বাংলা – দশম শ্রেণি – সিন্ধুতীরে (পদ্য)
কবি পরিচিতি
বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের অন্যতম সেরা কবি সৈয়দ আলাওল। আনুমানিক ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি আরাকানের (এটি বার্মাপ্রদেশের একটি অঙ্গরাজ্য বর্তমানে মায়ানমার দেশের মধ্যে অবস্থিত) সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন।
আরাকান রাজার প্রধান অমাত্য বা প্রধান মন্ত্রী মাগন ঠাকুর, সৈয়দ আলাওলের সাহিত্য প্রতিভায় মুগ্ধ হন এবং তাঁর সভায় স্থান দেন। মূলত মাগন ঠাকুরের অনুরোধেই সৈয়দ আলাওল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ‘পদ্মাবতী’ তাঁর রচিত সেরা এবং প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ‘পদ্মাবতী’ ছাড়াও কবি ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জমাল’, ‘তোহ্ফা’ ইত্যাদি কাব্য রচনা করেন।
উৎস
‘পদ্মাবতী’ কাব্যটি বিখ্যাত হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্যের বাংলা অনুবাদ। কিন্তু শুধুমাত্র অনুবাদ হিসাবে সাহিত্য হিসাবে ‘পদ্মাবতী’কে বিচার করা সম্ভব নয়, কারণ এই অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে সৈয়দ আলাওল মৌলিকতা এবং স্বকীয়তার অসংখ্য নিদর্শন রেখেছেন। বর্তমানে আলোচ্য ‘সিন্ধুতীরে’ কাব্যাংশটি ‘পদ্মাবতী’ কাব্যগ্রন্থের ‘পদ্মাসমুদ্র খণ্ড’ থেকে গৃহীত হয়েছে।
সিন্ধুতীরে কবিতার বিষয়বস্তুসহ বিস্তারিত ভিডিও ক্লাস ↓
পদ্মাবতীর কথা
চিতোরের রাণা (রাজপুত রাজাদের রাণা বলে সম্ভাষিত করা হত) রত্নসেন এবং রানী পদ্মাবতী (বা পদ্মিনী) ইতিহাসের দুটি অমর চরিত্র।
রানী পদ্মাবতী ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি শুধুমাত্র রানীর রুপের বিবরণ শুনেই, পদ্মাবতীর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁকে বিবাহ করার ইচ্ছায় চিতোর আক্রমণ করেন। রাজপুত সেনা, সুলতানের আক্রমণ প্রতিহত করলে সুলতান ছলের আশ্রয় নিয়ে রাণাকে বন্দী করেন। এরপর নানান ঘটনার পরে, সুলতানকে প্রতিহত করার উপায়ন্তর না দেখে রানী পদ্মাবতী ও অন্যান্য রাজপুত মহিলারা জহরব্রত পালনের মাধ্যমে আত্মবিসর্জন করেন।
‘পদুমাবৎ’ এবং ‘পদ্মাবতী’ দুটি কাব্যগ্রন্থই রচিত হয় লোককথার উপরভিত্তি করে। দুটি কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রেই রচয়িতা ইতিহাসের তুলনায় কল্পনা এবং লোককথাকেই অধিক প্রাধান্য দিয়েছিলেন। উৎসাহী ছাত্রছাত্রীরা এই লিঙ্ক থেকে সৈয়দ আলাওল রচিত পদ্মাবতীর মূল কাহিনী পড়ে নিতে পারো।
পূর্বকথা
রাজপুত রাজা রত্নসেন তাঁর পত্নী সিংহল (শ্রীলঙ্কা) রাজকন্যা পদ্মাবতীকে বিবাহ করে জলপথে নিজ দেশে ফিরে আসছিলেন। এর পূর্বে সমুদ্র রাজ (সমুদ্রের দেবতা) ব্রাহ্মণবেশে রাজা রত্নসেনের কাছে দান ভিক্ষা করেন। কিন্তু দানে রাজা অসম্মত হলে ভিক্ষুকবেশী সমুদ্ররাজ ক্রুদ্ধ হন।
সমুদ্র অধিপতির ক্রোধে রাজা রত্নসেনের নৌকা প্রকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং তা ভেঙে যায়। বিপদ বুঝে রত্নসেন একটি ভেলায় পদ্মাবতী ও তার চার সখীকে তুলে দেন এবং নিজে অন্য একটি ভেলায় উপবিষ্ট হন। পদ্মাবতীর ভেলা সমুদ্রের স্রোতে একটি দ্বীপে এসে উপস্থিত হয়; প্রবল ভয়ে রানী পদ্মাবতী এবং তার সখীরা ততক্ষণে মূর্ছিত হয়েছেন।
সিন্ধুতীরের বিষয়সংক্ষেপ
দিকভ্রষ্ট ভেলা যে দ্বীপে এসে পৌছায় তা ছিল সমুদ্র কন্যা পদ্মার আবাস। স্বর্গ্যতুল্য এই দ্বীপ উদ্যানে সমুদ্রকন্যা পদ্মা (পদ্মাবতী এবং পদ্মা দুটি ভিন্ন চরিত্র) তাঁর সখীদের নিয়ে বাস করেন। একদিন ভোরে পিতৃগৃহ থেকে নিজগৃহে ফেরার পথে পদ্মা এবং তাঁর সখীরা, রাজকুমারী পদ্মাবতী ও তাঁর চার সখীকে সমুদ্রপাড়ে মূর্ছিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। জলযুদ্ধে ক্লান্ত পদ্মাবতীর পোশাক এলোমেলো, মুখে শ্রান্তির প্রবল ছাপ থাকা স্বত্তেও তাঁর অপরূপ সৌন্দর্য ম্রিয়মাণ হয়নি।
পদ্মাবতীর সৌন্দর্য দেখে পদ্মা অনুমান করেন যে পদ্মাবতী নিশ্চয় সাধারণ কেউ নন এবং নিশ্চয় তাঁরা নৌকা বিপর্যয়ে বিপদে পড়েছেন। পদ্মা তাঁদের প্রাণ বাঁচাতে উদ্যোগী হন, তিনি তাঁর সাথীদের আদেশ দেন অথিতিদের আবাসে নিয়ে আসেন চিকিৎসা করার জন্য। সেবা এবং ‘তন্ত্র, মন্ত্র এবং মহৌষধি’ সহ নানান উপাচারে পদ্মাবতী ও চার সখীর চেতনা ফিরে আসে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
সিন্ধুতীরের সরলার্থ
“কন্যারে ফেলিল যথা জলের মাঝারে তথা
দিব্য পুরী সমুদ্র মাঝার।”
কন্যা অর্থাৎ পদ্মাবতী এবং তাঁর চার সখীকে সমুদ্র, জলের (সমুদ্রের) মাঝে এক দিব্য পুরী বা স্বর্গীয় নগরীতে গিয়ে উপস্থিত করলো।
“সমুদ্রনৃপতি সুতা পদ্মা নামে গুণযুতা
সিন্ধুতীরে দেখি দিব্যস্থান।।”
সমুদ্র নৃপতি সুতা অর্থাৎ সমুদ্র রাজার কন্যা, যার নাম পদ্মা, সমুদ্রপারের ঐ দিব্যস্থান অর্থাৎ স্বর্গসম স্থান প্রথম দেখেন।
“উপরে পর্বত এক ফল ফুলে অতিরেক
আর পাশে রচিল উদ্যান।।”
পদ্মা দেখেন ঐ দিব্যস্থান পর্বত দ্বারা ঘেরা এবং সেখানে ফল এবং ফুলের প্রাচুর্য (অতিরেক)। তিনি সেখানে উদ্যান তৈরি (রচনা) করলেন।
“তাহাতে বিচিত্র টঙ্গি হেমরত্নে নানা রঙ্গি
তথা কন্যা সর্বক্ষণ।।”
ঐ দিব্য নগরীতে একটি বিচিত্র প্রাসাদ (টঙ্গি) আছে যা হেম অর্থাৎ সোনা ও রত্ন দ্বারা শোভা (রঙ্গি) পায়। সেখানে পদ্মা সবসময় বাস করেন।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান |
“পিতৃপুরে ছিল নিশি নানাসুখে খেলি হাসি
যদি হৈল সময় প্রত্যুষ।”
পিতৃপুর অর্থাৎ ঐ সমুদ্র নগরীতে সারা রাত ধরে সময় উপভোগ করেছেন সমুদ্রকন্যা পদ্মা এবং তাঁর সখীরা। এবার প্রত্যুষ অর্থাৎ ভোর হয়েছে।
“সখীগন করি সঙ্গে আসিতে উদ্যানে রঙ্গে
সিন্ধুতীরে রহিছে মাঞ্জস।।”
ভোর বেলা পদ্মা ও তাঁর সখীরা উদ্যানে এসে দেখেন যে সমুদ্রতীরে একটি মাঞ্জস অর্থাৎ ভেলা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
“মনেতে কৌতুক বাসি তুরিত গমনে আসি
দেখে চারি সখী চারিভিত।”
কৌতূহলের বলে পদ্মা তাড়াতাড়ি (তুরিত গমনে) ঐ মাঞ্জসের কাছে এগিয়ে আসেন এবং দেখেন মাঞ্জসের চারদিকে চারজন সখী অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছেন।
“মধ্যেতে যে কন্যাখানি রূপে অতি রম্ভা যিনি
নিপাতিতা চেতন রহিতা।।”
পদ্মা লক্ষ্য করেন যে মাঞ্জসের মধ্যে যে কন্যা অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন তিনি অপরূপ সুন্দরী। তার সৌন্দর্য যেন স্বর্গের সুন্দরী অপ্সরা রম্ভাকেও হার মানায়।
“দেখিয়া রুপের কলা বিস্মিত হইল বালা
অনুমান করে নিজ চিতে।”
অচেতন কন্যার রুপের বহর দেখে পদ্মা (বালা অর্থাৎ মেয়ে) বিস্মিত হলেন। তিনি মনেমনে (চিতে) অনুমান করলেন…
“ইন্দ্রশাপে বিদ্যাধরী কিবা স্বর্গভ্রষ্ট করি
অচৈতন্য পড়িছে ভুমিতে।।”
তিনি অনুমান করলেন যে হয়তো এই কন্যা একজন স্বর্গের গায়িকা (বিদ্যাধরী) যিনি স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের শাপে স্বর্গচ্যুত হয়েছেন এবং তাই অচৈতন্য অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন।
“বেকত দেখিয়া আঁখি তেন-স-বসন সাক্ষী
বেথানিত হইছে কেশ বেশ।”
অচৈতন্য কন্যার পরিশ্রান্ত চোখ, অসংলগ্নন চুল ও পোশাক দেখে …
“বুঝি সমুদ্রের নাও ভাঙ্গিল প্রবল বাও
মোহিত পাইয়া সিন্ধু ক্লেশ।।”
বোঝা যাচ্ছে যে সমুদ্রের মাঝে প্রবল বাতাসে (বাও) অচৈতন্য কন্যাকে (এখানে মোহিত অর্থাৎ সুন্দরী অর্থে অচৈতন্য কন্যাকে বোঝানো হয়েছে) সমুদ্র ঝড়ের কষ্ট (সিন্ধু ক্লেশ) সহ্য করতে হয়েছে।
“চিত্রের পোতালি সমা নিপতিত মনোরমা
কিঞ্চিৎ আছয় মাত্র শ্বাস।”
চিত্রের পুতুলের মতো সুন্দরী কন্যা পড়ে আছে, তার শ্বাস – প্রশ্বাস প্রায় চলছে না বললেই চলে।
“অতি স্নেহ ভাবি মনে বলে পদ্মা ততক্ষনে
বিধি মোরে না কর নৈরাশ।।”
অপরিচিত সুন্দরী কন্যার ঐরূপ দুরাবস্থা দেখে পদ্মার মনে স্নেহের উদ্রেক হল। সে মনে মনে বিধাতার কাছে নিরাশ না করার জন্য প্রার্থনা জানালো।
“পিতার পুণ্যের ফলে মোহর ভাগ্যের বলে
বাহুরক কন্যার জীবন।”
পদ্মা বিধাতার কাছে প্রার্থনা জানালো যে তার পিতার পুণ্য
(সমুদ্র) এবং তার ভাগ্যের জোরে যেন ঐ অপরিচিত কন্যার জীবন ফিরে আসে (বাহুরক অর্থাৎ ফিরে আসা)।
“চিকিৎসিমু প্রাণপণ কৃপা কর নিরঞ্জন
দুঃখিনীরে করিয়া স্মরণ।।”
পদ্মা, ঐ অপরিচিত কন্যার প্রাণপণ সেবা করার অঙ্গীকার করে নিরঞ্জন অর্থাৎ নিরাকার ঈশ্বরের কাছে কৃপা প্রার্থনা করলেন।
“সখী সব আজ্ঞা দিল উদ্যানের মাঝে নিল
পঞ্চজনে বসনে ঢাকিয়া।”
পদ্মা তাঁর সখীদের আদেশ দিলেন যে তারা যেন অচৈতন্য পাঁচজনকে কাপড়ে মুড়ে উদ্যানের মাঝে নিয়ে যায়।
“অগ্নি জ্বালি ছেকে গাও কেহ শিরে কেহ পাও
তন্ত্র মন্ত্রে মহৌষধ দিয়া।।”
অচৈতন্য পাঁচজনের চিকিৎসা শুরু হয়, আগুন জেলে তাদের গায়ে, পায়ে ও মাথায় আগুনের সেঁক দেওয়া হয়। তন্ত্র, মন্ত্র এবং ভেষজ ওষুধ, সবকিছু দিয়ে তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করা হয়।
“দণ্ড চারি এই মতে বহু যত্নে চিকিৎসিতে
পঞ্চকন্যা পাইল চেতন।”
চার দণ্ড এইভাবে বহু যত্নে চিকিৎসা চলার পরে পাঁচকন্যা জ্ঞান ফিরে পায়।
[আগেকার সময়ে সময়কে প্রহর ও দণ্ডে ভাগ করা হত। এক প্রহর অর্থাৎ তিন ঘণ্টা এবং এক দণ্ড অর্থাৎ এক প্রহরের সাড়ে সাত ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ২৪ মিনিট]
“শ্রীযুত মাগন গুণী মোহান্ত আরতি শুনি
হীন আলাওল সুরচন।।”
শ্রীযুক্ত মাগনের আদেশে, পুরোহিতের আরতির ধ্বনি শুনে, তুচ্ছ আলাওল এটি রচনা করেন।
প্রসঙ্গত, সেই সময়ে স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই তাঁর অথবা তাঁর পৃষ্ঠপোষকের নাম (যেমন রাজা) লিখে রাখতেন। এইভাবেই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে স্রষ্টা অমর হয়ে থাকতেন।
সমাপ্ত। আরো পড়ো → নদীর বিদ্রোহ গল্পের সম্পূর্ণ আলোচনা
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-Ben-Sindhutire
I got a lot of help from here
Dear Apurba, thank you for your support and love! 🙂