নবম শ্রেণির ছাত্র গৌতমের কাল স্কুলে ভৌতবিজ্ঞান পরীক্ষা।
অন্য বিষয়গুলি মোটামুটি বাগে আনতে পারলেও, ভৌতবিজ্ঞান বিষয়টিকে গৌতম ভূতের থেকেও বেশি ভয় পায়। কালকের পরীক্ষা নিয়ে সে বেশ চিন্তাতেই আছে, তাই সকাল থেকে বই নিয়ে দুলে-দুলে পড়ছে গৌতম।
অন্যসময় গৌতম মোটে পড়তে বসতে চায় না। এই নিয়ে গৌতমের মা মুনমুনের সাথে গৌতমের বিবাদের অন্ত নেই। তবে পরীক্ষার আগে গৌতম বেশ সিরিয়াস হয়ে যায়। এই সময় তাকে পড়তে বসতে বলতে হয় না। তাই মুনমুন বেশ খুশিই আছে।
এগারোটা নাগাদ বাড়ির কলিংবেল বেজে ওঠে।
দরজা খুলে ভীষণ অবাক হয়ে যায় মুনমুন। এযে ব্রজকাকা! মুনমুনের বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ব্রজবিহারী দত্ত। ছোট বেলায় মুনমুন ব্রজকাকার ভীষণ নেওটা ছিল। পড়াশোনায় ভীষণ পণ্ডিত মানুষ ছিলেন ব্রজবিহারী দত্ত, প্রায় তিরিশ বছর আগে আমেরিকার কোন এক বিখ্যাত university তে পড়ানোর ডাক পেয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। তারপর আর কোন দিন মুনমুনের সাথে দেখা হয়নি ব্রজকাকার।
আজ তিরিশ বছর পরে ব্রজকাকাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে মুনমুন। প্রথমে প্রণাম করে, একগাল হেসে বলে –
আরে ব্রজকাকা কেমন আছো, কত বছর পরে তোমাকে দেখলাম। সাদা চুল ছাড়া কিছুই তো পরিবর্তন হয় নি তোমার। কবে এলে দেশে?
ব্রজবিহারী দত্ত মুনমুনকে আশীর্বাদ করে দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন আর বলেন – সপ্তাখানেক হল এসেছি, এখানকার বাড়িটা ভাইকে লিখে দেবার জন্য আসা। একদিন তোর বাবার সাথে একটা গোটা দিন ধরে আড্ডা মারতে তোদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তোর বাবাই, তোর এখনকার বাড়ির ঠিকানা দিলেন। ভাবলাম আমার মুনমুন কেমন আছে একটু দেখে আসি, তাই আজ আসা।
মুনমুন বলে – খুউব ভালো করেছো, দাঁড়াও তোমাকে একটি আস্ত গেছো- বাঁদরের সাথে আলাপ করাই। এই বলে মুনমুন গৌতমকে ডেকে আনে।
ব্রজবিহারী দত্তের সঙ্গে গৌতমের আলাপ হয়। তাতে তিনি জানতে পারেন যে গৌতমের কাল পরীক্ষা তাই সে খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। পড়ার সাথে ব্রজবিহারীর আত্মিক যোগাযোগ, আর পদার্থবিদ্যার নাম শুনলে তো তার শরীরের DNAগুলো অবধি লাফিয়ে ওঠে। তাই কাল গৌতমের ভৌতবিজ্ঞান পরীক্ষা শুনে সে দুই-একটা প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারে না।
ব্রজবিহারী গৌতমকে বলেন, আচ্ছা তুমি নিউটনের গতিসূত্র পড়েছ নিশ্চয়ই। আমাকে বল দেখি, স্থির বাস চলতে শুরু করলে, বাসে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা পিছন দিকে হেলে যায় কেন?
প্রমাদ গোনে গৌতম – একমিনিট মাথা চুলকিয়ে, তিরিশ সেকেন্ড নখ কামড়িয়ে সে কাঁচুমাচু মুখে বলে জানিনা দাদু।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ব্রজবিহারী বলেন, নিউটনের গতিসূত্র পড়েছ অথচ জাড্য পড়োনি? স্থিতিজাড্যর জন্য এটা হয়, বলে তিনি গৌতমকে ব্যপারটা ব্যাখ্যা করে দেন।
গৌতম বলে, এতো খুব সহজ ব্যাপার। আসলে এই প্রশ্নটা স্যার লিখে দেননি তাই আমিও পড়িনি।
[আরো পড়ুন – পরীক্ষায় নম্বর পাইনা কেন?]
উত্তর শুনে একটু অবাক হন ব্রজবিহারী। সামনের অ্যাকুরিয়ামের দিকে ইঙ্গিত করে গৌতমকে আবার প্রশ্ন করেন, এটা কি তুমি পরিষ্কার করো? গৌতম ঘাড় নাড়লে, তিনি আবার বলেন। পাইপ দিয়ে প্রথমে জল টেনে অ্যাকুরিয়ামেরথেকে বের করে নাও তো? আবার ঘাড় নাড়ে গৌতম। ব্রজবিহারী বলেন, বলতো এটাকে কি বলে।
এবার আহ্লাদিত হয় গৌতম, লাফিয়ে বলে ‘সাইফন’ ক্রিয়া।
ব্রজবিহারী হেসে বলেন, বাহ। সাইফন ক্রিয়া কিভাবে হচ্ছে বলতে পারবে।
গৌতমের মুখ পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যায় পরিবর্তিত হয়। কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে বলে, এই প্রশ্নটাও আমি পড়িনি।
এবার আকাশ থেকে পড়েন ব্রজবিহারী, অবাক হয়ে মুনমুনের মুখের দিকে তাকান।
ছেলেকে রক্ষা করতে মুনমুন ময়দানে নামে।
বলে, আসলে কাকা গৌতম ভৌতবিজ্ঞানে খুব কাঁচা। একদম নম্বর পায় না পরীক্ষায়। কত বলি ভালো করে পড়া মুখস্থ কর। কিছুতেই করে না। ওর বাড়ির স্যার সবকটা প্রশ্নের নোট লিখে দিয়েছেন। বলেছেন ঐগুলো পড়লেই কমন আসবে আর নম্বরও কাটা যাবে না। কিন্তু গৌতম আমার কথা শুনলে তো, সাধে কি আমি ওকে গেছো- বাঁদর বলি।
এবার সমস্যাটা বুঝতে পারেন ব্রজবিহারী। আঁতকে উঠে বলেন, ছেলেটার ভবিষ্যত এই ভাবে কেন ধ্বংস করছিস মুনমুন! বিজ্ঞান কি নোট মুখস্থ করার জিনিস??? বিজ্ঞানকে না বুঝলে কোনভাবেই তাকে বাগে আনা যেতে পারে না।
মুনমুন বলে – আমি বুঝি কাকা, কিন্তু কি করি বলো, পরীক্ষায় যে একদম নম্বর পায় না গৌতম।
ব্রজবিহারী বলেন – ওরে মুখস্থ করে পরীক্ষায় নম্বর পাওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টা শেখা যায় কি? আর এখন যদি না শেখে, তাহলে ভবিষ্যতে ও কিভাবে আরো শক্ত বিষয়গুলি শিখবে তা ভেবেছিস?
বিদেশে একটা পরীক্ষা পদ্ধতি চালু আছে, তার নাম ‘ওপেন বুক এক্সাম’ অর্থাৎ পরীক্ষার সময় বই, নোটস্ ইত্যাদি সামনে রেখে পরীক্ষা দেওয়া যায়, কোন কোন সময় তো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে দিয়ে 24 ঘণ্টা সময় দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এবার অবাক হয়ে গৌতম প্রশ্ন করে, ওমা সেকি কথা ছাত্রছাত্রীরা টুকে লিখবে যে।
প্রাজ্ঞ ব্রজবিহারী বলেন – ঐখানেই তো আসল মজা। এমন ধরনের প্রশ্ন আসে যেগুলি সম্পূর্ণ প্রয়োগমূলক অর্থাৎ কোন ছাত্র যদি মুখস্থ করে তাহলে সে কোনভাবেই তা লিখতে পারবে না । তাকে সেই ধারণাগুলি খুব ভালো ভাবে জানতেই হবে।
[আরো পড়ুন – পড়াশোনার উন্নতিতে বই পড়ার গুরুত্ব]
আরে নিউটনের সুত্রগুলি তো একজন Google দেখেও লিখে বা বলে দিতে পারে, তার জন্য তাকে বই খুলে পড়াশোনা করতে হবে না।
ছাত্রছাত্রীদের এই সূত্রগুলির ধারণা এবং প্রয়োগগুলি বুঝতে হবে। এই ভাবে পড়াশোনা করলে তবেই না উচ্চশিক্ষার সময় ছাত্রছাত্রীরা তাদের শেখা বিষয়গুলি কাজে লাগাতে পারবে। নাহলে শিখে কি লাভ। এরপর মুনমুনের দিকে তাকিয়ে ব্রজবিহারী বলেন, ছেলের কোন খেয়াল রাখিস না! ও বিজ্ঞান বুঝতে পারছে না আর তুই কিনা নম্বর – নম্বর করে ওকে বিজ্ঞান মুখস্থ করাচ্ছিস। এতে ওর কোনভাবেই ভালো হতে পারে না।
আগে ওকে বিজ্ঞান বুঝতে শেখা, বিজ্ঞান বুঝলে পরীক্ষায় এমনিই নম্বর আসবে।
নিজের ভুল বুঝতে পারে মুনমুন। সত্যিই এই সামান্য ব্যাপারটা ও এতদিন কেন যে বুঝতে পারেনি তাই এখন বুঝতে পারে না। আর দেরি নয়, ওর এবারের পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই গৌতমকে নিয়ে বসতে হবে। বুঝতে হবে ওর কোথায় কোথায় বিজ্ঞান বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে।
————
শেষকথা – আপনি কি জানেন 52% ছাত্রছাত্রী বিজ্ঞান না বুঝে মুখস্থ করে?
সব গৌতম – মুনমুনের কাছে ব্রজবিহারী দত্ত থাকেন না। তাই নিজেদের ভুলটাও অনেক সময় অধরাই থেকে যায় আর ভবিষ্যতের জন্য অনেক সমস্যা তৈরি করে। তাই আজই অভিভাবক হিসাবে নিজের সন্তানকে জিজ্ঞেস ‘ওর কোথাও পড়া বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে নাতো? ও না বুঝে পড়া মুখস্থ করছে না তো?’ ওর ভবিষ্যতের কারিগর কিন্তু আপনিই।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা