ভূগোল – দশম শ্রেণি – বায়ুমণ্ডল (সপ্তম পর্ব)
আগের পর্বে আমরা বিশ্ব উষ্ণায়ন ও গ্রিন হাউস গ্যাস সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা বায়ুচাপের ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
বায়ুর ওজন আছে তাই বায়ুর চাপ আছে বায়ুর ওজন জনিত চাপকেই বায়ুমন্ডলীয় চাপ বা বায়ুচাপ বলা হয়।
অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট স্থানের একক ক্ষেত্রফল অর্থাৎ এক বর্গমিটারের উপরে লম্বভাবে বায়ুমন্ডলের ওজনের জন্য যে চাপ প্রয়োগ করে থাকে, তাকে সেই অঞ্চলের বায়ুচাপ বলা হয়।
বায়ুর চাপ মূলত দুই ধরনের হতে পারে উচ্চচাপ ও নিম্নচাপ।
বায়ু যখন উত্তপ্ত হয় তখন প্রসারিত হয় এবং হালকা হয়ে পড়ে ফলে বাতাসের ঘনত্ব ও ওজন কমে যায়। এই বাতাস হালকা হয়ে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে উঠে যায়। যার ফলে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে যখন তাপমাত্রা কমে যায় তখন বাতাস ভারী ও শীতল হয়ে পড়ে ফলে বাতাসের ঘনত্ব ও ওজন বেড়ে যায় ও ভূপৃষ্ঠের উপর বায়ুর চাপ বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থাকে বায়ুর উচ্চচাপ বলা হয়।
বায়ুর চাপের বৈশিষ্ট্য
পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চলে বায়ুমণ্ডলীয় চাপের পরিমাণ সমান হয় না।
বায়ুর উষ্ণতা বাড়লে বায়ুর চাপ কমে যায় এবং উষ্ণতা কমলে বায়ুর চাপ বেড়ে যায়।
ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন অঞ্চলে বায়ুর চাপ বেশী হয় আবার ভূপৃষ্ঠ থেকে বেশি উচ্চতায় বায়ুর চাপ কম হয়। এই কারণে সমতল অঞ্চলে বায়ুর ঘনত্ব বেশি হলে বায়ুর চাপ বেশী এবং পাহাড়ি অঞ্চলে বায়ুর ঘনত্ব কম হওয়ার জন্য বায়ুর চাপ কম হয়।
বায়ুচাপের পরিমাপ
বায়ুর চাপকে পারদের উচ্চতার সাথে তুলনা করে মাপা হয়। মেট্রিক পদ্ধতিতে বায়ুর চাপ মাপার যন্ত্রের পারদের উচ্চতা মাপা হয় সেন্টিমিটারের। খুব সামান্য চাপের পরিবর্তনেই বায়ুমন্ডলে অত্যন্ত বেশি প্রভাব ফেলে। তাই বায়ুমণ্ডলের এই সামান্য পরিবর্তনকে বোঝার জন্য বায়ুর চাপকে প্রকাশ করা হয় মিলিবারে।
বায়ুর চাপের পরিমাপের একক হল মিলিবার।
বায়ুচাপকে প্রতি বর্গ কিমিতে 1000 ডাইন বলের সমান ধরা হয়। 45° অক্ষাংশে সমুদ্র পৃষ্ঠে 0° সেন্টিগ্রেড উষ্ণতায় প্রাপ্ত 1013.25 মিলিবারকে প্রমাণ বায়ুমন্ডলীয় চাপ বা 1 বায়ুমন্ডলীয় চাপ বলা হয়। এই চাপ 76 সেন্টিমিটার বা 760 মিলিমিটার 29.92 ইঞ্চি পারদ স্তম্ভের চাপের সমান হয়।
বায়ুর চাপ পরিমাপক যন্ত্র
বায়ুর চাপ পরিমাপক যন্ত্রের নাম হল ব্যারোমিটার।
বিভিন্ন ধরনের ব্যারোমিটার পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
টরিসেলি ব্যারোমিটার
1643 খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানী টরিসেলি প্রথম এই ব্যারোমিটার যন্ত্রের আবিষ্কার করেন।
অ্যানিরয়েড ব্যারোমিটার
এই ব্যারোমিটারের আয়তন ছোট এবং সহজে সব জায়গায় ব্যবহার করা যায়। এই যন্ত্রের সঙ্গে উচ্চতা ও বায়ুর চাপ মাপা যায়।
ফর্টিন ব্যারোমিটার
এই ব্যারোমিটারে পারদ স্তম্ভের উচ্চতা সহজেই নিখুঁত ভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয়। এটি একটি বহুল প্রচলিত ব্যারোমিটার।
বিভিন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্র সমূহ
বিমানে উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে চাপের দ্রুত পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনকে পরিমাপ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে, অলটিমিটার, ব্যরোগ্রাফ এবং মাইক্রো ব্যারোগ্রাফ।
বায়ুচাপের তারতম্যের নিয়ন্ত্রক
বায়ুর চাপ ভূপৃষ্ঠের উপরে আনুভূমিক এবং উল্লম্বভাবে বন্টিত থাকে।পৃথিবীর সর্বত্র বায়ুর চাপ সমান হয় না। কোথাও উচ্চচাপ ও নিম্নচাপ অবস্থান করে। বায়ুচাপের তারতম্যের নিয়ন্ত্রক গুলি নিম্নে আলোচিত হল।
• উচ্চতা
পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের সংলগ্ন অঞ্চলে বায়ুর ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি থাকে। কারণ বায়ুমণ্ডলের প্রায় 99% ভূপৃষ্ঠের 32 কিমি মধ্যে অবস্থান করে। বায়ুমন্ডলের মোট ভর এর 50% ভূপৃষ্ঠ থেকে 5500 মিটারের মধ্যে অবস্থান করে তাই বায়ুমণ্ডলের নিচের দিকে চাপ সবথেকে বেশি হয়। উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে বায়ুর চাপ কমতে থাকে। এই কারণে সমভূমি অঞ্চলে বায়ুর চাপ পার্বত্য অঞ্চলের বায়ু অপেক্ষা বেশি হয়।
• উষ্ণতা
আমরা জানি যে উষ্ণতার বৃদ্ধির সাথে সাথে বায়ুর ঘনত্ব হ্রাস পায়। উষ্ণতা বাড়লে বায়ু প্রসারিত হয় এবং হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠে যায় ফলে সেই অঞ্চলে বায়ুর নিম্নচাপ দেখা যায়। আবার উষ্ণতা কমলে বায়ুর ঘনত্ব বেড়ে যায় সংকুচিত হয় এবং ভারী হয়ে নিচের দিকে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন অঞ্চলে নেমে আসে যাকে বায়ুর উচ্চচাপ বলা হয়। এইজন্যেই গ্রীষ্মকালে ভারতে গভীর নিম্নচাপ অবস্থান করে আবার অপরদিকে শীতকালে উত্তর ভারতে উচ্চ চাপের অবস্থান দেখা যায়।
• জলীয় বাষ্প
চরিত্রগত দিক থেকে জলীয়বাষ্প উষ্ণ এবং হালকা হয়। যখন বায়ুতে প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প অবস্থান করে তখন সেই বায়ু হালকা হয় এবং উপরের দিকে উঠে যায় ফলে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। যেমন জলীয় বাষ্পপূর্ণ মৌসুমী বায়ু প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প বহন করায় নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়।
• পৃথিবীর আবর্তন
পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে যে কেন্দ্র বহির্মুখী (centrifugal force) বলের সৃষ্টি হয়, তার ফলে বায়ুর গতিবিক্ষেপ ঘটে থাকে। এই কারণে নিরক্ষীয় অঞ্চলে আবর্তনের বেগ বেশি থাকায় সেখানে স্থায়ী নিম্নচাপ বলয় সৃষ্টি হয়। আবার মেরু অঞ্চলে আবর্তনের বেগ কম থাকায় এখানে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
• পৃথিবীতে স্থলভাগের জলভাগের বন্টন
স্থলভাগ জলভাগ ভৌত চরিত্রের দিক থেকে ভিন্ন হওয়ার জন্য বায়ুর চাপের তারতম্য ঘটাতে সাহায্য করে। দিনের বেলা জলভাগ স্থলভাগ তাড়াতাড়ি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে ফলে স্থলভাগের সংলগ্ন বায়ু সহজে উত্তপ্ত ও হালকা হয়ে নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। রাতের বেলা স্থলভাগ আবার দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়ে পড়ে ফলে স্থলভাগ সংলগ্ন বায়ু ভারী হয়ে উচ্চচাপের সৃষ্টি করে। কিন্তু সেই অনুপাতে রাতের বেলা জলভাগ বেশি গরম থাকায় জলভাগ সংলগ্ন বায়ু হালকা হয় এবং নিম্নচাপের সৃষ্টি করে।
সমচাপ রেখা এবং চাপ ঢাল
ভূপৃষ্ঠের সমান বায়ুমন্ডলীয় চাপ যুক্ত অঞ্চলগুলোকে যে কাল্পনিক রেখা দ্বারা সংযোগ করা হয়, তাকেই সমচাপ রেখা বা সমপ্রেস রেখা বলা হয়।
যেহেতু বায়ুর চাপ উঁচু অঞ্চলে কম হয় সেই কারণে উঁচু অঞ্চলগুলির বায়ুর চাপকে সমুদ্রতলের চাপে পরিণত করে মানচিত্রে সমচাপ রেখা আঁকা হয়। সমুদ্রতলের সাপেক্ষে ভূপৃষ্ঠের সমান চাপ যুক্ত স্থানগুলোকে যে কাল্পনিক রেখা দ্বারা সংযুক্ত করা হয়, তাকে সমচাপ রেখা বলা হয়। সমচাপ রেখার মাধ্যমে বায়ুর চাপ ঢাল বা Pressure Gradient এর প্রকৃতি জানা যায়।
সমচাপ রেখা এবং চাপ ঢালের বৈশিষ্ট্য
সমচাপ রেখা গুলি মানচিত্রে সমোষ্ণ রেখার সমান্তরালে অবস্থান করে।
দীর্ঘকায় নিম্নচাপ অঞ্চল গুলিকে ‘ট্রাফ’ (Trough) ও দীর্ঘকায় উচ্চচাপ অঞ্চলগুলিকে বলা হয় রিজ (Ridge)।
সমচাপরেখা চক্রাকারে অবস্থান করলে তাকে কোষ বা cell বলা হয়।
কোন স্থানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে সেখানে সমচাপ রেখা গুলি বৃত্তাকার একে অপরের সমান্তরালে অবস্থান করে।
আবহাওয়া মানচিত্রে নিম্নচাপের তীব্রতা বোঝাতে কোষগুলির মধ্যে L, D, DD, WML প্রভৃতি লেখা থাকে।
সমচাপ রেখার গুরুত্ত্ব
আবহাওয়া মানচিত্রে এই সমচাপ রেখাগুলির অবস্থান এবং গতিপ্রকৃতি দেখেই আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন।
সমচাপ রেখা যখন একসাথে চক্রাকারে অবস্থান করে তা প্রবল ঝড় বৃষ্টির সংকেত দেয়। সমচাপ রেখাগুলি যখন দূরে দূরে অবস্থান করে তখন তা শান্ত আবহাওয়া এবং যখন সমচাপ রেখাগুলো কাছাকাছি অবস্থান করে, তখন তা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সংকেত প্রদান করে।
চাপ ঢাল
ভূপৃষ্ঠে এক আনুভূমিক তলে অবস্থিত দুটি স্থানের মধ্যে বায়ুর চাপের পরিবর্তন সাধারণত বায়ু চাপের ঢাল বা Pressure gradient বলা হয়।
অন্যভাবে বললে উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে প্রতি একক দূরত্বে বায়ুচাপের যে পার্থক্য হয়, তাকেই বায়ুচাপের ঢাল বা ব্যারোমেট্রিক ঢাল বলা হয়।
চাপ ঢালের বৈশিষ্ট্য
চাপ ঢাল যদি খাড়া হয় তাহলে বায়ুর গতিবেগ বাড়ে এবং চাপ ঢাল খাড়া না হলে বায়ুমণ্ডলের গতিবেগ কমতে থাকে।
মানচিত্রে সমচাপ রেখাগুলি যদি খুব কাছাকাছি অবস্থান করে তাহলে বায়ুচাপের ঢাল খুব বেশি হয়।
সমচাপ রেখাগুলি পরস্পরের থেকে দূরে অবস্থান করলে বুঝতে হবে বায়ুচাপের ঢাল কম।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → নিয়ত বায়ু ও সাময়িক বায়ুর ধারণা
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-geo-2-g