shakto-podaboli-ramprasad-sen
Class-11

শাক্ত পদাবলী ও রামপ্রসাদ সেন

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)


এর আগে চৈতন্যদেবঃ বাঙালি সমাজ ও সাহিত্যে চৈতন্যপ্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা অষ্টাদশ শতাব্দী শাক্ত পদাবলী সম্পর্কে আলোচনা করবো।

বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পদাবলীর গুরুত্ব সম্পর্কে আগেই আলোচনা করা হয়েছে বন্ধুরা। বৈষ্ণব ধর্মের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের কবিরা যে প্রেম-ভক্তিমূলক পদ রচনা করতেন তাকে আমরা নাম দিয়েছি বৈষ্ণব পদাবলী।

আগের ক্লাসেই বলেছিলাম বন্ধুরা, পদাবলীর একটা নির্দিষ্ট ধর্মীয় ভিত্তি রয়েছে আর সেই ভিত্তিতেই পদাবলীকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।

প্রথমটি তো নিঃসন্দেহে বৈষ্ণব পদাবলী আর পরেরটি শাক্ত পদাবলী।

আজকের ক্লাসের মূল আলোচ্য এই শাক্ত পদাবলী।

নামের মধ্যেই অর্থ লুকিয়ে আছে। ‘শাক্ত’ কথার অর্থ হল শক্তি। বাঙালিদের কাছে শক্তির প্রতীক হিসেবে বরাবর কালী-চণ্ডী-চামুণ্ডা-তারা ইত্যাদি দেবীরাই পূজিত হয়েছেন। বরাভয়দাত্রী দেবী কালী যেমন নিজে শক্তির প্রতীক, তেমনি তাঁর বহুবিধ রূপও শক্তির প্রতীক রূপেই ধার্য হয়। সেই অনেক রূপের মধ্যে কালীর একটি বিশেষ রূপ হল ‘উমা’। খুব সহজ করে বললে উমা হল দেবীর কন্যা তথা বালিকা রূপ।

পুরাণে দেখবে যিনি পার্বতী, তিনিই উমা, তিনিই আবার ভয়ঙ্করী কালী। বাঙালির ঘরের মেয়ে উমা। এই উমাকে নিয়েই শাক্ত পদকর্তারা গান লিখেছেন। হ্যাঁ বন্ধুরা, গান। বৈষ্ণব পদাবলীতে যেমন একেকটি পৃথক রচনাকে আমরা ‘পদ’ বলেই চিনেছিলাম, তেমনই শাক্ত পদাবলীর ক্ষেত্রে এখানে একেকটি রচনা আসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ গান আর এই গানগুলির একইসঙ্গে সাঙ্গীতিক এবং সাহিত্যিক মূল্য রয়েছে।

একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, বৈষ্ণব পদাবলী লেখা হয়েছিল মধ্যযুগে, মোটামুটিভাবে পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীতে আর শাক্ত পদাবলীর গানগুলি লেখা হচ্ছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে।

ফলে প্রায় দুশো বছরের একটা যুগের ব্যবধান ঘটে গিয়েছে যার প্রভাবে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতেও অনেকটা বদল ঘটে গিয়েছিল। এই পরিবর্তনের ছাপ ধরা আছে শাক্ত পদগুলিতে। বাংলার সমাজে এই সময়টা ছিল পালাবদলের সময়। একদিকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘনিয়ে আসছে আর একদিকে ইংরেজদের আধিপত্য ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে ভারতে।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

পরে ইংরেজরাই বণিকের মানদণ্ড ছেড়ে রাজদণ্ড হাতে তুলে নেবে। ইতিমধ্যে বাংলার আপামর মানুষ বর্গী আক্রমণ, পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল।

১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয় এবং তার পরেই মুঘল শাসনব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ে।

বাংলার সেই সময়ের নবাবি শাসনে মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে সিরাজ-উদ-দৌল্লা পর্যন্ত সকলেই ছিলেন বিলাস-ব্যসনে মত্ত। নবাবি শাসনের দুর্বলতার সুযোগে দেশের ভূস্বামীরা সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার আর শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। ঠিক এই সময় বাংলার মানুষ এমন একজন দেব-দেবীর কল্পনা করছিল যিনি এই দুর্দিনে তাঁদের মনোবল যোগাবেন, তাঁদের শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করবেন। সেই দেব-দেবী যেন প্রয়োজনে শত্রু বিনাশ করতেও সক্ষম হন। কালী কিংবা দুর্গার দুই রূপ উমা আর শ্যামাকেই তাঁরা এই শক্তির প্রতিভূ বলে কল্পনা করলেন। এভাবেই শাক্ত পদাবলীর মধ্যে বাঙালি মানসের দুঃখ-দুর্দশার আখ্যান আর দেবী শ্যামার প্রতি ভক্তি ফুটে উঠেছে।

শাক্ত পদাবলীর মধ্যে মূলত দুই ধরনের গান দেখা যায় – উমাসঙ্গীত আর শ্যামাসঙ্গীত।

উমাসঙ্গীত

দেবীর বালিকা বা কন্যারূপ হল উমা। তবে শাক্ত গানগুলির বিষয়-বৈচিত্র্য লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এক্ষেত্রে প্রধানত তিনটি বিষয় উঠে আসে –
ক) আগমনী
খ) বিজয়া
গ) ভক্তের আকুতি

এই আগমনী আর বিজয়া পর্যায়ের গানের প্রধান চরিত্র উমা, অন্যদিকে ভক্তের আকুতিতে মূলত শ্যামাকে নিয়েই কবিরা গান রচনা করেছেন। বন্ধুরা, আগমনী আর বিজয়া পর্যায়ের এই গানগুলির বিষয় বুঝতে গেলে তোমাদেরকে মনে রাখতে হবে আমাদের বাঙালিদের চিরন্তন বড়ো উৎসব দুর্গাপূজার কথা। পূজার সময় যেমন মা দুর্গা আমাদের কাছে আসেন মর্ত্যধামে, ঠিক তেমনই যেন উমাও এই দিন পিতৃগৃহে ফিরে আসে।

পুরাণে রয়েছে হিমালয় এবং মেনকার কন্যা উমার সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল কৈলাসবাসী শিবের। শিবকে জামাতা হিসেবে মেনকার মোটেও পছন্দ নয়, তাই উমা বাড়ি এলে আদরের মেয়েকে আর শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে মন চায় না মেনকার। কিন্তু উমাকে ফিরে যেতেই হয় পতিগৃহ কৈলাসে আর তার মা মেনকা এবং পিতা হিমালয় অশ্রুসজল নয়নে আবার অপেক্ষা করেন পরের বছরের শরৎকালের জন্য। ফলে পুরাণের উমা এইসব গানে বাঙালির ঘরের মেয়ের প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন। কন্যাদায়গ্রস্ত অভাবী বাঙালি পরিবারের লোকেরা যেমন তাদের কন্যার বিবাহ-পরবর্তী জীবন নিয়ে চিন্তিত থাকেন, সেই ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে শাক্ত পদাবলীর আগমনী আর বিজয়া এই দুই পর্যায়ের গানে।

একটি শাক্ত গানে রয়েছে –
‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরি
উমা বুঝি আমার কাঁদিছে।
উমার যতেক বসন ভূষণ
ভোলা সব বুঝি বেচে খেয়েছে।’

এই গানটি লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে জামাই শিব সম্পর্কে উমার মা মেনকার মনোভাব ঠিক কেমন ছিল। কন্যার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটায় মা মেনকা তাঁর স্বামী গিরিরাজের কাছে অনুযোগ জানান যে এবার উমা পিতৃগৃহে এলে আর তাঁকে ফিরে যেতে দেবেন না।

এই আকুতি ধরা পড়ে আরেকটি শাক্ত গানে –
‘এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাব না
বলে বলুক লোকে মন্দ, কোনো কথা শুনবো না।
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয় উমা নেবার কথা কয়
এবার মায়ে-ঝিয়ে করব ঝগড়া জামাই বলে মানব না।’

এগুলি সবই আগমনী-বিজয়া পর্যায়ের গান যেখানে ধরা পড়েছে বাঙালি মায়ের বাৎসল্য।

শ্যামাসঙ্গীত

অন্যদিকে ভক্তের আকুতি পর্যায়ের গানগুলিতে দেখা যাবে কবিরা দেবীর চরণে শক্তির আরাধ্যের চরণে নিজেদের অপূর্ণ অভিলাষ নিবেদন করছেন। নিজেদের জীবনের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানিয়ে তা থেকে নিষ্কৃতির উপায়ও খোঁজার চেষ্টা করেছেন কবিরা এই গানের মাধ্যমেই। প্রচণ্ড অভিমানে কবির কন্ঠে ধ্বনিত হয় –

‘মাগো তারা, ও শঙ্করী
কোন অবিচারে আমার ’পরে করলে দুখের ডিক্রিজারি’

রামপ্রসাদ যেন এই জীবনের দুঃখকে মা কালীর লীলা হিসেবেই বিবেচনা করেছেন আর তাই গানের মাধ্যমে তিনি লেখেন –

‘ও মা কালী, চিরকালই, সঙ সাজালি এ সংসারে’

দেবীর কাছে অভয় প্রার্থনাই এই পর্যায়ের গানের মূল ভিত্তি। আশা করি শাক্ত পদাবলী সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা তোমাদের হয়ে গিয়েছে। এবারে আমরা জেনে নেবো শাক্ত পদাবলীর একজন বিখ্যাত প্রতিনিধিস্থানীয় কবি রামপ্রসাদ সেনের কবি কৃতিত্ব সম্পর্কে।

শাক্ত কবি রামপ্রসাদ সেনের কবি কৃতিত্ব

শাক্ত পদাবলীর শ্রেষ্ঠ পদকর্তা বলা হয় রামপ্রসাদ সেনকে। আনুমানিক ১৭২০-২১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয় এবং ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার হালিশহরে তাঁর জন্ম হয়। মূলত তিনি একজন মাতৃসাধক ছিলেন।

নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় রামপ্রসাদ সেনকে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

শোনা যায়, জমিদারের কাছারিতে হিসাব লেখার কাজ করতে করতে হিসাবের খাতাতেই বিভোর হয়ে গান লিখে ফেলতেন রামপ্রসাদ। অনন্য প্রতিভার অধিকারী রামপ্রসাদ সেন প্রায় তিন শতাধিক গান রচনা করেছিলেন বলেই জানা যায় এবং তাঁর লেখা গানগুলি বাঙালি সমাজে রামপ্রসাদী গান হিসেবেই বিখ্যাত। সহজ-সরল সুর এবং সহজ কথার মাধ্যমে দেবী কালীর সঙ্গে মা-পুত্রের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন তিনি।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

আগমনী ও বিজয়া পর্যায়ের পদ তিনি খুব একটা রচনা করেননি, তবে এই পর্যায়ের তাঁর লেখা বেশ কিছু গান আজও জনপ্রিয়। যেমন ‘গিরি এবার আমার উমা এলে’ গানটির কথা বলতেই হয়। মাতৃজীবনের যে বেদনা এবং বিরহযন্ত্রণা তা ফুটে উঠেছে এই গানে। তাছাড়া ভক্তের আকুতি পর্যায়ের গানগুলিও রামপ্রসাদের লেখনীতে অসাধারণভাবে ফুটে উঠতো।

তিনি ছিলেন একাধারে ভক্ত এবং সাধক। ফলে তাঁর গান একইসঙ্গে স্নেহ-মমতা, মান-অভিমানে পরিপূর্ণ। এমনকি এই পর্যায়ের বেশ কিছু গানে রামপ্রসাদ মা কালীর কাছে শিশুসুলভ আবদার, অভিযোগ, তিরস্কার ও অভিমান প্রকাশ করেছেন। এই পর্যায়ের রামপ্রসাদী গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘মা আমায় ঘুরাবি কত’, ‘ডুব দে’রে মন কালী বলে’ ইত্যাদি।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

তবে রামপ্রসাদের গানগুলি তন্ত্রসাধনার তত্ত্বকথার ভারে একেবারেই জর্জরিত নয়, এই গানগুলির সারল্য ও প্রাঞ্জলতাই রামপ্রসাদের জনপ্রিয়তার মুখ্য কারণ। শুধু তাই নয়, তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে বাঙালি সমাজ জীবনের এক স্পষ্ট ছবি ফুটে ওঠে।

শাক্ত গান লেখার পাশাপাশি রামপ্রসাদ সেন ‘বিদ্যাসুন্দর’ নামে একটি কাব্য লিখেছিলেন, লিখেছিলেন ‘কালীকীর্তন’ নামে আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ।

পর্ব সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_14