে তখন এটিকে আমরা বলে থাকি তাপের পরিবহন

তাহলে আমরা তো এতক্ষণে বুঝে গেছি যে তাপের পরিবহন কি, কিন্তু সত্যিই যে এই ঘটনাটি ঘটে সেটি আমরা কিভাবে বুঝবো?

আমরা পুনরায় চলে যাবো সেই সকাল বেলার চা ও চা তৈরির পাত্রে।

চা এর জল যখন আমরা আগুনের শিখায় বাসাবো তখন সেই জলে একটি চামচ কে ডুবিয়ে রাখবো তারপর জল যখন ফুটতে শুরু করবে তখন আমরা চামচটিতে হাত দিলে দেখবো যে চামচটি বেশ গরম হয়ে গেছে এবং খালি হাতে ধরতে গেলে প্রচন্ড গরম লাগছে।

তাহলে প্রথমে চামচটিকে যখন পাত্রে থাকা জলে ডুবিয়েছিলাম তখন তো গরম লাগেনি, খুব সহজেই তো ধরতে পেরেছিলাম কিন্তু এখন গরম হলো কিভবে?

কারণ এখানে তাপের পরিবহন ঘটেছে।

কিভাবে ঘটছে তাপের এই পরিবহন?

আগুনের শিখা থেকে তাপ গ্রহণ করে পাত্র ও জল উভয়ই গরম হচ্ছে। পাত্রটির ক্ষেত্রে প্রথমে আগুনের শিখার সংস্পর্শে থাকা অংশটি গরম হয়েছে তারপর তাপের পরিবহনের ফলে সমগ্র পাত্রটি গরম হয়েছে। পাত্রের উষ্ণতর স্থান থেকে শীতল স্থানে তাপের পরিবহন ঘটেছে এবং এর ফলে শীতল স্থানটিও গরম হয়ে গেছে ধীরে ধীরে, ফলে সমগ্র পাত্রটি গরম হয়েছে। চামচের একটি অংশ জলের সংস্পর্শে ও অপর একটি অংশ পাত্রের সংস্পর্শে থাকার জন্য উভয় স্থানের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।

tea-container

চামচটি পাত্র ও জল উভয় স্থান থেকেই তাপ গ্রহণের করেছে। এবার তাহলে যখন কিছু অংশ গরম হয়ে গেছে তখন বাকি অংশ যেগুলো গরম হয়নি সেই অংশগুলোতে তাপ চলে যাবে পরিবহনের মাধ্যমে তাপমাত্রার তফাৎ-এর ফলে যা সমগ্র চামচটিকে গরম করে দেবে এবং খালি হাতে স্পর্শ করতে গেলে গরম লাগবে। তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম যে কিভাবে তাপের পরিবহন চামচ কে গরম করছে ।

এবার আমাদের মনে প্রশ্ন আসছে যে এতকিছু তো শিখলাম ,জানলাম কিন্তু এসব জেনে কি  লাভ হবে?

লাভ  অবশ্যই  হবে  কারণ  এই ধারণাগুলির একাধিক প্রয়োগ আমাদের জীবনে হয়, আমরা এখানে এইরকম একটি প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করবো।

বাড়িতে হয়তো অনেকেই মা ঠাকুমাকে বলতে শুনেছেন যে টেবিলে সরাসরি গরম কিছু রাখিসনা, টেবিল নষ্ট হয়ে যাবে। আবার অনেকে হয়তো নিজ অভিজ্ঞতা থেকেও লক্ষ করেছেন যে দীর্ঘদিন টেবিলের পৃষ্ঠে কোনো গরম বস্তুকে সরাসরি  রাখলে  টেবিলের পৃষ্ঠ নষ্ট হয়ে যায়। এর কারণ হলো তাপ, যেটি বস্তু থেকে সরাসরি টেবিলের পৃষ্ঠে যায় ফলে টেবিল পৃষ্ঠটি গরম হয়। এরকম দীর্ঘদিন ধরে হলে টেবিলের পৃষ্ঠ নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং এই কারণেই আমাদের টেবিল ম্যাট (table mat ) ব্যবহার করতে বলা হয়। এই টেবিলম্যাট বস্তু থেকে টেবিলের পৃষ্ঠে তাপের পরিবহনে বাধা দিয়ে টেবিলেটিকে গরম হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। এখন অনেকের বাড়িতে টেবিল ম্যাট হারিয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় তখন সেক্ষেত্রে আমরা আমাদের তাপীয় পরিবহন, তাপীয় শোষণ এর ধারণকে কাজে লাগাতে পারি।

তাপীয় পরিবহনের ধারণার ব্যবহার

বস্তুর পুরুত্ব তাপের শোষণ

আমরা তাহলে পূর্বের আলোচনা থেকে এটা বুঝতে পেরেছি যে টেবিল গরম হওয়ার কারণ হলো তাপের পরিবহন এবার যদি আমরা গরম বস্তুটি থেকে  টেবিলের পৃষ্ঠে তাপের পরিবহনকে বাধা দিতে পারি তাহলে আমরা টেবিল কে গরম হওয়ার থেকে রক্ষা করতে পারবো। আমরা যদি গরম বস্তু ও টেবিলের মধ্যে ওপর কোনো একটি বস্তুকে রাখি তাহলে গরম বস্তুটি থেকে প্রথমে সেই বস্তুটিতে তাপ যাবে তারপর সেই বস্তু থেকে টেবিলের পৃষ্ঠে  তাপ আসবে।



আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা ধরে নিচ্ছি গরম বস্তুটি হলো A ,টেবিল ও গরম বস্তুর মধ্যে যেই বস্তুটিকে রাখা হচ্ছে সেটি হলো B। তাহলে তাপ A  থেকে B  তে আসবে তারপর টেবিলে যাবে B এর মধ্যে দিয়ে। এখন B এর পুরুত্ব যত বেশি হবে তার মধ্যে দিয়ে তাপের পরিবহনে তত অধিক সময় লাগবে ও তাপের শোষণ অধিক হবে। আমরা B হিসেবে যেকোনো কিছুকে ব্যবহার করতে পারি যদি বস্তুটি পুরু হয়। কাগজ আমাদের সকলের কাছেই আছে তাই এই কাজে কাজগের ব্যবহার উপযুক্ত।

 কাগজ ব্যবহার করলে কাগজকে কিভাবে রাখবো?

আমরা যদি কাগজকে ভাঁজ না করে (পুরুত্ব কম) রাখি তাহলে তাপ সহজেই বস্তু থেকে টেবিল চলে যাবে কারণ এক্ষত্রেও তাপের শোষণ কম হবে ও পরিবহন দ্রুত ঘটবে। এখন আমরা জানি পুরুত্ব বেশি হলে শোষণ বেশি হয় তাপের ও পরিবহনেও সময় লাগে বেশি সেইজন্য আমরা যদি ওই কাগজকে কয়েকবার ভাঁজ করে পুরু করে তারপর তার ওপরে ওই বস্তুটিকে রাখি তাহলে টেবিল সহজে গরম হবেনা বা হতে সময় লাগবে। কারণ পুরুত্ব বেশি হওয়ায় তাপের পরিবহন ধীরে ধীরে হবে। যত বেশি পুরু করবো তত বেশি ভালো কারণ শোষণ বেশি পরিমানে হবে। article-image-2

শেষের কথা

তাহলে আমরা শিখলাম কিকরে করা যায় বিজ্ঞানের প্রয়োগ,  তাপ পরিবহনের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে টেবিলের পৃষ্ঠকে রক্ষা করতে পারি নষ্ট হওয়ার হাত থেকে।

উপরিউক্ত সম্পূর্ণ  বিষয়টিকে কবিতার ছলে লিখতে পারি

“তাপীয় পরিবহন আমাদের জীবনের সাথে বহুল ভাবে সংযুক্ত

সেইজন্য এর প্রয়োগ নিয়ে ভাবনা চিন্তা যুক্তিযুক্ত ।

অতিরিক্ত তাপের ফলে টেবিল পৃষ্ঠ হয়ে যেতে পারে নষ্ট

তাই গরম বস্তুকে সরাসরি টেবিল পৃষ্ঠে না রাখায় উৎকৃষ্ট ।

গরম বস্তুকে সরাসরি রাখতে হলে  বারবার

ব্যবহার করবো কাগজ বস্তুর নিচে  রেখে, ভাঁজ করে একাধিকবার।

তাপ ও তাপীয় পরিবহন এর ধারণা রাখলে সম্পূর্ণ

সেগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে হবে  বিজ্ঞানের সংজ্ঞা পরিপূর্ণ।”

তথ্য সূত্র

  • https://www.sciencedirect.com/topics/engineering/conduction-heat-transfer
  • https://nptel.ac.in/courses/112/105/112105271/
  • http://hyperphysics.phy-astr.gsu.edu/hbase/thermo/heatra.html
  • http://statusmind.com/smart-quotes-2581/

লেখক ও লেখিকা পরিচিতি

সৌম্যদীপ মৈত্র –  জঙ্গীপুর কলেজ (কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় এর অন্তর্গত ) পদার্থবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের  ছাত্র; মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত জঙ্গীপুরের বাসিন্দা।

শামসাদ বেগম– জঙ্গীপুর কলেজ (কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় এর অন্তর্গত ) পদার্থবিদ্যা বিভাগের  দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী; মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত  রঘুনাথগঞ্জের বাসিন্দা।

“পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের বিশেষ আগ্রহ বিজ্ঞানকে আমাদের জীবনের নানান ক্ষেত্রে প্রয়োগ এবং সেই উদ্দেশ্যে  বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিয়ে ছোট ছোট পরীক্ষা নিরীক্ষা করা। এছাড়াও আমাদের ভালো লাগে বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের জীবনী নিয়ে জানতে এবং  বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে ও ধারণাগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজ করে তুলে ধরতে যাতে তাঁরা সেগুলোকে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারেন।”

এই লেখাটি থেকে ভালো লাগলে হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



এছাড়া,পড়াশোনা সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ের আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহন করতে যুক্ত হতে পারেন ‘লেখা-পড়া-শোনা’ ফেসবুক গ্রূপে। এই গ্রুপে যুক্ত হতে ক্লিক করুন এখানে।

lekha-pora-shona-facebook-group