শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: ইতিহাস । অধ্যায় – ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা (তৃতীয় অধ্যায়)
পিটের ভারত শাসন আইনের (1784 সালে) দ্বারা ভারতের শাসন ব্যবস্থাকে সাজানোর যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, তাকে আরো জোরালো করতে প্রয়োজন সম্পদ। আবার দেশ চালাতে যে সম্পদ প্রয়োজন তা জোগাড় করতে দেশে সুশাসন প্রয়োজন। 1813 খ্রিঃ এর আগে পর্যন্ত কোম্পানি মুঘলদের বা বলা ভালো ভারতীয়দের মত করেই দেশ শাসন করত। কিন্তু, ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারে এই শাসন পদ্ধতিতে অনেক ফাঁক রয়েছে। তাই ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব যথাযথভাবে কায়েম করতে কোম্পানি, গোটা দেশে শাসন পরিকাঠামো, শিক্ষা এবং রাজস্ব ব্যবস্থাকে পাশ্চাত্য ধাঁচে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হয়।
এই অধ্যায়ের প্রথম পর্ব → ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা
পুলিশ ব্যবস্থা
ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে মুঘলের অনুকরণে যে শাসন পরিকাঠামো গঠন করা হয়েছিল সেখানে ফৌজদার, কোতওয়াল চৌকিদারদের ক্ষমতা ছিল বেশি। এই ব্যবস্থায় ছেদ টানে 1770 সালে ভয়ঙ্কর মন্বন্তর। যার জেরে শাসন পরিকাঠামো ভেঙে পড়তে শুরু করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেশ শাসন সমস্যার মুখে পড়ে। ধীরে ধীরে 1781 সালের পর থেকে পুরনো ব্যবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। যার মধ্যে ফৌজদারদের পরিবর্তে স্থান পায় ম্যাজিস্ট্রেট। এরপর লর্ড কর্নওয়ালিশের সময় থেকে পুলিশ থানা ও দারোগা ব্যবস্থা শুরু হয়। এই দারোগারাই হয়ে ওঠে ম্যাজিস্ট্রেট ও গ্রামের মানুষদের মধ্যের যোগসূত্র।
জমিদার ও দারোগার যৌথ চাপে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ফলে বলা যায়, এই পদ্ধতিতেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়না।
1843 খ্রিঃ সিন্ধু প্রদেশে সর্বপ্রথম নতুন রূপে পুলিশ ব্যবস্থা গঠন করা হয় এবং নতুন করে পুলিশ আইন বানানো হয়।
সেনাবাহিনী
ভারতীয় উপনিবেশে শাসনকার্য পরিচালনা করার বিশেষ কিছু বাধা ছিল। দেশের অভ্যন্তরে মুঘল ছাড়াও ছিল বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজশক্তি, আবার দেশের বাইরে ছিল অন্যান্য বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ। এই উভয় সমস্যা ছাড়াও দেশের সাধারণ মানুষের অসন্তোষও ছিল। সব শত্রু দমন করে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবার আগে যেটা প্রয়োজন তা হল দক্ষ সেনাবাহিনী। ব্রিটিশ শক্তি শাসনের প্রথমেই বুঝে ছিল সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা, তাই তারা প্রথম থেকেই সেনাবাহিনী গঠনে মন দেয়। এই সৈন্যবাহিনী ‘সিপাহি বাহিনী’ নামেও পরিচিত ছিল।
সেনাবাহিনী গঠনে মুঘলদের মত তারাও উচ্চবর্ণের মানুষদেরই প্রাধান্য দিয়েছিল। ব্রাহ্মণ, রাজপুত ইত্যাদি উচবর্ণের মানুষেরা সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেত। যা সমাজের বিভাজনকে আরো বাড়িয়ে দেয়। যদিও পরবর্তীকালে এই সিপাহিবাহিনীতে বেশ কিছু পাহাড়ি উপজাতি, নেপালি, গোর্খাদের নিয়োগ করা শুরু হয়।
আমলাতন্ত্র
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে আমলাদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রশ্ন হল আমলা কারা? আমলা হল সরকারী আধিকারিক বা বলা যায় সরকারের দূত। যাদের সাহায্যে দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসকরা দেশের সব জায়গায় শাসন পরিচালনা করেন।
লর্ড কর্ণওয়ালিশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রচলন করেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে আমলা বা আধিকারিক নিয়োগ হত। পরবর্তী প্রশাসক লর্ড ওয়েলেসলি 1800 খ্রিঃ এই সিভিল সার্ভেন্টদের প্রশিক্ষণের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও পরবর্তীকালে এই প্রশিক্ষণ ইংল্যান্ডের হেইলবেরি কলেজে হত।
[জেনে রাখো, এই সময় ভারতীয়দের সিভিল সার্ভেন্ট হিসাবে নিয়োগ করা হতনা।]
শিক্ষাব্যবস্থা
যে কোনো দেশে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন, সেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই বিষয়টি শুরুতেই উপলদ্ধি করেছিল। তাই শুরু থেকেই তারা পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে ভারতীয়দের পরিচয় ঘটিয়েছিল।
তারা এই বিরাট দেশে শিক্ষা বিস্তারের জন্য এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিল যা ‘চুঁইয়ে পড়া তত্ত্ব’ নামে খ্যাত।
এই তত্ত্ব অনুসারে শিক্ষার বিস্তার সমাজের উপর স্তরে করলেই তা ধীরে ধীরে সমাজের নিম্নস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে শিক্ষা বিস্তারের শুরুতে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থাকে আরো ভালভাবে চিনতে তারা প্রথমে ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম আইনগুলোকে ইংরাজিতে অনুবাদ করে। এরফলে ব্রিটিশ প্রশাসকরাও ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে।
এরপর হেস্টিংস কলকাতায় 1781 খ্রিঃ মাদ্রাসা গঠন করেন, প্রশাসনিক কাজে ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্তি ঘটানোর জন্য তারা শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। 1784 খ্রিঃ কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা, সেই প্রচেষ্টাকে আরো জোরালো করে। 1791 খ্রিঃ জোনাথন ডানকান বেনারসে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর মাধ্যমে যাতে ভারতের শিক্ষিত ব্যাক্তিরা ব্রিটিশ শাসনে সহায়তা করতে পারে, তাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
উনবিংশ শতকের গোড়া থেকেই কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করে। এদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য রাজা রামমোহন রায়, স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের প্রচেষ্টায় 1817 খ্রিঃ হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা (বর্তমানে প্রেসিডেন্সী ইউনিভার্সিটি)। 1829 সালে আলেকজান্ডার ডাফের উদ্যোগে বহু স্কুল নির্মিত হয়। 1830 সালে জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইন্সটিটিউশন গড়ে ওঠে।
1835 খ্রিঃ দুটি কারণে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, এই বছর স্যার মেকলে মিনিটের উদ্যোগে ইংরাজিকে ভারতীয় শিক্ষা ও কাজকর্মের মূল ভাষা হিসাবে স্বীকৃত করা হয়,
দ্বিতীয়ত, এই বছরই কলকাতায় গড়ে ওঠে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাইলস্টোন ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজ।
এই দুটি ঘটনা ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। শিক্ষাব্যবস্থা আরো বেশি পাশ্চাত্য ঘেঁষা হয়ে ওঠে। যা বহু ভারতীয়কে ব্রিটিশ শাসনের অনুগামী করে তোলে। আবার ভারতীয় শিক্ষিত সমাজকে বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে অবগত করে।
[জেনে রাখো, ব্রিটিশরা ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে মূলত একদল ভারতীয় অনুগত কর্মচারী শ্রেণী বানাতে চেয়েছিল। প্রাথমিকভাবে সফলতা পেলেও পরবর্তীকালে এই শিক্ষার প্রসারতাই তাদের বিরূদ্ধে ভারতবাসীকে জাগিয়ে দেয়। পরাধীন দেশবাসী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে ধারণা লাভ করে এবং স্বাধীনতা পাওয়ার বাসনায় মরিয়া হয়ে ওঠে।]
এরপর উডের ডেসপ্যাচের ভিত্তিতে 1857 সালে ভারতের তিন প্রান্তে যথাক্রমে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বম্বেতে গড়ে ওঠে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষাব্যবস্থায় এই পরিবর্তন শুধুমাত্র পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। বিদ্যাসাগর, বীটন (বেথুন) সাহেব প্রমুখের উদ্যোগে নারীজাতির মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
রাজস্ব ব্যবস্থা
1757 খ্রিঃ পলাশির যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয়ের পর, লর্ড ক্লাইভ বাংলার ২৪ টি পরগণার জমিদারির দায়িত্ব পায়। এরপর থেকেই সর্বপ্রথম জমি জরিপের কাজ শুরু হয়।
এতো গেল জমি জরিপের কথা, এরপরে চলে আসি জলপথ জরিপে। 1764 খ্রিঃ জেমস রেনেলের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম বাংলার নদী জরিপের কাজ শুরু হয়। পরবর্তীকালে 1767 খ্রিঃ জেমস রেনেল ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হন।
[জেনে রাখো, সেইসময় নদীপথে সর্বপ্রথম ১৬ টি মানচিত্র তিনি তৈরি করেছিলেন।]
বক্সারের যুদ্ধে 1764 খ্রিঃ পর গঠিত হয় রাজস্ব সংক্রান্ত একটি নতুন কমিটি, যা কমিটি অব রেভেনিউ নামে খ্যাত। 1786 খ্রিঃ ঐ কমিটির নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় বোর্ড অভ রেভেনিউ। যারা রাজস্ব সংক্রান্ত সব বিষয় দেখাশোনা করত।
এরপর 1790 সালে শুরু হয় ‘দশসালা বন্দোবস্ত’। কিন্তু ব্যবস্থাগুলিও বিভিন্ন সমস্যার কারণে বন্ধ করে 1793 সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশ চালু করেন ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। শুরু হয় রাজস্ব ব্যবস্থার একটি নতুন অধ্যায়।
পর্ব সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখিকা পরিচিতিঃ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করতে ভুলো না।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
VIII_His_3b