ইতিহাস – দশম শ্রেণি – উত্তর – ঔপনিবেশিক ভারতঃ বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (পর্ব – ২)
দুশো বছর ধরে অসংখ্য মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টায় ভারত স্বাধীন হয়েছিল; কিন্তু তার জন্য সব থেকে বড় মাশুল গুনতে হয়েছিল হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বহু মানুষকে, যারা সেদিনের দেশভাগে সবথেকে বড় বলিদান দিয়েছিল। ভারতমাতা দেহ দু-টুকরো হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। সেই দেশভাগ বহু মানুষকে মুহূর্তে বানিয়ে দিয়েছিল উদ্বাস্তু। পরিসংখ্যান বলছে, 1949 এর মধ্যে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল 16 লক্ষ। যদিও বাস্তব চিত্র এই তথ্যের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল।
স্বাধীনতা পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যা ও সমাধানের উদ্যোগ পর্বটির আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে↓
বাংলা ও পাঞ্জাবে শরণার্থী সমস্যা
দেশভাগের যন্ত্রণা সবথেকে বেশি পড়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবে। দুটি ক্ষেত্রে সমস্যার কারণ এক হলেও তাদের ধরণ আলাদা ছিল। ভারতের পাঞ্জাবে ও পাকিস্তানে সেই সময় ব্যাপক দাঙ্গা হয়েছিল। ভারতের ভূখণ্ড ছেড়ে যাবার সময় বহু মানুষ তাদের সম্পত্তি প্রচুর পরিমাণে ভারতে ছেড়ে গিয়েছিল। ফলে, আগন্তুক শরণার্থীরা তা দখল করে জীবনযাপনে সক্ষম ছিল। এছাড়া ভাষাগত সাদৃশ্যতার জন্য ঐ শরণার্থীরা পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
কিন্তু, বাংলার ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি ছিল কিছুটা ভিন্ন ও সুদূরপ্রসারী। বাংলায় দাঙ্গার পরিমাণও পাকিস্তান অপেক্ষা কম ছিল। 1947শে দেশভাগ হওয়ার পরবর্তী বছরগুলিতে মূলত বাংলায় শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ ঘটে। সেই অনুপ্রবেশ স্থায়ী হয়েছিল 1971 সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবধি। আবার সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যতার উপর নির্ভর করে বাংলার শরণার্থীরা পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
খাদ্য ও স্থানের সংকুলান ঘটায় এই উদ্বাস্তুদের একটি অংশকে উড়িষ্যা ও আন্দামানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলে তা মেনে নেয়নি ঐ উদ্বাস্তুরা। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই বিভিন্ন স্থান জবরদখল করে তারা জীবনযাপন করতে শুরু করে। যা সেই নবগঠিত ভারতবর্ষে অর্থনীতির অবস্থা শোচনীয় করে তোলে।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও দেশভাগ
দেশভাগের সময় যখন মুসলিম লিগের আবুল হাসিম বা বেঙ্গল কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায়ের মত নেতৃবৃন্দ বাংলাকে অখণ্ড রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালাচ্ছেন, তখন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের স্বনামধন্য পুত্র ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর তীব্র বিরোধিতা করে আন্দোলন করেছিলেন।
পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীনতা পেলে নেহেরুর মন্ত্রীসভায় তিনি শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু দেশভাগ পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর নিদারুণ অত্যাচারের তীব্র বিরোধিতা করে নেহেরুর মন্ত্রীসভা ত্যাগ করে ‘ভারতীয় জনসংঘ’ নামক একটি দল গড়ে তোলেন।
সরকারী উদ্যোগ
দেশভাগের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দিকে দিকে দাঙ্গা দুই দেশের জীবনযাত্রাকেই বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।
এই পরিস্থিতি অবসানের জন্য দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী (ভারতের নেহেরু ও পাকিস্তানের লিয়াকত আলি) 1950 সালে দিল্লী চুক্তি বা নেহেরু লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত করেছিলেন।
কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবে বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। নেহেরুর মন্ত্রীসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ডঃ ক্ষিতিশচন্দ্র নিয়োগী এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। সংখ্যালঘু জনজাতির ওপর অত্যাচার ও পাকিস্তান থেকে তাদের ভারতে অনুপ্রবেশ চলতেই থাকে। পরবর্তীকালে এই শরণার্থীদের আন্দামান ও উড়িষ্যার দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্তেরও তীব্র নিন্দা হয়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
সরকারের উদ্যোগ বহু অংশে ব্যর্থ হলেও নেহেরু সরকার যে এই বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা নিঃসন্দেহ। উদ্বাস্তুদের নিয়মিত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াটি খুব একটা সরল না হলেও তা সুষ্ঠুভাবে ভারত সরকার পরবর্তী কিছু বছর ধরে চালিয়েছিল, তাতে ভারত সফলতাও পায়।
আগেই বলেছি তোমাদের বাংলায় এই উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল দীর্ঘকালীন। এর জ্বলন্ত উদাহরণ মরিচঝাঁপি।
দেশভাগের পর বাংলায় যে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী প্রবেশ করে তাদের মধ্যে একটি অংশকে সরকার উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে প্রেরণ করেছিল। কিন্তু ভাষাগত, সংস্কৃতিগত ফারাকের কারণে তারা পশ্চিমবঙ্গে ফিরতে উৎসাহী ছিলেন।
1978 সালে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ দণ্ডকারণ্য ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মরিচঝাঁপিতে বসবাস করতে শুরু করে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদেরকে পুনরায় ফেরত পাঠানোর উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক অবরোধ শুরু করে। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশে সেই অর্থনৈতিক অবরোধ উঠে যায় এবং সরকার তাদের পুনরায় ফিরত পাঠাতে সশস্ত্র হলেও তাদের একটি অংশ শিয়ালদহ ও বারাসাতের মধ্যবর্তী অংশে জবরদখল করে বাস করতে থাকে।
আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় দেশভাগ
বহু ঐতিহাসিকই স্বীকার করেছেন দেশভাগের পরিস্থিতির সঠিক চিত্র বিভিন্ন সরকারী নথি বা পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যায়না। এর জন্য আমাদের বিভিন্ন আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ওপর কিছুটা নির্ভর করতে হয়।
যেমনে এই বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ খুশবন্ত সিংয়ের ‘এ ট্রেন টু পাকিস্তান’; একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ সুনন্দা শিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’ বা মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ’ এছাড়া উর্বশী বুটুলিয়ার সম্পাদিত ‘দ্য আদার সাইড অফ সাইলেন্স: ভয়েজেস ফ্রম দ্য পার্টিশন অফ ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি।
এই সকল স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী সেই সময়ের দেশভাগের যন্ত্রণায় নিপীড়িত মানুষের প্রতিফলন বহন করছে।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভাষার ভিত্তিতে ভারতে রাজ্য পুনর্গঠন
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X_hist_8b