বাংলা – একাদশ শ্রেণি – প্রাচীন লিপি এবং বাংলা লিপির উদ্ভব ও বিকাশ (তৃতীয় অধ্যায়)
এই পর্বে আমরা লিপির ধারণা আলোচনা করে নেব।
সোশ্যাল মিডিয়া, ইমেলের যুগে সেই আদ্যিকালের হাতে লেখা চিঠি তো একেবারেই অচল হয়ে পড়েছে। এখন একটা টেলিগ্রাম আছে বটে, কিন্তু তা আদ্যিকালের তার পাঠানোর মাধ্যম নেই আর। পোস্টকার্ড নেই, স্ট্যাম্প এখনও বিক্রি হয় পোস্ট অফিসগুলিতে, কিন্তু স্ট্যাম্প কিনে চিঠিতে সাঁটিয়ে সে চিঠি সযত্নে কয়জনই বা তাঁর প্রিয় মানুষের উদ্দেশ্যে ডাকবাক্সে ফেলে দেন?
চিঠি লেখার চলটাই আজ আর নেই।
কিন্তু এক সময় মানুষই কিন্তু চিঠি লিখে পায়রার পায়ে বেঁধে উড়িয়ে দিত দূর-দূরান্তের প্রিয় মানুষের উদ্দেশ্যে। তারও আগে রাজা-রাজড়ারা পাথরের গায়ে, পাহাড়ের গায়ে তাঁদের বাণী, পরামর্শ কিংবা উপদেশ খোদাই করে রাখতো। সাধারণ মানুষ লিখতো তালপাতায়, কিংবা ভুর্জপত্রে।
ইতিহাসে নিশ্চয়ই পড়েছো, প্যাপিরাসের কথা। সেই প্যাপিরাসের পাতায় কালি দিয়ে মানুষ লিখতো মনের কথা।
ইতিহাসের যানে চড়ে আরও পিছনে চলে যাই। একেবারে গুহাবাসী আদিম মানুষদের সময়েও কিন্তু আমরা জানি গুহার গায়ে তাঁদের আঁকা নানারকম ছবির কথা। সেই সব ছবি অনেকাংশেই ছিল প্রতীকী এবং বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
সারাদিন শিকারের পিছনে ছুটে ছুটে একটা সফল শিকার করার পরে দুপুর দুপুর বাড়ি ফিরে জ্বলন্ত আগুনের চারধারে বসে গোষ্ঠীর সকলের সঙ্গে শিকারের গল্প করতো সেই আদিম শিকারী। বীরত্বের নমুনা তো দেখাতেই হয় দলের মধ্যে। আর সেই গল্প বলার মুহূর্তটাকে চিরস্থায়ী করে রাখতে সেই শিকারী তাঁর শিকার-কাহিনিতে প্রতীকীভাবে গুহার দেওয়ালে ছবি করে ফুটিয়ে তুলতো।
সেও কিন্তু এক লেখাই। হ্যাঁ লেখা।
এই লেখা নিয়েই আজকের লেখাপড়া চলবে আমাদের বন্ধুরা। আজকে আমাদের পড়ার বিষয় তোমাদের পাঠ্য ‘লিপি’ অধ্যায়টি।
দেখো বন্ধুরা, শুরুর ভণিতাতেই বুঝে গেছো আশা করি, লেখার ইতিহাসটা কিন্তু অনেক অনেক প্রাচীন। মানুষ ভালো করে কথা বলার আগে থেকেই কিন্তু লিখতে শিখেছিল। সেই লেখাকে তখন যদিও ছবি বলা হত। আসলে লিপি বিষয়টি একপ্রকার প্রতীকমাত্র।
আমরা মুখে যা উচ্চারণ করি তারই একটা নির্দিষ্ট সর্বজনস্বীকৃত প্রতীক স্থির করা হয়েছে আর তাকেই লিপি বলে ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে। মজার বিষয় হল, আমরা ছোটবেলায় যে অ-আ-ক-খ শিখেছি, সেটা মুখেও তো বলেছি। এবার কেউ যদি আমাদের শেখাতো যে ‘ক’ লিখবে এভাবে –‘অ’ আর ‘অ’ লিখবে এভাবে – ‘ক’। তাহলে তো আমরা লেখার সময় এভাবেই লিখতাম।
তাই লিপি একপ্রকার symbol যা আমাদের ধ্বনিকে রূপ দেয় মাত্র।
সেই আদিম মানুষের সময় থেকেই কিন্তু মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে শুধু মুখে বলা কথা তাঁদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে ঠিকই, কিন্তু তা চিরস্থায়ী নয়। তার জন্য সেই কথা লিখে রাখা দরকার। মানুষ তখন লিপি জানতো না, তাই সে ছবি আঁকতো। তাঁদের ছবিটাই একধরনের লিপি তো বটেই। ধীরে ধীরে সংগঠিত লিপির সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের কথাও অনেক উন্নত হয়েছে, ধ্বনির ব্যবহার অনেক সংহত হয়েছে।
এবার তোমরা প্রশ্ন করবে, মানুষ লিখতো কেন? শুধুই তা চিরস্থায়ী করে রাখার জন্য?
না, একমাত্র সেইটাই কারণ ছিল না। মানুষ লিখতে শিখেছিল, বলা ভালো লিখতে শুরু করেছিল বা লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল মনে রাখার সুবিধের জন্য। ইতিহাস বলছে আগে মানুষ দড়িতে গিঁট বেঁধে বেঁধে কোনো জিনিসকে মনে রাখার চেষ্টা করতো। সেটাও একপ্রকার symbol, এগুলোকে লিপির আগের রূপ ধরা হয়।
ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই দড়িতে গিঁট বাঁধার ব্যাপারটাকে বলে ‘কুইপু’।
এভাবেই প্রাচীনকালে লিপির একেবারে আদিরূপ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে ‘কুইপু’কে আর যাই হোক লিপির আদর্শ রূপ বলা যায় না। এর মধ্যে বৈচিত্র্য ছিল না। ধীরে ধীরে কালের নিয়মে লিপির কৌশল ও বৈশিষ্ট্য অনেক বদলেছে।
পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন লিপি যদি বলতে হয় তাহলে অবশ্যই উঠে আসবে সুমেরীয়দের লিপির কথা।
আগেই বলেছি মানুষ প্রাচীনকালে প্রাথমিক পর্বে মনের ভাব প্রকাশ করতো ছবি এঁকে। ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা সাইবেরিয়া ইত্যাদি সহ ভারতেও কিছু অঞ্চলে সেই রকম বেশ কিছু গুহাচিত্র পাওয়া গেছে। এইসব ছবির বেশিরভাগেরই বিষয় হল শিকার কাহিনী।
একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
তবে মানুষ আরো কিছু বলতে চাইছিল আর তার বলার বিষয়ের সঙ্গে প্রকৃত অভিব্যক্তির অভাবের কারণে ধীরে ধীরে ছবি ছেড়ে মানুষ এল লিপির দিকে। তাছাড়া সবাই ছবি আঁকতেও পারতো না। ছবি আঁকতে সময়ও লাগে অনেক, সরঞ্জাম লাগে অনেক, পরিশ্রমও হয়। তাই প্রতীকময়তা বাড়াতে এবং সময়-শ্রম ইত্যাদি কমানোর জন্যই মানুষ খুঁজে নিল লিপির পথ।
প্রথম দিকে মানুষের ভাষা বা ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে সংকেত ছিল প্রধান।
লাঠি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে গাছের গুঁড়িতে দাগ কাটা, গাছের ডালে কাপড় জড়ানো ইত্যাদি সংকেতের সাহায্যে মানুষ অনেক কিছুকে অর্থবহ করে তোলার চেষ্টা করতো। যত দিন এগিয়েছে, মানুষ সংকেত ছেড়ে প্রতীকের পথে এগিয়েছে যেখানে বিমূর্ততা বেশি। গরু বোঝানোর সময় এবার পুরো গরুর ছবির বদলে আঁকা হল দুটো শিং কিংবা একটা-দুটো পাতা এঁকেই পুরো গাছটাকে বোঝানো হল।
ফলে বন্ধুরা বুঝতেই পারছো, কম আয়াসে অনেক বেশি অর্থ বোঝানোর চেষ্টা করেছিল মানুষেরা আর এই প্রচেষ্টার মধ্যে সবেতেই প্রায় ছবির অনুষঙ্গ রয়েছে। এই সমস্ত লিপিগুলিকে বলা হয় চিত্রলিপি।
তাই একটা বিষয় পরিষ্কার যে লেখা বা লিপির আদিরূপ কিন্তু ছবি আঁকার মধ্যে নিহিত ছিল। হ্যাঁ, এইবারে একটু টেকনিক্যাল বিষয়গুলিকেও দেখতে হবে বন্ধুরা।
শোনো মূলত লিপির প্রকার অনুযায়ী ও বিবর্তনের ধারা অনুযায়ী লিপিকে চার ভাগে ভাগ করা হয় –
চিত্রলিপি
ভাবলিপি
ধ্বনিলিপি এবং
অক্ষরলিপি
মোটামুটিভাবে সাড়ে চার-পাঁচ হাজার বছর আগে প্রথম লিপির ব্যবহার শুরু হয় বলে মনে করেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। |সুমেরু অঞ্চল, ইজিপ্ট, এজিয়ানা, এলম, সিন্ধু, মায়া ইত্যাদি অঞ্চলে প্রকৃত লিপির ব্যবহার শুরু হয় প্রথমে। প্রাথমিক পর্বে সব লিপিই ছিল চিত্রলিপি।
পরে দেখা যায় তা একটি মাত্র বস্তুকে না বুঝিয়ে বরং একটি সামগ্রিক ভাবকে বোঝাচ্ছে – একে ভাবলিপি বলা হয়।
এই ভাবলিপির পরেই আসছে অক্ষরলিপি। এই স্তরে ধীরে ধীরে লিপির হরফগুলি স্পষ্ট হতে শুরু করে। এক একটি নির্দিষ্ট চিহ্ন এক একটি পৃথক পৃথক অক্ষর বা বর্ণকে বোঝাতো। মানুষ মুখে যে ভাষা বলতো, তাকেই লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলো হরফের মধ্যে দিয়ে।
এক একটি অক্ষর তখন এক একটি বিশেষ খণ্ড ভাবকে বোঝাতো। সহজ করে বললে লিপির যে সামগ্রিকতা তা ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো। খণ্ড খণ্ড অক্ষর বা বর্ণ খণ্ড ভাবকে প্রকাশ করতে লাগলো। তবে তখনও পর্যন্ত মানুষের মুখনিঃসৃত ধ্বনি হুবহু লিপিবদ্ধ করা হতো না। কিছুকাল পরে এক একটি অক্ষর হয়ে ওঠে একেকটি syllable-এর প্রতীক।
একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
এখানে একটা ব্যাপার খুব সহজ করে বুঝে নাও। মানুষ আগে কথা বলতে শিখেছে, তারপর সেই কথা থেকেই লিপি এসেছে। তাই লিপির কাজ হল একপ্রকার মানুষের কথাকে অনুকরণ করে হরফে ফুটিয়ে তোলা।
তাই আমরা যদি মুখে বলি ‘মানুষ’ – এর মধ্যে syllable বা অক্ষর হল তিনটি ‘মা-নু-ষ’।
এই একেকটি অক্ষরকে আমরা একেকটি পৃথক চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করছি এটাই অক্ষর লিপির নমুনা। পরে তা আরো বিবর্তিত হয়ে উচ্চারণকে ভিত্তি করে ধ্বনিলিপি তৈরি করে। এক্ষেত্রে শব্দ আলাদা হলেও একটি ধ্বনির জন্য একটিমাত্র চিহ্ন বা প্রতীক ব্যবহার করা হতো। ফলে এভাবেই লিপি কোনো বস্তুর প্রতীক থেকে বিশেষ ধ্বনির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
একটা মজার গল্প বলি তোমাদের। গ্রিক অক্ষর ‘আলফা’ (α) দেখেছো তো? সেটা থেকে ইংরেজিতে এসেছে প্রথম অক্ষর ‘এ’ (a)। সেই আলফা কিন্তু আগে ছিল গরুর মুখের প্রতিরূপ। আজ আর ‘আলফা’ কিংবা ‘এ’ লেখার সময় একথা কেউ মনে রাখে না।
আশা করি এতক্ষণ যা যা বললাম বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আজকের ক্লাস এখানেই শেষ করছি। পরের দিন লিপিদের সম্পর্কে আরো তথ্য নিয়ে আবার উপস্থিত হব।
ততক্ষণ টাটা।
পর্ব সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XI_Beng_Lipi_1