অভিব্যক্তির মতবাদ স্বপক্ষে প্রমাণ
Madhyamik

অভিব্যক্তির মতবাদ স্বপক্ষে প্রমাণ

জীবনবিজ্ঞানদশম শ্রেণি – অভিব্যক্তি [Abhivyakti]

আগের পর্বে আমরা অভিব্যক্তি ও অভিব্যক্তির মতবাদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা অভিব্যক্তির মতবাদ স্বপক্ষে প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করবো।

জীবাশ্ম ঘটিত প্রমাণ

বর্তমানে অবলুপ্ত জীবের সমগ্র দেহ বা দেহাংশ যখন মাটির নীচের শিলাস্তরে বহু বছর ধরে প্রাকৃতিক উপায়ে আংশিক প্রস্তরীভূত অবস্থায় সংরক্ষিত থাকে, তখন তাকে জীবাশ্ম (Fossil) বলে।

ঘোড়ার জীবাশ্ম ঘটিত প্রমাণ

ঘোড়ার জীবাশ্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আধুনিক ঘোড়ার (ইকুয়াস) বিভিন্ন পূর্বপুরুষদের বিবর্তনের সব কটি জীবাশ্মই আবিষ্কৃত হয়েছে। যা থেকে আধুনিক ঘোড়ার বিবর্তনের ইতিহাস পরিস্কার করে বোঝা যায়।

আধুনিক ঘোড়া ইকুয়াস (Equus sp) সৃষ্টি হয়েছে ইওসিন যুগের ইওহিপ্পাস (Eohippus) থেকে। ঘোড়ার বিবর্তনের যে মূল পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করা যায় –

  • দেহের আকার ও উচ্চতা বৃদ্ধি পেল।
  • অগ্র ও পশ্চাৎ পদের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেল। মেটাকারপেল ও মেটাটারসেল অস্থি বৃদ্ধি পেল
  • গ্রীবা এবং মস্তিষ্কের আকার প্রসারিত হল।
  • মস্তিষ্কের আয়তন এবং জটিলতা বৃদ্ধি পেল।
  • আঙ্গুলের সংখ্যা হ্রাস পেল এবং মাঝের আঙ্গুলের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি হল। মাঝের আঙুল ক্ষুরে পরিণত হল।
  • মোলার দাঁত উন্নত ক্রাউন যুক্ত হল ও দাঁত আরও চওড়া হল।

জীবন্ত জীবাশ্ম

যে সমস্ত জীব প্রাচীনকালে উৎপত্তি লাভ করলেও কোন রকম পরিবর্তন ছাড়াই বর্তমানে পৃথিবীতে বেঁচে আছে অথচ তাদের সমসাময়িক সমস্ত জীবেদের অবলুপ্তি ঘটেছে, তাদের বলা হয় জীবন্ত জীবাশ্ম।
যেমন – প্রাণীদের মধ্যে সিলাকান্থ (মাছ), স্ফেনোডন (সরীসৃপ) ইত্যাদি।


দশম শ্রেণির অন্যান্য বিভাগগুলি পড়ুন –ভৌতবিজ্ঞান | গণিত | জীবনবিজ্ঞান

তুলনামূলক শারীরস্থানিক প্রমাণ

বিভিন্ন জীবের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের গঠনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য মূলক আলোচনাই হল তুলনামূলক শারীরস্থানিক আলোচনা। এখানে আমরা যে সমস্ত শারীরস্থান সম্পর্কে জানবো সেগুলি হল – সমসংস্থ অঙ্গ, সমবৃত্তীয় অঙ্গ, নিষ্ক্রিয় অঙ্গ এবং মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের গঠন।

ক) সমসংস্থ অঙ্গ (Homologous Organs)

‘সমসংস্থ’ কথাটির অর্থ হল সমান সংস্থান অর্থাৎ অবস্থান বা গঠন। যে সমস্ত অঙ্গগুলি উৎপত্তিগত ও গঠনগতভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও কার্যগত দিক দিয়ে ভিন্ন হয়, তাদের বলে সমসংস্থ অঙ্গ। যেমন – বাদুড়ের ডানা ও তিমির ফ্লিপার, ঘোড়ার অগ্রপদ ও মানুষের হাত হল সমসংস্থ অঙ্গ।

খ) সমবৃত্তীয় অঙ্গ (Analogous Organs)

‘সমবৃত্তীয়’ কথার অর্থ সমান বৃত্তি অর্থাৎ কাজ। যে সমস্ত অঙ্গগুলি কার্যগতভাবে এক হলেও উৎপত্তি ও গঠনগতভাবে আলাদা হয়, তাদের বলে সমবৃত্তীয় অঙ্গ।

যেমন – পতঙ্গ ও বাদুড়ের ডানা। পতঙ্গ ও বাদুড়ের ডানা এদের উভয়কে উড়তে সাহায্য করলেও তাদের প্রত্যেকের ডানার বহিরাকৃতি ও অভ্যন্তরীণ গঠনের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পতঙ্গের ডানা হল কিউটিকলের প্রসারিত অংশ, বাদুড়ের ক্ষেত্রে তা হল অগ্রপদ, যেটি প্যাটাজিয়াম দিয়ে ঢাকা থাকে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

গ) নিষ্ক্রিয় অঙ্গ (Vestigial Organs)

যে সব অঙ্গগুলি আমাদের পূর্বপুরুষদের দেহে সক্রিয় থাকলেও ক্রমশ বিবর্তনের ফলে বর্তমানে তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের অঙ্গে পরিণত হয়েছে, তাদের বলে নিষ্ক্রিয় অঙ্গ।

i) মানুষের ক্ষেত্রে অ্যাপেনডিক্স – এটি ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্রের সংযোগস্থলে অবস্থিত একটি ছোট্ট প্রবর্ধকের মত অংশ। এই অঙ্গটি মানুষের শরীরে কোনো রকম কাজ না করলেও গিনিপিগ, ঘোড়া প্রভৃতি প্রাণীদের ক্ষেত্রে আকারে যথেষ্ট বড় এবং সক্রিয় হয়।

ii) মানুষের ক্ষেত্রে লেজ – বানরের ক্ষেত্রে লেজ সক্রিয় অঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও মানুষের ক্ষেত্রে তা কক্সিসে রূপান্তরিত হয়েছে। আদিম যুগের মানুষ গাছে থাকত, তাই তাদের লেজের প্রয়োজন হতো। কিন্তু এখন সভ্য মানুষেরা গৃহে বসবাস করে তাই তাদের ক্ষেত্রে লেজের কোন রকম প্রয়োজন হয় না বলে বানরের লেজের সক্রিয় হাড় মানুষের ক্ষেত্রে মেরুদন্ডের শেষপ্রান্তে অবস্থিত নিষ্ক্রিয় কক্সিসে পরিণত হয়েছে।

iii) পাখির সক্রিয় ডানা – উটপাখি, এমু, কিউই প্রভৃতি পাখির ক্ষেত্রে সক্রিয় ডানা নিস্ক্রিয় ডানায় রূপান্তরিত হয়েছে। তাই এরা দৌড়তে পারলেও উড়তে পারে না।

ঘ) মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের গঠন

বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের মধ্যে গঠনগত মিল লক্ষ্য করা যায়, যা অভিব্যক্তির প্রমাণে সাহায্য করে। মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের গঠন দেখলে বোঝা যাবে, প্রাথমিক ও সরল হৃদপিন্ড থেকে ক্রমশ জটিল ও জটিলতর হৃদপিন্ডের সৃষ্টি হয়েছে।

মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের গঠনে অভিব্যক্তির গুরুত্ব

মেরুদন্ডী প্রাণীদের হৃদপিন্ডের গঠন থেকে বোঝা যায় যে, হৃদপিন্ডের মৌলিক গঠন একই রকমের হলেও সময়ের সাথে সাথে তা ক্রমশ জটিল হয়েছে। হৃদপিন্ডের গঠনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সমস্ত মেরুদন্ডী প্রাণীদের পৃথিবীতে আগমনের পর্যায়ক্রম বোঝা যায়। প্রথমে মাছ, তার থেকে উভচর, উভচর থেকে সরীসৃপ এবং সবশেষে সরীসৃপ থেকে পক্ষী ও স্তন্যপায়ী জীবের উৎপত্তি হয়েছে।

তুলনামূলক ভ্রূণতত্ত্ব

জীব-বিজ্ঞানের যে শাখায় বিভিন্ন প্রাণীর ভ্রূণের বিকাশ ও তাদের গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়, তাকে তুলনামূলক ভ্রুণতত্ত্ব বলে। বিভিন্ন প্রাণীর ভ্রূণের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে বিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রাণী যেমন – মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পক্ষী ও স্তন্যপায়ীদের ভ্রূণের বিকাশের অনেক সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। যা প্রমাণ করে এই সমস্ত প্রাণীগুলোর উৎপত্তি একই পূর্বপুরুষ থেকে ঘটেছে।

পুনরাবৃত্তি তত্ত্ব বা বায়োজেনেটিক সূত্র

প্রথমে ভন বিয়ার এই তত্ত্বটি প্রবর্তন করেন এবং পরবর্তীকালে হেকেল এটিকে পরিবর্তিত করে বায়োজেনেটিক সূত্র নামে উপস্থাপন করেন। এই তত্ত্বের মূল কথা হল ‘ব্যক্তিজনি জাতিজনিকে পুনরাবৃত্তি করে’ (ontogeny repeats phylogeny)। ব্যক্তিজনি (ontogeny) কথার অর্থ হল কোনো জীবের জীবনের ইতিহাস এবং জাতিজনি (phylogeny) কথার অর্থ হল জীবের জাতির বিবর্তনের ইতিহাস। বিবর্তনের ইতিহাস অনুযায়ী মাছ, উভচর, সরীসৃপ ও পক্ষীর থেকে মানুষের উৎপত্তি ঘটেছে। তাই মানুষের ভ্রূণের সাথে মাছ, উভচর, সরীসৃপ ও পক্ষীর ভ্রূণের যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় কখনোই এই সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় না।

‘ব্যক্তিজনি জাতিজনিকে পুনরাবৃত্তি করে’ বলতে বোঝায় সমস্ত মেরুদন্ডী প্রাণীরা ভ্রূণাবস্থায় তাদের বিবর্তনের ইতিহাসকে পরিলক্ষিত করে অর্থাৎ ভ্রূণাবস্থায় মাছ, উভচর, সরীসৃপ ও পক্ষীর ভ্রূণের সাথে মানুষের ভ্রূণের এক অস্বাভাবিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। যা প্রমাণ করে মানুষ এই সমস্ত প্রাণীদের থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → অভিযোজন


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।

JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-Lsc-4b