পদার্থবিদ্যা – একাদশ শ্রেণি – তাপ সঞ্চালন (অধ্যায়- পদার্থের ধর্মসমূহ)
আমরা জানি যে, পরস্পরের কাছাকাছি থাকা দুটি বস্তুর মধ্যে বা একই বস্তুর বিভিন্ন অংশের মধ্যে যদি উষ্ণতা বা তাপমাত্রার পার্থক্য থাকে, তাহলে উষ্ণ জায়গা থেকে শীতল জায়গার দিকে তাপের প্রবাহ হবে।
এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তাপ সঞ্চালনের তিনটি পদ্ধতি আছে। যথা-
(i) পরিবহণ (Conduction)
(ii) পরিচলন (Convection)
(iii) বিকিরণ (Radiation)
পরিবহণ (Conduction)
যে প্রণালীতে কোনো পদার্থের উষ্ণতর অংশ থেকে শীতলতর অংশে তাপ সঞ্চালিত হয়। অথচ তার জন্য পদার্থের অণুগুলি কোনো স্থান পরিবর্তন হয় না, তাকে পরিবহণ বলা হয়। সাধারণত কোনো কঠিন পদার্থে তাপ সঞ্চালন পরিবহণ প্রণালীতে হয়ে থাকে।
একটু উদাহরণের মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটা বলা যাক।
একটি লোহার দন্ডের একপ্রান্ত আগুনের মধ্য দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই উহার অপরপ্রান্ত এতটাই গরম হয়ে যায় যে হাত দিয়ে ধরা মুশকিল হয়ে পড়ে। কঠিন পদার্থের অণুগুলি ঘনসংঘবদ্ধ অবস্থায় থাকে। দণ্ডের যে প্রান্ত আগুনের সংস্পর্শে থাকে ওই প্রান্তের অণুগুলি উৎস থেকে তাপগ্রহণ করে উত্তপ্ত হয়।
একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
উত্তপ্ত কণাগুলি তাদের তাপের কিছু অংশ তার পার্শ্ববর্তী শীতল কণাগুলিকে দেয়। তারা আবার উত্তপ্ত হয়ে তাদের পাশের শীতল কণাগুলিকে তাপ দেয়। এইভাবে ধীরে ধীরে পরের পর কণাগুলি উত্তপ্ত হতে থাকে এবং তাপ উৎস থেকে সঞ্চালিত হয়ে দণ্ডের অপর প্রান্তে পৌঁছায়। তাপ সঞ্চালনের এই পদ্ধতিই হল পরিবহণ পদ্ধতি।
এই পদ্ধতিতে তাপ সঞ্চালনের সময় দণ্ডের কণাগুলি কোনো স্থানচ্যুতি হয় না। পদার্থের গতিতত্ত্ব থেকে পরিবহণ পদ্ধতিতে তাপ সঞ্চালনের ঘটনাটি সহজে ব্যাখ্যা করা যায়। কঠিন পদার্থের অণুগুলি ঘন সংঘবদ্ধ অবস্থায় থাকে এবং তাদের মধ্যে ভীষণ জোর আকর্ষণ বল ক্রিয়া করে ফলে অণুগুলি সহজে স্থানচ্যুত হতে পারে না। নিজ অবস্থানে থেকে একটি মধ্য অবস্থানের দুদিকে কম্পন করে। এভাবে কঠিন পদার্থের অণুগুলির গতি বজায় থাকে।
একটি কঠিন বস্তুর কোনো অংশে যখন তাপ দেওয়া হয় তখন বস্তুটির ঐ অংশের অণুগুলি কম্পনের বেগ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। অণুগুলি তখন অপরিবর্তিত মধ্য অবস্থানের দুদিকে বেশি বিস্তার নিয়ে দ্রুত কম্পিত হয়ে থাকে।
এই দ্রুত কম্পনের জন্য পাশের অণুগুলির সাথে তাদের আরও বেশি সংঘর্ষ হতে থাকে। সংঘর্ষের সময় তাদের দ্রুত কম্পনজনিত গতিশক্তির কিছু অংশ পরবর্তী অণুগুলিতে সঞ্চালিত হয়। এইভাবে তাপজনিত গতিশক্তি বা তাপস্তর থেকে স্তরান্তরে সঞ্চালিত হয় এবং বস্তুটির দূরতম প্রান্তে পৌঁছে যায়। এই পদ্ধতিতে তাপ সঞ্চালনের সময় পদার্থের অণুগুলি স্থান ত্যাগ করে না, কেবলমাত্র উষ্ণ থেকে অপেক্ষাকৃত শীতল স্থানে গতিশক্তির বা তাপের প্রবাহ ঘটে থাকে।
পরিচলন (Convection)
যে প্রণালীতে পদার্থের উত্তপ্ত অণুগুলি নিজেরাই উষ্ণতর অংশ থেকে শীতলতর অংশে গিয়ে তাপ সঞ্চালিত করে তাকে পরিচলন বলে। প্রবাহী তরলের ক্ষেত্রে অর্থাৎ তরল ও বায়বীয় পদার্থের ক্ষেত্রে তাপ সঞ্চালন প্রধানত পরিচলন পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। একটি জলপূর্ণ পাত্রে নীচের দিক থেকে তাপ দিলে তাপ মূলতঃ পরিচলন পদ্ধতিতেই উপরের স্তরগুলিতে পৌঁছায়।
তরল বা বায়বীয় পদার্থকে উত্তপ্ত করলে তাদের আয়তন বৃদ্ধি পায় এবং ফলে ঘনত্ব কমে। ঘনত্ব কমে যাওয়ার ফলে তারা হাল্কা হয়ে উপরে উঠে যায় এবং উপরের শীতল অংশ অপেক্ষাকৃত ভারী হয় বলে নীচে নেমে আসে এবং শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করে। এইভাবে তরল বা বায়বীয় পদার্থকে উত্তপ্ত করলে তাদের মধ্যে একটি প্রবাহের সৃষ্টি হয়। এই প্রবাহকে বলা হয় পরিচলন প্রবাহ বা পরিচলন স্রোত।
একাদশ শ্রেণি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
পরিচলন পদ্ধতি সংক্রান্ত কিছু তথ্য
১। এই পদ্ধতিতে তাপ নীচের দিকে বা পাশের দিকে যেতে পারে না, কেবলমাত্র উপরের দিকেই যায়।
২। যে জায়গায় অভিকর্ষ বলের মান ‘শূন্য’ সেই স্থানে এই পদ্ধতিতে তাপ সঞ্চালন সম্ভব নয়।
৩। কঠিন পদার্থের অণুগুলি স্থানত্যাগ করতে পারে না বলে কঠিন পদার্থের ক্ষেত্রে পরিচলন সম্ভব নয়।
বিকিরণ (Radiation)
যে প্রণালীতে কোনো জড় পদার্থের বা মাধ্যমের সাহায্য না নিয়ে বা জড় মাধ্যম থাকলেও তাকে উত্তপ্ত না করে তাপ একস্থান থেকে অন্যস্থানে সঞ্চালিত হয় তাকে বিকিরণ বলা হয়। বিকিরণ পদ্ধতিতে সূর্য থেকে তাপ পৃথিবীতে পৌঁছায়।
প্রকৃতপক্ষে যে কোনো উত্তপ্ত বস্তুই তাপ বিকিরণ করে। এই বিকির্ণ তাপের সঙ্গে আলোর সাদৃশ্য আছে।
বিকীর্ণ তাপের ধর্ম
১) আলোর মতো বিকীর্ণ তাপ উত্তপ্ত বস্তু থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
২) বিকীর্ণ তাপ আলোর মতো শূন্য স্থানে চলাচল করতে পারে। সূর্য এবং পৃথিবীর ভিতর বেশিরভাগ জায়গা শূন্য সূর্য থেকে পৃথিবীতে বিকিরণ পদ্ধতিতেই তাপ পৌঁছায়।
৩) আলোর মতো বিকীর্ণ তাপ সরলরেখায় চলে। তাই ছাতা খুলে সূর্যের তাপের হাত থেকে দেহকে আড়াল করে রাখা যায়।
৪) আলোর মতো বিকীর্ণ তাপেরও প্রতিফলন এবং প্রতিসরণ হয়। লেন্স দিয়ে সূর্যরশ্মি প্রতিসৃত করে কোনো কাগজকে পোড়ানো যায়।
৫) বিকীর্ণ তাপের গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমান হয়। প্রকৃত অর্থে বিকীর্ণ তাপ আলোর মতো তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ।
একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
তরঙ্গের মাধ্যমে যে শক্তি পরিচালিত হয়, তাকে সাধারণভাবে বিকীর্ণ শক্তি বা শক্তি বস্তু নিরপেক্ষ ভাবে অবস্থান করে। কিন্তু যখনই কোনো বস্তু বিকিরণকে শোষণ করে তখন তা ঐ বস্তুর অণুগুলির তাপশক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
বিকিরণের বিকল্প সংজ্ঞা নিম্ন লিখিতভাবে দেওয়া যেতে পারে। উষ্ণতার জন্য বস্তু বিকিরণের আকারে যে শক্তি নির্গত করে তাকে তাপীয় বিকিরণ বলা হয়।
তাপ সঞ্চালনের তিনটে পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য
১। পরিবহণ ও পরিচলনের জন্য কোনো জড় মাধ্যমের (কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় পদার্থের) প্রয়োজন কিন্তু বিকিরণ ওই রকম কোনো মাধ্যমের সাহায্য না নিয়েও হতে পারে।
২। পরিবহণ বা পরিচলন খুব ধীর প্রক্রিয়া কিন্তু বিকিরণ অতিশয় দ্রুত পদ্ধতি। বিকিরণ পদ্ধতিতে তাপ আলোর গতিবেগ সমান বেগে সঞ্চালিত হয়।
৩। বিকিরণ পদ্ধতিতে তাপ মাধ্যমকে উত্তপ্ত করে না কিন্তু পরিবহণ বা পরিচলন পদ্ধতিতে তাপ যে মাধ্যম অবলম্বন করে চলাচল করে তাকে উত্তপ্ত করে।
৪। বিকিরণ পদ্ধতিতে তাপ সরলরেখায় সবদিকে চলাচল করে কিন্তু পরিবহণ বা পরিচলন পদ্ধতিতে তাপ বক্রপথে চলাচল করে। সূর্যের তাপ নিবারণ করার জন্য আমরা গরমকালে ছাতা ব্যবহার করি। ছাতার পাশ থেকে তাপ বক্রপথে আমাদের দেহে আসে না। অর্থাৎ বিকীর্ণ তাপ সরলরেখায় চলে।
ডেভির নিরাপত্তা বাতির কার্যনীতি
খনির অভ্যন্তরে দাহ্য গ্যাসে আগুন যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে তার জন্য শ্রমিকরা খনির ভিতরে গিয়ে কাজ করার সময় এই ধরনের বাতি ব্যবহার করে থাকেন। ধাতব তার জালির উচ্চ তাপ পরিবহণ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানী স্যার হামফ্রে ডেভি এই ধরনের বাতির পরিকল্পনা করেন।
এটি একটি সাধারণ তেলের বাতি কিন্তু এর শিখাকে বেষ্টন করে তার জালি লাগানো থাকে। খনির ভিতরে কোনো দাহ্য গ্যাস থাকলে জালির ফাঁক দিয়ে তার ভিতরে প্রবেশ করে এবং শিখার সংস্পর্শে এসে জ্বলতে থাকে। এর ফলে উৎপন্ন তাপ, সুপরিবাহী ধাতব তারজালির দ্বারা এর দ্রুত পরিবাহিত হয় যে, তারজালি বা বাইরের দাহ্য গ্যাস কোনোটিরই উষ্ণতা কখনোই দাহ্য গ্যাসের জ্বলনাঙ্ক বা ignition temperature পর্যন্ত পৌঁছায় না। তার ফলে বাইরের দাহ্য গ্যাসে আগুন লাগাতে পারে না। বাতির ভিতরে দাহ্য গ্যাস যখন জ্বলে তখন বাতির শিখাটির রং বদলে যায়। তাই শিখার রং দেখেও খনিতে দাহ্য গ্যাসের অস্তিত্ব বুঝতে পারা যায়।
বাতিটি যদি দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলে তাহলে তার জালিটির উষ্ণতা দাহ্য গ্যাসের জ্বলনাঙ্কে পৌঁছাতে পারে। তাই বাতিটিতে এমন পরিমাণ তেল নেওয়া হয় যাতে তার জালিটি বেশী উত্তপ্ত হবার আগেই বাতিটি নিভে যায়। তবে বর্তমানে ডেভির নিরাপত্তা বাতি ব্যবহার না করে বৈদ্যুতির বাতির ব্যবহার বহুল প্রচলিত।
ডেভির নিরাপত্তা বাতি হল তাপ পরিবহণ পদ্ধতির একটি ব্যবহারিক প্রয়োগ।
পর্ব সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখিকা পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয় এবং IIT খড়গপুরের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তনী স্বধীতি মাঝি। পদার্থবিদ্যা চর্চার পাশাপাশি ছবি আঁকা, গান গাওয়া এবং বই পড়ায় সমান উৎসাহী স্বধীতি।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XI_P_7.11a