jowar-bhatar-dharona
Madhyamik

জোয়ার ভাটার ধারণা | বারিমণ্ডল

ভূগোলদশম শ্রেণি – বারিমণ্ডল (তৃতীয় পর্ব)

আগের পর্বে আমরা পৃথিবীব্যাপী সমুদ্রস্রোতের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা পৃথিবীব্যাপী সমুদ্রস্রোতের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

চাঁদ এবং সূর্যের আকর্ষণ বলের প্রভাবে সমুদ্রের জল কখনো উপরে উঠে আবার কখনো নেমে যায়। সাধারণত অমাবস্যা ও পূর্ণিমার দিনের সমুদ্র ফুলে ওঠে এবং অন্যান্য দিনগুলোতে সমুদ্রের জলতল নিচে থাকে। সমুদ্র জলের এই ওঠানামা দিনে দুবার একটা নির্দিষ্ট ছন্দে নিয়মিতভাবে চলতে থাকে। জলতলের এই ওঠানামা সূর্য, চাঁদ ও পৃথিবীর আপেক্ষিক অবস্থান এবং চাঁদ ও সূর্যের অভিকর্ষ বলের মাত্রা উপরে নির্ভর করে থাকে। সমুদ্র ছাড়াও উপসাগর, খাঁড়ি ও সমুদ্র জলে পুষ্ট নদীতেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

অর্থাৎ সূর্য ও চাঁদের আকর্ষণ বলের প্রভাবে প্রতিদিন একই স্থানে সমুদ্রের জলের নিয়মিত ছন্দময় উত্থান-পতনকে জোয়ার ভাটা হয়।

জোয়ার ভাটা সৃষ্টির কারণ

প্রধানত দুটি কারণে জোয়ার ভাটার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
• পৃথিবীর উপর চাঁদ এবং সূর্যের আকর্ষণ (মহাকর্ষ) বলের প্রভাব এবং
• পৃথিবীর ভরকেন্দ্রের পরিবর্তনের প্রবণতা।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

• পৃথিবীর উপর চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ বলের প্রভাব

মহাবিশ্বে সূর্য চাঁদ ও পৃথিবীর সবাই সবাইকে আকর্ষণ করে থাকে। সূর্যের তুলনায় চাঁদ যেহেতু পৃথিবীর কাছে অবস্থান করে, সেই কারণে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির ক্ষেত্রে চাঁদের আকর্ষণ বলই বেশি প্রভাবশালী হয়। পৃথিবীতে সূর্য অপেক্ষা চাঁদের আকর্ষণ বল প্রায় 2.2 গুণ বেশি কার্যকরী হয়। সূর্যের আকর্ষণেও পৃথিবীতে জোয়ার ভাটা হয়। কিন্তু চাঁদের আকর্ষণ বলের ফলে যে জোয়ার হয়, সেই তুলনায় এই জোয়ার যথেষ্ট দুর্বল হয়। যখন চাঁদ সূর্য পৃথিবী কেন্দ্র একই সরলরেখার উপর অবস্থান করে, তখন এর প্রভাবে পৃথিবীর জলভাগের তীব্র জোয়ারের সৃষ্টি হয়।


জোয়ার ভাটার ধারণা পর্বের আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে↓

• পৃথিবীর ভরকেন্দ্র পরিবর্তনের প্রবণতা

চাঁদের মহাকর্ষ টানের ফলে উৎপন্ন মুখ্য জোয়ারে পৃথিবীর অর্ধেক পরিমাণ জল চাঁদের দিকে সরে আসে; যার ফলে পৃথিবীর আকৃতি গত পরিবর্তন ঘটার একটি প্রবণতা তৈরি হয়। এই ঘটনার ফলস্বরূপ পৃথিবীর ভরকেন্দ্র (centre of mass) চাঁদের দিকে একটুখানি হলেও সরে যেতে চায়। কিন্তু পৃথিবীর আবর্তনের জন্য যে ভরবেগ তৈরি হয়, তা সংরক্ষণ করার জন্য (conservation of momentum) পৃথিবীর ভরকেন্দ্রকে একই বিন্দুতে স্থির থাকতে হয়। ফলে এই ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিপরীত দিকে যেটি চাঁদের সম্মুখে থাকে না, সেই দিকেও জল ফুলে-ফেঁপে ওঠে। এভাবে প্রতিবাত স্থানেও জোয়ারের সৃষ্টি হয়। একে গৌণ জোয়ার বলা হয়।

মুখ্য জোয়ার

পৃথিবীর যে অংশ চাঁদের সামনে থাকে, সেই অংশের চাঁদের আকর্ষণ বল সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলে এবং সেই অংশের জলস্তর ফুলে উঠে গিয়ে যে জোয়ারের সৃষ্টি করে, একে মুখ্য জোয়ার বা প্রত্যক্ষ জোয়ার বলা হয়।

গৌণ জোয়ার

পৃথিবীর যে অংশে মুখ্য জোয়ার হয়, তার প্রতিপাদ অংশের জলরাশি ফুলে ওঠে কিন্তু এক্ষেত্রে মুখ্য জোয়ারের মত এত তীব্র হয় না। এই অপেক্ষাকৃত দুর্বল জোয়ারকে গৌণ জোয়ার বা পরোক্ষ জোয়ার বলা হয়।

মুখ্য জোয়ার ও গৌণ জোয়ার অঞ্চলে জল সরবরাহ করার জন্য এই জোয়ার দুটির মধ্যবর্তী সমকৌণিক অঞ্চলের জলতল নেমে যায় এবং ভাটার সৃষ্টি হয়। একই স্থানে প্রত্যেকদিন দুইবার জোয়ার ও দুইবার ভাটা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কেবলমাত্র চাঁদের আকর্ষণে যে জোয়ার হয়, তাকে চান্দ্র জোয়ার এবং সূর্যের আকর্ষণে যে জোয়ার হয়, তাকে সৌর জোয়ার বলা হয়। সৌর জোয়ারের তেজ চান্দ্র জোয়ার অপেক্ষা কম হয়।

জোয়ার ভাটার সময়ের ব্যবধান: পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে একবার ঘুরতে (360°) সময় নেয় প্রায় 24 ঘন্টা। পৃথিবীকে একবার পরিক্রমণ করতে চাঁদের সময় লাগে প্রায় 27 দিন।
সুতরাং একদিনে কক্ষপথে প্রায় 13° (360°÷27 দিন) এগিয়ে যায়। তাই পরের দিন পৃথিবীর আকাশে চাঁদকে ওই একই অবস্থানে দেখতে পৃথিবীকে নিজের অক্ষের উপর একটি সম্পূর্ণ পাকের পরে আরো 13° বেশি ঘুরতে হয়। এই 13° অতিরিক্ত পথ অতিক্রম করতে পৃথিবীর সময় লাগে আরো 52 মিনিট (13°x 4 মিনিট)।

এই কারণে পৃথিবীর কোনো স্থানে একবার মুখ্য জোয়ার সংঘটিত হওয়ার 24 ঘন্টা 52 মিনিট পরে ওই স্থানে আবার মুখ্য জোয়ার আসে। সুতরাং মুখ্য জোয়ার ও গৌণ জোয়ারের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ধরা হয় 12 ঘন্টা 26 মিনিট এবং জোয়ার পরবর্তী ভাটার সময়ের ব্যবধান হয় 6 ঘন্টা 13 মিনিট।

সিজিগি অবস্থানে ভরা কোটাল

পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্যের কেন্দ্র যখন একই সরলরেখায় অবস্থান করে সেই অবস্থানকে সিজিগি (syzygy) বলা হয়। দু’রকম সিজিগি অবস্থান দেখা যায়। যখন পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চাঁদ অবস্থান করে এই সিজিগি অবস্থানকে সংযোগ (conjunction) বলা হয়। এই অবস্থানে অমাবস্যা হয়। আবার যখন চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে পৃথিবীর অবস্থান করে তখন সেই সিজিগি অবস্থানকে প্রতিযোগ (opposition) বলা হয়। এই অবস্থানে পূর্ণিমা হয়। সিজিগি অবস্থানে চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ টান বেশি হওয়ায় ভরা কোটাল হয়।

পূর্ণিমা তিথিতে (প্রতিযোগ) পৃথিবীর এক দিকে সূর্য এবং অপর দিকে চাঁদ অবস্থান করে; ফলে এদের আলাদা আলাদা আকর্ষণের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলরাশি ফুলে ওঠে এবং জোয়ারের সৃষ্টি করে।
অপরদিকে অমাবস্যা তিথিতে পৃথিবীর একই দিকে চাঁদ এবং সূর্য অবস্থান করে। এর ফলে উভয়ের মিলিত আকর্ষণ বলের ফলে সমুদ্রের জলরাশি ফুলে ওঠে এবং জোয়ারের সৃষ্টি হয়।

অর্থাৎ পরিক্রমণকাল অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে চাঁদ পৃথিবী ও সূর্যের এই অবস্থানের ফলে সমুদ্রে যে প্রবল জলস্ফীতি দেখা যায়, একেই বলা হয় ভরা কোটাল বার তেজ কোটাল (spring tide) বলা হয়।

মরা কোটাল

শুক্লপক্ষ এবং কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে চাঁদ এবং সূর্য পৃথিবীর সঙ্গে পরস্পর সমকোণে অবস্থান করে। এর ফলে চাঁদের আকর্ষণ বলের প্রভাবে পৃথিবীর যে অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলরাশির স্ফীতি ঘটে, তার সমকোণে অবস্থিত সূর্যের আকর্ষণের সমুদ্র পৃষ্ঠের জল ফুলে উঠতে চায়। কিন্তু চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ বল পরস্পর বিপরীতে কাজ করার ফলে কোনো অংশের সমুদ্রপৃষ্ঠ বিশেষ ফুলে উঠতে পারে না।
একে মরা জোয়ার মরা কোটাল (Neap tide) বলা হয়। এই জোয়ারে জোয়ারের সীমা সবথেকে কম থাকে এবং ভাটার সময়ে জলতল খুব বেশি নেমে যায় না।

অ্যাপোজি ও পেরিজি অবস্থান বা জোয়ার-ভাঁটায় পৃথিবীর উপবৃত্তাকার কক্ষপথের প্রভাব

চাঁদটা নিজের উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবীর পরিক্রমণ করে। চাঁদের এই উপবৃত্তাকার কক্ষপথ থাকার জন্য পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কখনো বাড়ে এবং কখনো কমে। পৃথিবী ও চাঁদের কেন্দ্রের মধ্যবর্তী দূরত্ব যখন সর্বাধিক হয় (4,05,800 কিমি), তখন সেই অবস্থাকে অ্যাপোজি বলা হয়। এই অবস্থানে জোয়ার দুর্বল হয়ে পড়ে। একে অপভু জোয়ার অ্যাপোজিয়ান জোয়ার বলা হয়।

আবার পৃথিবীর পরিক্রমণের সময় চাঁদ থেকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দূরত্ব যখন সর্বনিম্ন হয় (3,75,000কিমি), তখন তাকে বলা হয় পেরিজি। এই অবস্থানে জোয়ার অত্যন্ত শক্তিশালী হয়; এই অবস্থানের জোয়ারকে অনুভু জোয়ার বা পেরিজিয়ান জোয়ার বলা হয়।

পেরিজি অবস্থানের সাথে সিজিগি অবস্থান একসাথে ঘটলে সেই ভরা কোটাল অত্যন্ত প্রবল হয়। পেরিজির সঙ্গে সিজিগির এই মিলনকে প্রক্সিজিয়ান বলা হয়। এই ঘটনা প্রতি দেড় বছর অন্তর ঘটে থাকে। চাঁদ ও সূর্যের আপাত ভ্রমণকালে নিরক্ষরেখার উপরে সিজিজি অবস্থান করলে যে ভরা কোটাল হয়, তা প্রবলতম হয়। এই ঘটনা প্রতি 1600 বছর অন্তর ঘটে।

বানডাকা

ভরা কোটালের সময় যখন সমুদ্রের জল প্রবল জলোচ্ছ্বাস ঘটিয়ে দ্রুত গতিতে নদী খাতের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন ভাটার স্রোত এবং নদীর দুই পাড়ে বাধা পেয়ে জোয়ারের জল আরো বেশি ফুলে ওঠে, যা জলের একটি খাড়া দেয়াল তৈরি করে। নদীতে সৃষ্ট এই অতিমাত্রার জলস্ফীতি এবং উঁচু ঢেউ জোয়ারী বান নামে পরিচিত। এই তীব্র জলোচ্ছ্বাস দূর থেকে গর্জনের মতো শোনা যায়, এই কারণে একে বানডাকা বলা হয়।

উদাহরণ – ভাগীরথী ও হুগলি আমাজন প্রভৃতি নদীতে বান দেখা যায়। আমাজন নদীতে বানকে স্থানীয় ভাষায় প্রকাশ বলা হয় পোরোরোকাস।

[বর্ষাকালে ভাগীরথী হুগলি নদীতে প্রচুর জল সংযোজনের ফলে বানের সৃষ্টি হয়। ভরা কোটালের সময় এই বান সৃষ্টির পরিস্থিতির জলোচ্ছ্বাসকে তেজী স্যারের যুদ্ধরত অবস্থার সাথে তুলনা করা হয়, যাকে ষাঁড়াষাঁড়ির বান বলা হয়।]

বান সৃষ্টির কতগুলি পূর্বনির্ধারিত শর্ত আছে। শর্তগুলো হল –
জোয়ার ও ভাটার মধ্যে জলের উচ্চতা তারতম্য কমপক্ষে 6 মিটার হওয়া দরকার।
নদীর মোহনা অংশ বিস্তৃত ও অগভীর হতে হবে। উচ্চপ্রবাহে নদীর খাত ক্রমশ সংকীর্ণতর হওয়া দরকার।
সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস এবং সুদীর্ঘ সময় ধরে নদীতে তীব্র ভাটার টান উপস্থিত থাকা দরকার।
জোয়ারের সময় জলস্রোত সমুদ্রমূখী হওয়া দরকার।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

জোয়ার ভাটার ফলাফল

ইতিবাচক ফলাফল
  • জোয়ারের সময় অগভীর নদী গুলিতে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ফলে নৌ চলাচলের সুবিধা হয়।
  • জোয়ার ভাটার ফলে নদীখাত বর্জ্য আবর্জনা মুক্ত হয় এবং ভাটার টানে নদীর মধ্যস্থ আবর্জনা সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়। এর ফলে নদী খাতের গভীরতা বাড়ে।
  • শীতপ্রধান অঞ্চলে অতিরিক্ত ঠান্ডাতেও নদীর জল বরফে পরিণত হয় না, জোয়ারের লবণাক্ত জলের প্রভাবে।
  • জোয়ার ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
  • জোয়ার ভাটার সময় সমুদ্রের মাছ নদীতে চলে আসে এবং জেলেরা সেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।

নেতিবাচক ফলাফল
  • জোয়ার ভাটার ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত জল নদীর স্বাদু জলের সাথে মিশে গেলে নদীর জল সেচের অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং সেই জল পানীয় জল হিসেবেও গ্রহণ করা যায় না।
  • জোয়ারের ফলে নদী মোহনার পলি রাশি সমুদ্র সংলগ্ন নদীতে গিয়ে জমা হলে নদীর গভীরতা ও নাব্যতা কমে যায়।
  • প্রবল জোয়ারের বেগের ফলে নৌকা, লঞ্চ ও ছোট ছোট জাহাজের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বর্জ্যের ধারণা এবং পরিবেশের উপর প্রভাব


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-geo-3-c