ভূগোল – দশম শ্রেণি – ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ (পঞ্চম পর্ব)
আগের পর্বে আমরা ভারতীয় কৃষি ও সবুজ বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা ভারতীয় শিল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ভারতীয় শিল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓
শিল্প কাকে বলে?
যে পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো বস্তু বা কাঁচামালকে রুপান্তরের মাধ্যমে আরও কার্যকরী ও উপযোগী করে তোলা হয়, সেই উৎপাদন পদ্ধতিকে শিল্প বলা হয়।
বর্তমানে উন্নতিশীল দেশগুলির মধ্যে শিল্প ব্যবস্থায় ভারত অষ্টম স্থানে রয়েছে।
এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় শিল্পোন্নত দেশ।
ভারতে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলির মধ্যে – ১) কার্পাস বয়ন শিল্প ও পাট শিল্প, ২) লৌহ ইস্পাত শিল্প,৩) ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প এবং ৪) পেট্রো-রাসায়নিক শিল্প অন্যতম।
শিল্পের অনুকূল পরিবেশ থাকায় ভারতে গড়ে ওঠা এই উল্লেখযোগ্য শিল্পগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল।
১) বয়ন শিল্প
সাধারণত যে শিল্পে কার্পাস, পাট, রেশম, পশম প্রভৃতি তন্তু বা সুতো বুনে বস্ত্র এবং নানান সামগ্রী তৈরি করা হয়, তাকে বয়ন শিল্প বলে। এগুলির মধ্যে ভারতে কার্পাস বয়ন শিল্প ও পাট শিল্পের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
কার্পাস বয়ন শিল্প
এটি ভারতের একক বৃহত্তম শিল্প। ভারতে প্রতিবছর যে পরিমাণ শিল্পজাত দ্রব্য উৎপন্ন হয় তার প্রায় ২৫% বয়ন শিল্পজাত। বর্তমানে ভারতের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ১৪% আসে বয়ন শিল্প থেকে। ভারতে মোট শিল্প শ্রমিকের এক তৃতীয়াংশ এই শিল্পে নিযুক্ত। দেশের বহু মানুষ তুলো উৎপাদন, বস্ত্র ব্যবসা এবং কার্পাস বয়ন কারখানার সাথে যুক্ত রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতিতে কার্পাস বয়ন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে।
ভারতে কার্পাস বয়ন শিল্প কারখানাগুলি মোট চারটি অঞ্চলে রয়েছে। যথাক্রমে –
১) পশ্চিমাঞ্চল
দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষত মহারাষ্ট্র ও গুজরাত রাজ্যে এই শিল্পের ব্যাপকহারে প্রসার হয়েছে। মহারাষ্ট্রের মুম্বাই, পুনে, নাগপুর, শোলাপুর এবং গুজরাতের আমেদাবাদ, সুরাট, ভাদোদারা, রাজকোট প্রভৃতি স্থানে অসংখ্য কার্পাস বয়ন কারখানা গড়ে উঠেছে।
২) দক্ষিণাঞ্চল
দাক্ষিণাত্যে তামিলনাডু, কেরালা, কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশ বস্ত্রশিল্পে বেশ উন্নত। তামিলনাডুর কোয়েম্বাটুর, মাদুরাই, সালেম, চেন্নাই, তিরুচিরাপল্লি, মহীশুর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য বয়ন কেন্দ্র।
৩) উত্তরাঞ্চল
উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও রাজস্থান এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। কানপুর, দিল্লি, অমৃতসর, লুধিয়ানা, আগ্রা প্রভৃতি এখানকার বস্ত্রশিল্প কেন্দ্র।
৪) পূর্বাঞ্চল
পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা প্রভৃতি রাজ্যে বেশ কিছু কাপরেরকল রয়েছে, সবচেয়ে বেশি কাপড়ের কল আছে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী শিল্পাঞ্চলে। কলকাতার আশেপাশে সোদপুর, বেলঘরিয়া, শ্যামনগর, ঘুষুড়ি, সালকিয়া, শ্রীরামপুর প্রভৃতি এখানকার বয়ন শিল্পকেন্দ্র।
পাট শিল্প
ভারতে গুরুত্বপূর্ণ কৃষিভিত্তিক অর্থকরী শিল্প হল পাট শিল্প। পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ভারত প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। বর্তমানে প্রায় ৩ লক্ষ শ্রমিক পাট শিল্পের সাথে জড়িত। পাটজাত দ্রব্য রপ্তানিতে ভারত দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।
ভারতে পাট শিল্পের অবস্থান – বর্তমানে সারা দেশে মোট ৭৭টি পাটকল চালু রয়েছে।
১. পশ্চিমবঙ্গে হুগলী নদীর উভয় তীরে প্রায় ৬০টি পাটকল কেন্দ্র রয়েছে।
২. অন্ধ্রপ্রদেশে মোট ৭টি পাটকল রয়েছে।
৩. বিহারের কাটিহার, পূর্ণিয়া ও গয়ায় মোট ৪টি কেন্দ্র রয়েছে।
৪. উত্তরপ্রদেশে মোট ৩টি পাটকল রয়েছে। এছাড়া অসম, ত্রিপুরা, ছত্তিশগড় ও ওড়িশায় ১টি করে পাটকল কেন্দ্র রয়েছে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
লৌহ-ইস্পাত শিল্প
ভারতের মত উন্নতিশীল দেশে লৌহ-ইস্পাত শিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লোহা ও ইস্পাত ব্যবহার করে, বড়ো সেতু, দেশের সব রেলপথ, রেলগাড়ি, জাহাজ, ট্রাক্টর, ট্রাক ইত্যাদি পরিবহণ ও বিভিন্ন শিল্পের যন্ত্রপাতি তৈরি হয়। অন্যান্য সহকারী শিল্প যেমন – রেল ইঞ্জিন নির্মাণ, মোটরগাড়ি নির্মাণ, জাহাজ নির্মাণ, যন্ত্রপাতি নির্মাণ সবই গড়ে উঠেছে লৌহ-ইস্পাত শিল্পকে কেন্দ্র করে।
ভারতে লোহা-ইস্পাত কারখানার অবস্থান – ভারতে তিন ধরণের লোহা-ইস্পাত কারখানা দেখা যায়।
ক) বৃহদায়তন লোহা-ইস্পাত কারখানা
বোকারো স্টিল লিমিটেড (B.S.L), দুর্গাপুর, রাউরকেল্লা ও ভিলাইয়ের হিন্দুস্তান স্টিল লিমিটেড (H.S.L), জামশেদপুরের টাটা আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানি (TISCO), কুলটি বার্নপুরের ইন্ডিয়ান আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানি (IISCO) প্রভৃতি বৃহদায়তন কারখানাগুলি বিখ্যাত।
খ) মিশ্র ইস্পাত কারখানা
বর্তমানে সরকারি নিয়ন্ত্রণে তিনটি বড় মিশ্র ইস্পাত কারখানা রয়েছে। কর্ণাটকের ভদ্রাবতী, তামিলনাডুর সালেম এবং পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে কারখানাগুলি অবস্থিত।
গ) ছোট লোহা-ইস্পাত কারখানা
স্পঞ্জ আয়রন, ক্ষুদ্র স্টিলজাত দ্রব্য এখানে উৎপন্ন হয়। দেশে বিভিন্ন প্রান্তে এইরকম ২২০টি কারখানা আছে।
ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প
যে সব শিল্পে লোহা, ইস্পাত এবং অন্যান্য ধাতু ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার যন্ত্রপাতি, কলকব্জা ও নানান ইস্পাতজাত দ্রব্য তৈরি হয় এবং যেগুলি প্রস্তুত করতে বিশেষ কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন হয় তাদের একত্রে ইঞ্জিনিয়ারিং বা কারিগরি শিল্প বলে। আলপিন থেকে শুরু করে ছোট যন্ত্রপাতি, খনি ও কৃষি যন্ত্রপাতি, জাহাজ, বিমানপোত, রেল ইঞ্জিন, ওয়াগন ও কোচ নির্মাণ, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি প্রভৃতি ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের অন্তর্গত।
যন্ত্রপাতির আকৃতি, ওজন ও আয়তন অনুসারে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকে দুইভাগে ভাগ করা যায় – ক) হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প এবং খ) ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প।
ভারতে কয়েকটি হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের নাম ও তাদের অবস্থান
I. ১৯৪১ সালে মুম্বাইতে স্থাপিত হয় বয়ন শিল্পের যন্ত্রাংশ নির্মাণ শিল্পকেন্দ্র TEXMACO বা Textile Machinery Corporation Ltd.
II. পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুরে অবস্থিত National Instruments Ltd.
III. Hindustan Machine Tools (H.M.T) এর কারখানা রয়েছে ব্যাঙ্গালোর, শ্রীনগর ও হায়দ্রাবাদে।
IV. বর্তমানে ভারতের ৬০% বেশি হালকা ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি তৈরি হয় ব্যাঙ্গালোরের Indian Telephone Industries (ITI) ও Bharat Electronic Ltd (BEL) কারখানা দুটিতে।
ভারতে অবস্থিত ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প কেন্দ্রগুলির নাম ও তাদের অবস্থান
I. অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে অবস্থিত হিন্দুস্থান শিপইয়ার্ড লিমিটেড হল ভারতের বৃহত্তম জাহাজ নির্মাণ কারখানা।
II. কলকাতার গার্ডেনরিচে অবস্থিত গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড।
III. হিন্দুস্তান এয়ারোনটিকস লিমিটেড নামক সংস্থার অধীনে ভারতে বেশ কিছু বিমানপোত নির্মাণ কেন্দ্র রয়েছে।
IV. সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা দুটি রেল ইঞ্জিন তৈরির কারখানা হল – চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস ও বারানসীর ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কস। এছাড়া জামশেদপুরের টাটা ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড লোকোমোটিভ ওয়ার্কস কোম্পানি (TELCO) বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত ইঞ্জিন কারখানা।
V. পশ্চিমবঙ্গের উত্তপাড়ার নিকটে গড়ে উঠেছে হিন্দুস্থান মোটরস লিমিটেড যেটি ভারতের প্রথম মোটরগাড়ি নির্মাণ কেন্দ্র। এছাড়া হরিয়ানার গুরগাও এ অবস্থিত মারুতি উদ্যোগ লিমিটেড হল বর্তমানে ভারতের বৃহত্তম বেসরকারি মোটরগাড়ি নির্মাণ কেন্দ্র।
পেট্রো-রসায়ন শিল্প
খনিজ তেলের উপজাত দ্রব্য ন্যাপথা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে যেসব রাসায়নিক এবং যৌগিক পদার্থ উৎপাদিত হয়, সেগুলিকে ব্যবহার করে যে শিল্পে কৃত্রিম তন্তু, প্লাস্টিক, রং, কৃত্রিম রাবার, কীটনাশক এবং অন্যান্য জিনিস উৎপাদিত হয়, তাকে পেট্রো-রসায়ন শিল্প বলে।
পেট্রো-রসায়ন শিল্পকে আধুনিক সভ্যতার রূপকার বলা হয়।
বহু ধরণের রাসায়নিক শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ করে এই শিল্প। বৈচিত্র্য, পরিমাপ, ব্যবহারিক দিক প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই শিল্পের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। পেট্রো-রসায়ন কারখানায় উৎপন্ন সামগ্রীর উপর ভিত্তি করে বহু অনুসারী শিল্প গড়ে উঠতে পারে। কোনো দেশে পেট্রো-রাসায়নিক শিল্পের বিকাশ ঘটলে সেখানে ব্যাপক শিল্পায়নের পথ প্রশস্ত হয়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
ভারতে পেট্রো-রাসায়নিক কারখানাগুলির নাম ও তাদের অবস্থান
I. পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়ায় পূর্ব ভারতের বৃহত্তম পেট্রো-রাসায়নিক কারখানা গড়ে উঠেছে।
II. গুজরাতের ভাদোদারাতে ভারত সরকারের সংস্থা ইন্ডিয়ান পেট্রো-কেমিক্যালস কর্পোরেশন এর কারখানা রয়েছে।
III. মহারাষ্ট্রের ট্রম্বেতে ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লি. নামে একটি বেসরকারি বৃহৎ পেট্রো-রাসায়নিক কারখানা রয়েছে।
ভারতে গড়ে ওঠা এই সবকটি শিল্প আর্থিক আনুকূল্য, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ লাভ করার ফলে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচামাল, শ্রমিক, মূলধন, এবং শিল্পাঞ্চলের বাজার থাকায় সুষ্ঠভাবে বিকাশ হতে পেরেছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় শিল্পের চাহিদা এবং সুনাম অনেকটাই বেড়েছে।
সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতের জনসংখ্যা
লেখিকা পরিচিতি
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্রী শ্রীপর্ণা পাল। পড়াশোনার পাশাপাশি, গান গাইতে এবং ভ্রমণে শ্রীপর্ণা সমান উৎসাহী।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-geo-6-e