shila
WB-Class-8

শিলা

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: ভূগোল । অধ্যায় – শিলা

আগের পর্বে আমরা জেনেছি অস্থিত পৃথিবী সম্পর্কে। এই পর্বে আমরা শিলা সম্পর্কে আলোচনা করবো।

পৃথিবীর উপরিভাগের ভূত্বক যে শক্ত আবরণে ঢাকা তা হল শিলা।
প্রকৃতিতে প্রাপ্ত এক বা একাধিক খনিজের সমসত্ব বা অসমসত্ব মিশ্রণকে শিলা বলে। শিলা তৈরির মূল উপাদানকে খনিজ পদার্থ বলে। শিলার মধ্যে অবস্থিত নির্দিষ্ট রাসায়নিক সংযুতিবিশিষ্ট ও নির্দিষ্ট পারমাণবিক গঠনযুক্ত মৌলিক বা যৌগিক পদার্থকে খনিজ বলা হয়। যেমন – গ্রানাইট শিলা কোয়ার্টজ, ফেল্ডস্পার, মাইকা ইত্যাদি দিয়ে গঠিত। আবার চুনাপাথর ক্যালসাইট বা অ্যারাগোনাইট খনিজ দিয়ে গঠিত।

প্রকৃতিতে প্রাপ্ত শিলাসমূহের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য

১. নুড়ি, পাথর, মাটি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি উপাদানগুলিও শিলার অন্তর্গত।
২. শিলার প্রবেশ্যতা বলতে শিলার মধ্যে দিয়ে তরল বা গ্যাসীয় পদার্থ প্রবেশ করার ক্ষমতা। প্রবেশ্যতা বেশি হলে জলধারণ ক্ষমতা।
৩. শিলার মধ্যেকার শুন্যস্থান, আয়তনের অনুপাত কমবেশি হলে শিলার সছিদ্রতা কমে বা বাড়ে। সছিদ্রতা বেশি হলে জলধারণ ক্ষমতা বাড়ে।

শিলার উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে একে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা – ১. আগ্নেয় শিলা ২. পাললিক শিলা ৩. রূপান্তরিত শিলা।

আগ্নেয় শিলা

ভূ-অভ্যন্তরের উত্তপ্ত আগ্নেয় পদার্থ, যেমন ম্যাগমা এবং ভূপৃষ্ঠে নির্গত লাভা জমাট বেঁধে যে শিলার সৃষ্টি হয় তাকে আগ্নেয় শিলা বলে। পৃথিবীর উৎপত্তির সময় তরল থেকে কঠিন অবস্থায় পরিণত হওয়ায় প্রথম যে কঠিন আবরণ বা ভূত্বক তৈরি হয় সেটা আগ্নেয় শিলা, এটি প্রথম সৃষ্টি হওয়া শিলা বলে একে প্রাথমিক শিলাও বলে। ভূ-অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধাতব পদার্থ বিশেষত সিলিকন, লোহা, নিকেল, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি লাভা রূপে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে এসে আগ্নেয় শিলার সৃষ্টি করে।

গাঠনিক দিক থেকে আগ্নেয় শিলায় কিছু বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যায়, যেমন:
• এই শিলা শক্ত ও ভারী, ঘনত্ব খুব বেশি।
• কেলাসের মত দানাযুক্ত গঠন দেখা যায়।
• এই শিলায় উল্লম্ব দারণ ও ফাটল থাকায় এর প্রবেশ্যতা বেশি।
• ভঙ্গুরতা যথেষ্ট কম হওয়ায়, ক্ষয় প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।

উৎপত্তি অনুসারে আগ্নেয় শিলা দুইপ্রকারের, যথা – নিঃসারী এবং উদবেধী আগ্নেয় শিলা।

নিঃসারী আগ্নেয় শিলা

ভূগর্ভের গলিত, উত্তপ্ত ম্যাগমা অত্যধিক চাপে যখন ভূত্বকের কোন দুর্বল ফাটলের মধ্যে দিয়ে বাইরে এসে তরল লাভারূপে ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত হয়। বাতাসের সংস্পর্শে এসে এই লাভা শীতল ও কঠিন হয়ে যে আগ্নেয় শিলার সৃষ্টি করে তার নাম আগ্নেয় শিলা। খুব দ্রুত জমাট বাঁধার জন্যে এর দানাগুলো বেশ সূক্ষ্ম হোয়। যেমন – ব্যাসল্ট, অবসিডিয়ান।

উদবেধী আগ্নেয় শিলা

অনেকসময় ভূগর্ভস্থ উত্তপ্ত তরল ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠে পৌঁছোতে না পেরে ভূগর্ভের ভিতরেই দীর্ঘকাল ধরে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে কঠিন শিলায় পরিণত হয়। এই ধরণের শিলাকে উদবেধী আগ্নেয় শিলা বলে। যেমন – গ্রানাইট, ডলোরাইট।

প্রকৃতিতে উদবেধী আগ্নেয় শিলা আবার দুই প্রকারের পাওয়া যায়,
১. ম্যাগমা ভূ-অভ্যন্তরের কোন ফাটলের মধ্যে যখন ধীরে ধীরে শীতল ও কঠিন হয়ে জমাট বাঁধে তখন তাকে উপপাতালিক শিলা বলে। যেমন – ডলোরাইট।
২. ভূ-অভ্যন্তরের একবারে তলদেশে অবস্থিত ম্যাগমা ধীরে ধীরে কঠিন ও শীতল হয়ে যে শিলার সৃষ্টি করে তাকে পাতালিক শিলা বলে। ধীরে ধীরে কঠিন ও শীতল হয়ে জমাট বাঁধে বলে এর দানাগুলো স্থূল হয়। যেমন – গ্রানাইট।

পাললিক শিলা

বৃষ্টি, তুষারপাত, নদী, হিমবাহ, বায়ু প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির ক্ষয়কাজের ফলে পাহাড়, পর্বত, মালভূমি ও সমভূমি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ক্ষয়কাজের ফলে উৎপন্ন পলি সাগর, নদী বা হ্রদে স্তরের আকারে সঞ্চিত হয় এবং চাপের ফলে জমাট বেঁধে যে শিলার সৃষ্টি করে তাকে পাললিক শিলা বলে। এই শিলার মধ্যে বালি, পলি ও কাদার পরিমাণ বেশি থাকে। পলি জমাট বেঁধে সৃষ্টি হওয়ায় এর নাম পাললিক শিলা। যেমন-চুনাপাথর, বেলেপাথর ও কাদাপাথর।

পাললিক শিলা

পাললিক শিলার বিশেষত্ব

• এই শিলায় পলির স্তরায়ন এবং কাদার চিড় খাওয়া দাগ লক্ষ্য করা যায়।
• একমাত্র এই শিলাতেই জীবাশ্ম বা প্রাণীর দেহের ছাপ দেখা যায়।
• এই শিলায় সছিদ্রতা ও ভঙ্গুরতার পরিমাণ বেশি।
• শিলার প্রকৃতি অনুসারে ক্ষয় প্রতিরোধ ক্ষমতা নানান রকমের হয়।
• কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার এই শিলাস্তর।
• এই শিলার প্রবেশ্যতা খুব বেশি।
• এই শিলা আগ্নেয় শিলার চেয়ে কম কাঠিন্যের হয়ে থাকে।

পলির উৎপত্তি অনুসারে দুই প্রকারের।

ক) সংঘাত শিলা

প্রাচীন শিলা চূর্ণবিচূর্ণ ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বহুদিন ধরে জমাট বেঁধে যে শিলার সৃষ্টি করে তা হল সংঘাত শিলা। যেমন – কংগ্লোমারেট, ব্রেকসিয়া।

খ) অসংঘাত শিলা

রাসায়নিক উপায়ে অথবা জৈবিক উপায়ে সৃষ্ট শিলা হল অসংঘাত শিলা। যেমন – চুনাপাথর, লবণ।

যান্ত্রিক উপায়ে গঠিত পাললিক শিলা তিন ধরণের হয়।

ক) ০.০৬ মিমি এর কম ব্যসযুক্ত দানার শিলাকে কর্দমময় পাললিক শিলা বলে। কাদাপাথর এই জাতীয় শিলা।
খ) ০.০৬ থেকে ২ মিমি পর্যন্ত ব্যসযুক্ত দানার শিলাকে বালুকাময় পাললিক শিলা বলে। বেলেপাথর এই জাতীয় শিলা।
গ) ২ মিমি এর বেশি ব্যসযুক্ত দানার শিলাকে প্রস্তরময় পাললিক শিলা বলে। কংগ্লোমারেট ও চুনাপাথর এই জাতীয় শিলা।

রূপান্তরিত শিলা

দীর্ঘ সময় ধরে ভূত্বকে প্রচণ্ড চাপে ও তাপের প্রভাবে আগ্নেয় ও পাললিক শিলা পরিবর্তিত হয়ে সম্পূর্ণ নতুন ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মবিশিষ্ট শিলায় পরিণত হয়। পূর্বের অবস্থার রূপান্তর ঘটে বলে এই শিলার নাম রূপান্তরিত শিলা। অনেকভাবেই শিলার রুপান্তর ঘটতে পারে।

অনেকভাবেই শিলার রুপান্তর ঘটে থাকে, যথা – ১. অত্যধিক তাপে (পিট থেকে কয়লা), ২. রাসায়মিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে (অ্যান্ডালুসাইট থেকে সিলিমোনাইট), ৩. প্রচণ্ড চাপে (শেল থেকে স্লেট)।

রূপান্তরিত শিলার বিশেষত্ব

• রুপান্তরের ফলে আগ্নেয় বা পাললিক শিলা আরও বেশি কঠিন হয়ে যায়।
• আগ্নেয় শিলা রূপান্তর হলে তা আগের থেকে আরও বেশি চকচকে, মসৃণ ও কেলাসিত হয়ে যায়।
• পাললিক শিলা রূপান্তর হলে তার ভঙ্গুরতার পরিমাণ কমে যায়।

শিলাচক্রের ধারণা

আগ্নেয়, পাললিক এবং রূপান্তরিত – এই তিন প্রকারের শিলার উৎপত্তি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শিলা সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া চক্রাকারে আবর্তিত হয়। শিলাচক্রের এই পর্যায়গুলি হল –অগ্ন্যুদ্গমের ফলে ভূগর্ভের উতপ্ত ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠের কোন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে এসে অথবা ভূগর্ভেই শীতল ও কঠিন হয়ে আগ্নেয় শিলার সৃষ্টি করে। পরে এই শিলা নদী, বায়ু, হিমবাহ প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কোন সমুদ্র বা নদীর তলদেশে দীর্ঘ সময় ধরে সঞ্চিত হয়ে পাললিক শিলার সৃষ্টি করে।

আগ্নেয় ও পাললিক এই দুই ধরনের শিলা তাপ, চাপ বা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হয়।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান | ভূগোল

পুনরায় বহু বছর পর এই তিন ধরণের শিলা ভূআলোড়নের ফলে পৃথিবীর কেন্দ্রে প্রবেশ করে ম্যাগমায় পরিণত হয়, তা থেকে আবার আগ্নেয় শিলার সৃষ্টি হয়। আবার রূপান্তরিত শিলা প্রাকৃতিক শক্তির মাধ্যমে ক্ষয়িত হয়ে সমুদ্রের তলদেশে পলির স্তর হিসেবে জমাট ও সঞ্চিত হয়ে পুনরায় পাললিক শিলায় সৃষ্টি করে।
এইভাবে প্রকৃতিতে শিলার উৎপত্তি ও পর্যায়ক্রমে এক শিলা থেকে অন্য শিলায় রূপান্তর একটি নির্দিষ্ট নিয়মে চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে চলেছে। তিন প্রকার শিলার এই অবিরাম চক্রাকারে আবর্তনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিই হল শিলাচক্র।

ভূমিরূপের ওপর শিলার প্রভাব

ভূমিরূপ গঠনে শিলার প্রভাব অনেকটাই, বিভিন্ন শিলাগঠিত অঞ্চলে বিভিন্ন ভূমিরূপ দেখা যায়, –

১. গ্রানাইট শিলায় গঠিত গোলাকার ভূমিরূপ

গ্রানাইট

গ্রানাইট শিলা দিয়ে গঠিত ভূমিরূপের ওপর উয়তার তারতম্যে শিলা পেঁয়াজের খোসার মতো খুলে যায়। এভাবে শিলার উপরিভাগ প্রায় গোলাকার দেখতে হয়। রাঁচির ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল প্রধানত গ্রানাইট শিলায় গঠিত।

২. ব্যাসল্ট শিলায় গঠিত চ্যাপ্টা ভূমিরূপ

ব্যাসল্ট

ব্যাসল্ট শিলা গঠিত অঞ্চল ক্ষারধর্মী লাভায় গঠিত, এই লাভা তরল প্রকৃতির হয় ফলে চ্যাপ্টা আকৃতির ভূমিরূপ গঠিত হয়। দাক্ষিণাত্য মালভূমির ডেক্যানট্র্যাপ অঞ্চল এই শিলায় গঠিত।

৩. চুনাপাথর বা কার্স্ট ভূমিরূপ

চুনাপাথরের উপাদানে তৈরি গুহার ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা চুনাপাথরের স্তম্ভকে স্ট্যালাকটাইট বলে। গুহার মেঝে থেকে অপরের দিকে জমে থাকা চুনাপাথরের দণ্ডকে স্ট্যালাগমাইট বলে। চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে প্রবাহিত নদীর জলে চুনাপাথর দ্রবীভূত হয়ে যেসব ভূমিরূপ সৃষ্টি করে সেগুলোকে কার্স্ট ভূমিরূপ বলে। চেরাপুঞ্জির মৌসিনরামে এই ধরণের চুনাপাথরে গুহা দেখতে পাওয়া যায়।

৪. বেলেপাথর গঠিত খাড়া ঢালবিশিষ্ট ভূমিরূপ

বেলেপাথর গঠিত অঞলের পার্শ্বদেশে ক্ষয়ের ফলে খাড়া ঢালবিশিষ্ট ভূমিরূপ তৈরি হয়।

[এই প্রবন্ধে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কর্তৃক প্রকাশিত অষ্টম শ্ৰেণীর পাঠ্য পুস্তক ‘আমাদের পৃথিবী’ থেকে কিছু চিত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে করা হয়েছে, এর কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য JUMP Magazine কর্তৃপক্ষের নেই।]

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → চাপ বলয় ও বায়ুপ্রবাহ

লেখিকা পরিচিতিঃ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্রী শ্রীপর্ণা পাল। পড়াশোনার পাশাপাশি, গান গাইতে এবং ভ্রমণে শ্রীপর্ণা সমান উৎসাহী।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করতে ভুলো না।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

VIII_Geo_3a