suyejkhale-hangor-shikar-sarsongkkhep
Class-11

সুয়েজখালে : হাঙর শিকার | সারসংক্ষেপ

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – সুয়েজখালে : হাঙর শিকার (সারসংক্ষেপ)

স্বামী বিবেকানন্দ

আলোচ্য নিবন্ধটি স্বামী বিবেকানন্দের লেখা। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি কলকাতার সিমলাপাড়ার দত্ত পরিবারে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। এফ.এ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীন দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ক্রমেই শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়ে নরেন্দ্রনাথ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

১৮৮৭ সালে নরেন্দ্রনাথ দত্ত সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং তাঁর সন্ন্যাসের পরবর্তীকালে নাম হয় স্বামী বিবিদিশানন্দ। ১৮৯৩ সালে ক্ষেত্রীর রাজা তাকে বিবেকানন্দ নাম দেন।

ইতিমধ্যে ১৮৮৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রয়াণ ঘটলে বরানগরে তাঁর অন্যান্য গুরুভাইদের সঙ্গে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ স্থাপন করেন। এরপর পরিব্রাজকরূপে সমগ্র ভারতবর্ষে তিনি ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন এবং ভারতবাসীদের সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভের চেষ্টা করতে থাকেন। ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্মমহাসভায় যোগ দেবার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকায় যান এবং সেখানে সকল দেশের সকল ধর্মের প্রতিনিধিদের মাঝে হিন্দুধর্মের গৌরব এবং ঐতিহ্য বিষয়ক বক্তব্য রাখেন।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

এই বক্তৃতাদানের ফলে সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে স্বামী বিবেকানন্দের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯৭ সালে শিকাগো থেকে দেশে ফিরে আসেন স্বামীজি। দেশে ফিরে যথাক্রমে রামকৃষ্ণ মিশন এবং পরবর্তীকালে ১৮৯৯ সালে বেলুড় মঠ গড়ে তোলেন স্বামীজি। জীব সেবাই আসলে ঈশ্বর সেবা এই ছিল তাঁর মূল মন্ত্র। তবে শুধুই আধ্যাত্মিক বিকাশ নয়, সাহিত্যসৃষ্টির জগতেও স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন অন্যতম এবং স্বতন্ত্র।

‘ভাববার কথা’, ‘পরিব্রাজক’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘বর্তমান ভারত’ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন।

তিনি আর তার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় এবং পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় গীতার বিভিন্ন অধ্যায়ের আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে।

কর্মযোগ এবং রাজযোগের উপর তাঁর লেখা অত্যন্ত বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ রয়েছে।

পরবর্তীকালে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকা সম্পাদনার ভারও ন্যস্ত হয়েছিল তাঁরই উপর এবং বলাই বাহুল্য তাঁর বেশিরভাগ লেখাই প্রকাশিত হয়েছে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকাতে। উদ্বোধন কার্যালয় থেকেই তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর বাণী ও রচনা সংকলন গ্রন্থ খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ পেয়েছে এবং একইসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে ‘স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলী’। বাংলা সাহিত্যের জগতে তাঁর মতো বুদ্ধিদীপ্ত রচনাশৈলী খুব কম সাহিত্যিকেরই চোখে পড়ে। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই স্বামী বিবেকানন্দের মহাপ্রয়াণ ঘটে।

সুয়েজখালে : হাঙর শিকার উৎস

আলোচ্য ‘সুয়েজ খালে : হাঙ্গর শিকার’ নিবন্ধটি স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।

এই গ্রন্থের ৭১তম অনুচ্ছেদ থেকে ৮২তম অনুচ্ছেদ পর্যন্ত অংশ থেকে আমাদের আলোচ্য নিবন্ধটি সংকলিত হয়েছে। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ২০ জুন বিবেকানন্দ গোলকুণ্ডা জাহাজে চড়ে দ্বিতীয়বার বিদেশ যাত্রা করেন এবং তাঁর সঙ্গী ছিলেন স্বামী তুরীয়ানন্দ এবং ভগিনী নিবেদিতা। সেই সময়পর্বে বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকাকালীন সেই ভ্রমণবৃত্তান্ত স্বামী বিবেকানন্দ লিখে পাঠাচ্ছিলেন ‘উদ্বোধন পত্রিকা’-র তৎকালীন সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে। চিঠির আকারে লেখা সেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় মোট ১৪টি সংখ্যায় প্রকাশ পেয়েছিল ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’ নামে যার পরে নামকরণ হয় ‘পরিব্রাজক’।

সুয়েজখালে : হাঙর শিকার বিষয়সংক্ষেপ

পাঠ্যাংশের শুরুতেই দেখা যায় লেখক বলছেন ১৪ জুলাই তারিখে তিনি জাহাজে চড়ে লোহিত সাগর পেরিয়ে সুয়েজ বন্দরে এসে পৌঁছান। এই বন্দরের কাছেই সুয়েজ খাল। বিখ্যাত এই খাল খনন করেছিলেন ফার্দিনান্দ লেসেপ্স নামে এক ফরাসি স্থপতি। খাল খননের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভূমধ্যসাগর আর লোহিত সাগরকে সংযুক্ত করা যাতে ইউরোপ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যের সুবিধে হয়।

সুয়েজ বন্দরে জাহাজ থেকে কিছু মালপত্র নামানোর থাকলেও চারিদিকে সে সময় প্লেগের আক্রমণের আশঙ্কা বিস্তৃত। ফলে সকলের মধ্যেই একটা ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়। জাহাজের কর্মীরা তাই মিশরীয়দের সঙ্গে খুব সতর্কভাবে ছোঁয়াছুঁয়ি এড়িয়ে মালপত্র আদান-প্রদান করতে লাগলো। একটা অস্পৃশ্যতার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল সেই বন্দরে যা দেখে স্বামী বিবেকানন্দের মনে হয়েছিল যে এই অস্পৃশ্যতা ভারতের জাত-পাত, বর্ণবিদ্বেষকেও পিছনে ফেলে দেবে। জাহাজ থেকে মাল নামানোর সময় বন্দরের কুলিরা কেউ জাহাজ স্পর্শ করতে পারবে না, জাহাজের খালাসিরা তাই নিজেরাই মোট বহন করে নিয়ে ক্রেনে করে তুলে দিচ্ছেন আর সেই করেন জলে অপেক্ষমান মালবাহী নৌকায় মালগুলিকে নামিয়ে রাখছে।

কোম্পানির কর্মচারী সেই জলে একটা লঞ্চে করে এসে জাহাজের নাবিকের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন, জাহাজে ওঠার অনুমতি তাঁরও নেই। তবে লেখক লক্ষ করেন যে সুয়েজ বন্দর আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে থাকলেও এখানে বর্ণবিদ্বেষ তত প্রবল নয়। এর পর থেকেই ইউরোপের শুরু বলে ইউরোপের প্লেগবাহী ইঁদুর যাতে জাহাজে না উঠে পড়ে তাই এত সুরক্ষাব্যবস্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। লেখক তারপর লিখছেন যে এই প্লেগের জীবাণু শরীরে ঢোকার পর দশ দিনের মধ্যেই লক্ষ্মণ ফুটে ওঠে, তাই কোনো রকম ছোঁয়াছুঁয়ি ঘটলেই দশ দিন বন্দি থাকতে হবে। দশ দিন কোয়ারেন্টাইন থাকার নিয়ম অনুযায়ী জাহাজের কর্মীরা দশ দিন ইতিমধ্যে কাটিয়ে ফেলায় সে ভয় তাদের নেই। সামান্য এক প্লেগের কারণে গোটা জাহাজ জুড়ে এক অস্পৃশ্যতার প্রবাহ চলছে। আর এই প্লেগের ভয়েই যাতে জাহাজের কর্মীদের জাহাজ স্পর্শ করতে না হয় আলো লাগানোর জন্য তাই রাত্রেও সুয়েজ বন্দরেই থাকবে জাহাজটি।

এরপরের অনুচ্ছেদে সুয়েজ খাল, সুয়েজ বন্দর ও তার চারপাশের পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দের।

তিন দিকে বালির স্তূপ, পাহাড়, সুয়েজ খালে প্রচুর মাছ, হাঙর ভাসমান দেখতে পাওয়া যায়। লেখকের মতে, মিশরের সুয়েজ বন্দর এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বন্দর এই দুটি স্থানে পৃথিবীর সব থেকে বেশি হাঙর পাওয়া যায়। ফলে এখানে জলে কেউ নামে না এবং হাঙরকে বাগে পেলে মানুষ এখানে অবলীলায় হত্যা করে।

তৃতীয় অনুচ্ছেদে দেখা যায় সকালের প্রাতরাশ খাওয়ার পরেই লেখক শোনেন জাহাজের পিছনে হাঙরদের খুব কাছেই ভেসে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে এবং লেখক নিজেও কখনো জীবন্ত হাঙর চাক্ষুষ করেননি। যদিও আগে একবার তিনি সুয়েজ বন্দরে এলেও সেবারে অল্প সময় থাকার কারণে হাঙর দেখতে পাননি তিনি। হাঙর দেখা গেলে পরে লেখক দেখেন দ্বিতীয় শ্রেণির বারান্দার রেলিং ধরে জাহাজের সমস্ত নারী-পুরুষ হাঙর দেখায় উদ্‌গ্রীব হয়েছিল আর এই হাঙর দেখতেই এক বিশেষ ধরনের মাছ লেখকসহ সকলেই দেখতে পেলেন। একটা মাছ গাঙধারা মাছের মতো, আরেকটা মাছ খুবই ছোটো আর এদেরই মাঝে ইলিশ মাছের মতো দ্রুতগামী মাছগুলিকে লক্ষ করেন লেখক।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

এই তৃতীয় ধরনের মাছের নাম বনিটো যাকে হাঙরের বাচ্চা বলে মনে হয় আর লেখক জানতেন যে বনিটো মাছ শুঁটকি রূপে মালদ্বীপ থেকে বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করা হতো। প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ অপেক্ষার পরে লোহিত সাগরের কাচের মতো স্বচ্ছ জলে হাঙর দেখতে পাওয়ার উল্লাস উঠলো দর্শকযাত্রীদের মধ্যে। জাহাজের আরো কাছে এলে লেখক দেখতে পান যে সেটা একটা থ্যাবড়া মাথাবিশিষ্ট এক বিরাট দৈত্যাকার হাঙর আর তার আগে আগে ছুটে চলেছে কয়েকটা ছোটো মাছ।

হাঙরের শরীরের নানা জায়গায় এই মাছগুলি খেলে বেড়াচ্ছে আর কি যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। লেখকের বর্ণনায় এই মাছটিই অনুচরবর্গ সহ হাঙর আর ঐ ছোটো মাছগুলিকে বলা হয় আড়কাটি মাছ, যাকে ইংরাজিতে বলে ‘পাইলট ফিশ’।

এই মাছগুলি হাঙরকে খাবারের সন্ধান দেখিয়ে নিয়ে আসে এবং তার বিনিময়ে খাবারের অংশবিশেষ পায়।

এ এক অনবদ্য মিথোজীবিতা!

আবার আরেক রকমের মাছকে দেখতে পান স্বামীজি যাদেরকে বলা হয় ‘হাঙর-চোষক’। এর বিশেষ বর্ণনা রয়েছে পাঠ্যাংশে। এই মাছটি তাদের চোষক অঙ্গের সাহায্যে হাঙরের শরীরে আটকে থাকে। হাঙরের গায়ে লেগে থাকা পোকামাকড়, ছত্রাক জাতীয় উদ্ভিদ খেয়ে এই ধরনের মাছেরা বেঁচে থাকে। ফলে হাঙরের চারপাশে মূলত ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় আড়কাঠি এবং হাঙ্গর চোষককে। এরকমই একটি হাঙরচোষক এক যাত্রীর বড়শিতে ধরা পড়ে এবং সেই যাত্রীটি যখন মাছটিকে উপরে তুলে মাটিতে ফেলে সেই মাটির বুকে জুতোর সোল দিয়ে চাপ দেন, তখন দেখা যায় যে পা তোলার পর সেই মাছটি জুতোর সোলের নীচে আটকে গেছে। এভাবেই হাঙর-চোষকরা হাঙরের গায়ে আটকে থাকে।

এরপরে দেখা যায় দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের মধ্যে এক সামরিক বিভাগের মানুষ প্রচন্ড উদ্দীপনা এবং উৎসাহের সঙ্গে হাঙর ধরার চেষ্টা করছেন। একটা বিশাল বড় ধরনের বড়শিতে কিলোখানেক শুকরের মাংস ঢুকিয়ে ভালো করে দড়ি দিয়ে বেঁধে তিনি সেই বড়শিটাকে জলে নামালেন। বড়শি থেকে চার হাত দূরে রাখা হলো তার কাঠের ছাতনা। দড়ি জলে ফেলার পর তার এক দিকটা হাতে ধরে থাকা হলো।

জাহাজের নীচে জলে অনেকক্ষণ ধরে একটি জল-পুলিশের নৌকা অপেক্ষমান ছিল যার কাজ ছিল জাহাজ যাতে কোনোভাবে বন্দরকে না ছুঁতে পারে তা দেখা। সেই নৌকায় দুজন নিদ্রাচ্ছন্ন ছিলেন বলে এতক্ষণ যাত্রীরা তাদের ঘৃণা করলেও, পরে হাঙর ধরার সময় তিনি যাত্রীদের বন্ধু হয়ে যান। অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকির ফলে তাঁদের ঘুম ভাঙে এবং তারা বুঝতে পারেন যে এবারে ঐ টোপ ঝোলানো বড়শি আর ফাতনাটিকে বেশি দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলতে হবে।

সেই নৌকার জলপুলিশের মাঝিরা তাই করলেন। ফাতনাটির দিকে তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রেখে সকল যাত্রী উদ্গ্রীব হয়ে বসে রইলেন, কখন হাঙর ফাতনার টোপ গিলবে সেই আশায়। কিন্তু হাঙরের তো আর সহজে দেখা পাওয়া যায় না।

কিন্তু এই দুঃখও দীর্ঘস্থায়ী হল না বেশিক্ষণ।

জাহাজের অনতিদূরেই একটা বিশাল বড়ো জলপাত্রের আকারে মাথা দেখা গেল আর তখনই জাহাজের সব লোক একত্রে হইহই করে উঠলো হাঙর দেখার সাফল্যে। কেউ কেউ সকলকে চুপ করতে বললো কারণ শব্দে হাঙর পালিয়ে যেতে পারে। কেউ একজন আবার সাদা টুপি পরা যাত্রীদের টুপি খুলে ফেলতে বলেন কারণ সেই টুপির জন্য নাকি সামনে হাঙর দেখা যাচ্ছে না। আর ঠিক এই সময়েই লেখক লক্ষ্য করেন শূকরের মাংস খাওয়ার জন্য হাঙরটি সোঁ করে সামনে এসে পড়ে।

একবার পাক খেয়ে লেজ বেঁকিয়ে হাঙরটি আবার সেই টোপটির দিকে মুখ করে দাঁড়ায় আর এইরকমভাবেই দুই বার আসা-যাওয়ার পরে টুক করে হাঙর সেই টোপের মাংসটি মুখে পুরে দেয় এবং চিৎ হয়ে পড়ে থাকে। টোপ খাওয়া মাত্র জাহাজের লোকজন পঞ্চাশ-ষাট জন মিলে দড়ি টানতে থাকে, হাঙরের সঙ্গে তাদের জোরকদমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে লাগলো। কিন্তু অবশেষে হাঙরটি মুখ থেকে টোপটা ফেলে দিলো আর হাঙরটাও পালিয়ে গেল।

বোঝা গেল শেষে যে যাত্রীদের অতি উৎসাহের জন্যেই এমন ঘটেছে। ফলে বিগত কর্মের জন্য শোক করে লাভ নেই। লেখক এখানে মজা করে বলেছেন যে আড়কাঠি মাছেরা যে ঠিক খাবারের সন্ধান দেয়নি, সেই জন্য হয়তো বা হাঙরটি সেই আড়কাঠিদের কোনো শাস্তি দিতে পারে।

সেই হাঙরটির গায়ে ছিল কালো ডোরাকাটা দাগ যার দরুন লেখক তাকে ‘বাঘা’ নাম দিয়েছেন।

কিছুক্ষণ পরে আবার দেখা গেল যে বাঘা হাঙরটির গা ঘেঁষে আরেকটি হাঙর এই জাহাজের দিকেই তেড়ে আসছে যাকে স্বামী বিবেকানন্দ নাম দিয়েছেন ‘থ্যাবড়া’। স্বল্প বিদ্রুপের ভঙ্গিতে লেখক বলেছেন যে হাঙরদের সত্যিকারের কোনো ভাষা থাকলে বাঘা নিশ্চয়ই এই থ্যাবড়াকে সতর্ক করে দিতো যে টোপটি একটি মিথ্যে ফাঁদ। সেই বাঘা বহুদিন ধরে সমুদ্রে হাঙরগিরি করছে আর সেই সুবাদে কত মরা, জ্যান্ত বা আধমরা প্রাণী খেয়েছে, তার ছোটো-বড়ো হাড়-গোড় সবই চিবিয়ে এককালে হজম করেছে।

কিন্তু সেই টোপের মাংসটার কি শক্ত হাড়, বাঘার দাঁতগুলিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই মুখ ব্যাদান করে বাঘা নিশ্চয়ই থ্যাবড়াকে সতর্ক করে দিতো। আর সেই সময়েই থ্যাবড়াও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির মতো বাঘাকে চ্যাং মাছের পিত্ত, কুঁজো ভেটকি মাছের প্লিহা, ঝিনুকের ঠান্ডা সুরুয়া ইত্যাদি পথ্য খেতে বলতো। কিন্তু বাঘা তা করেনি, এগুলির একটা ঘটনাও ঘটেনি মানে বুঝে নিতে হবে যে হয় হাঙরদের ভাষা নেই আর নাহলে সে মানুষের স্বভাব পেয়েছে। অর্থাৎ সে ইচ্ছে করেই থ্যাবড়াকে প্রকৃত খবর না জানিয়ে মুচকি হেসে শুধু নিয়মমাফিক কুশল বিনিময় করেই সরে পড়তো। একা শুধু নিজে ঠকার বদলে সে তাহলে চাইতো যে অন্য কেউও তাঁরই মতো ঠকুক।

ভগীরথ যেভাবে শঙ্খ বাজিয়ে যান গঙ্গার আগে আগে, সেভাবেই আড়কাঠি মাছও চলেছে হাঙরের সামনে দিয়ে। আড়কাঠির পিছনে বিশালদেহী থ্যাবড়া আসছে এই জাহাজের দিকেই। তার লক্ষ্য ঐ মাংস ঝোলানো টোপ। মাংসের গন্ধ পুরো সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। বড়শিতে গাঁথা শূকরের মাংস যেভাবে জলের মধ্যে দুলছে তাতে লেখকের মনে হয়েছে সেটি যেন গোপীমণ্ডলমধ্যস্থ কৃষ্ণ। অর্থাৎ গোপিনীদের মাঝে যেভাবে কৃষ্ণ দোলনায় দোলেন, সেভাবেই এই মাংসখণ্ডটিও জলে সেভাবেও দুলছে। অদ্ভুত উপমার কারিকুরি ছড়িয়ে থাকে স্বামী বিবেকানন্দের লেখায়।

ঠিক এরপরেই হাঙরটিকে একেবারে জাহাজের কাছাকাছি চলে আসতে দেখা যায় এবং তাকে দেখে সকলেই সতর্ক হয়ে যান। একবার ভুল হয়েছে, এবারে যাতে আর না হয়। কেউই বিশেষ তাড়াহুড়ো করতে চায় না। বড়শির কাছে খানিক ঘুরপাক খেয়ে সেই থ্যাবড়ামুখো হাঙরটা টোপটা মুখে নিলো এবং চিৎ হয়ে শুয়ে সেটা গিলতে শুরু করলো। আর ঠিক সেই সময়েই কাছিতে টান মারলো সকলে। আর যেই মাত্র সেই হাঙরটা মুছ ঝাড়া দিয়ে টোপটা মুখ থেকে ফেলে দিতে চাইলো, তখনই উলটো বিপত্তি দেখা দিলো। বড়শিটা একেবারে তার শরীরে বিঁধে গেল, আর ছাড়াতে পারলো না থ্যাবড়ামুখো হাঙর। হাঙরের ঠোঁট বড়শিতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল।

এবারে হাঙরকে জাহাজে তোলার পালা।

এক আরবি জল-পুলিশ হাঙরের ল্যাজে দড়ি বেঁধে দিল আর প্রবল টানাটানিতে হাঙরের পেট থেকে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে ঝুলতে লাগলো। এক যাত্রী সেগুলি কেটে দেওয়ায় ভার একটু কমে, নাহলে এত বিশাল জন্তুকে দড়ি দিয়ে টেনে জাহাজে তোলা নিতান্তই দুঃসাধ্য ছিল। যাত্রীরা সকলেই সেই জল-পুলিশদের হাঙরের লেজের ঝাপটার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। অবশেষে অনেক কসরত করে হাঙরটিকে তোলা হল জাহাজে। তার পেট কাটা হলে একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড। রক্তে ভেসে যায় জাহাজের ডেক। তার আগে যদিও ভীত যাত্রীদের আশঙ্কা দূর করতে গায়ে কাপড়ে রক্তমাখা অবস্থাতেই সেই ফৌজি লোকটা কাঠের তক্তা দিয়ে দু-চার ঘা হাঙরের মাথায় মেরে সেটিকে মেরে ফেলেন পুরোপুরি। কাটা শরীর, বিচ্ছিন্ন খণ্ড হওয়া সত্ত্বেও হাঙরটি কিছুক্ষণ ধরে কাঁপছিল।

এই বীভৎস কাণ্ডকারখানা দেখে মহিলারা ভয় পেয়েছিলেন, স্বামীজির নিজেরই সেদিন খাওয়া-দাওয়া পন্ড হয়েছিল। সবেতেই তিনি হাঙরের গন্ধ পাচ্ছিলেন।

এই রোমাঞ্চকর হাঙর শিকারের বর্ণনা দেওয়ার পরে লেখক রচনাটিকে অন্যতর মাত্রা দিলেন ইতিহাস বর্ণনার মধ্য দিয়ে। ফার্দিনান্দ লেসেপ্সের স্থাপিত এই সুয়েজ খালের স্থাপত্যকীর্তির কথা তিনি এই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেন এবং স্বীকার করেন যে এই সুয়েজ খাল স্থাপনের ফলেই ইউরোপ আর ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের বহু সুবিধে হয়েছে।

এই প্রসঙ্গেই লেখকের বর্ণনায় উঠে এসেছে প্রাচীনকালের ভারত-ইউরোপের আমদানি-রপ্তানির কথা।

ভারত থেকে আগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি হতো পাট, সুতির কাপড়, তুলো, নীল, চাল, হিরে, পশমিনা, লবঙ্গ, এলাচ, মরিচ, জায়ফল ইত্যাদি কত কী! স্থলপথে ইরান-আফগানিস্তান হয়ে অথবা জলপথে লোহিত সাগর হয়ে এই বাণিজ্য চলতো। কিন্তু লেখক এখানে ইতিহাসের উপাত্ত স্মরণ করে লেখেন যে, তুর্কিরা রোম সাম্রাজ্য দখল করে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে দেয় এবং তাই ক্রিস্টোফার কলম্বাস ভারতে আসার নতুন এক পথ আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি পৌঁছান উত্তর আমেরিকায়। এই জন্যেই আমেরিকার আদিম উপজাতিদের বলা হয় ‘রেড ইণ্ডিয়ান’।

বিশ্ববীক্ষার প্রজ্ঞায় স্বামীজি লেখেন সিন্ধুনদকে ইরানিরা ডাকতো ‘ইন্দু’ আর গ্রিকরা বলতো ‘ইণ্ডুস’। এই থেকেই নাকি সিন্ধু-তীরবর্তী ভারতবর্ষের নাম হয় ‘ইণ্ডিয়া’।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

দশম অনুচ্ছেদে ভৌগোলিক আবিষ্কারের নানা প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে লেখক জানিয়েছেন যে পোর্তুগিজরা যখন ভারতে আসার নতুন পথের সন্ধান পেল, তখন সেই পথ দিয়ে ভারতে আসতে লাগলো ফরাসিরা, দিনেমাররা, ওলন্দাজ ও ইংরেজরা। এদের মধ্যে ইংরেজরাই ভারতের একদা প্রতিভূ হয়ে উঠলো। কিন্তু এখন বিশ্বের বাজারে ভারতের সেই কদর বা চাহিদা একেবারেই বিলুপ্ত। প্রাচীনকালে ভারতকে লুঠ করেই পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি সব সমৃদ্ধিশালী হয়েছে তা এখন আর কেউ স্বীকার করে না। এই চরম অবমাননা ভারতের পক্ষে গ্লানির।

একাদশ অনুচ্ছেদে এসে আমরা দেখতে পাই ভারতের শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি স্বামীজি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন এবং একইসঙ্গে চাষি, তাঁতি, জোলা প্রভৃতিদের নিরলস পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ব্যাবিলন, ইরান, ইরাক, গ্রিস, রোম, ফরাসি কিংবা ব্রিটিশ সব সভ্যতার ঐশ্বর্যের মূলে এই শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের অবদান থাকলেও তারা নিজের পরিশ্রমের ফল পায় না। মন্দিরের ভাস্কর্য নির্মাণ করে খ্যাতি পায় রাজা, কিন্তু মূল নির্মাতার পরিচয় কেউ জানে না। এই চিরপদদলিত শ্রমজীবী মানুষকে তিনি মনুষ্যসমাজের ভারবাহী বলে মনে করেছেন।

অন্তিম অনুচ্ছেদে সুয়েজ খালের বর্ণনায় ফিরে এসেছেন লেখক।

প্রাকৃতিক উপায়ে অনেকগুলি লবণাক্ত ধারা এসে মিশে এই খাত তৈরি হয়েছে। ফরাসিরাই বহু অর্থব্যয় করে এই খালটিকে গভীরভাবে খনন করান। এতে বিজ্ঞানচিন্তা ও প্রযুক্তির ব্যবহারও লক্ষণীয়। একবারে একটিমাত্র জাহাজই পণ্য নিয়ে পেরোতে পারে এই সুয়েজ খাল আর বিপরীত দিক থেকে আসা দুটি জাহাজ যাতে কোনোভাবেই না সংঘর্ষ করে তার জন্য খালের অনেকগুলি বিভাজন করা হয়েছে। প্রত্যেক ভাগের মুখের কাছে প্রশস্ত করা হয়েছে যাতে দু-তিনটি জাহাজ সেখানে অপেক্ষা করতে পারে।

কোনো জাহাজ খালে প্রবেশ করা মাত্রই ভূমধ্যসাগরের মুখে থাকা প্রধান অফিস থেকে তার মাধ্যমে খবর যেতে থাকে কটা জাহাজ আসছে এই সংক্রান্ত। এক স্টেশনের নির্দেশ ছাড়া কোনো জাহাজই অন্য স্টেশনে যেতে পারে না। এই নিখুঁত জাহাজ পারাপারের পরিকল্পনা দেখে সত্যই অভিভূত হয়েছিলেন স্বামীজি। ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার প্রভাবও পড়েছিল এই সুয়েজ খালের উপরে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → সুয়েজখালে : হাঙর শিকার | বিশদে আলোচনা

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XI-Beng-Suyejkhale-Hangor-Shikar-1