ভৌতবিজ্ঞান – নবম শ্রেনি – অধ্যায়: পদার্থঃ গঠন ও ধর্ম (পঞ্চম পর্ব)
আগের পর্বে আমরা তরলের পৃষ্ঠটান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা তরলের আরও একটি ধর্ম; সান্দ্রতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
একটা বিশেষ ব্যাপার মাথায় রাখা প্রয়োজন, সান্দ্রতার উৎপত্তি মূলত প্রবাহী তরলের ক্ষেত্রেই, তরল স্থির হয়ে থাকলে সান্দ্রতার ধারণা অপ্রাসঙ্গিক।
তরলের সান্দ্রতা
আপাত ভাবে যখনই সান্দ্রতার প্রসঙ্গ ওঠে তখন আমাদের মনে এক রকম অতি ঘন থকথকে তরলের কথা মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে তা নয়।
উপরের চিত্রটিতে একটি তরল পরিবাহী টিউবের ছবি উপস্থাপিত হয়েছে। ধরা যাক এই টিউবটির মধ্যে দিয়ে কোন তরল প্রাবাহিত হচ্ছে। তরল প্রবাহের অভিমূখ তীর চিহ্ন দ্বারা দেখানো হয়েছে।
এখন তরলের যে অংশ টিউবের প্রাচীর গাত্রের কাছাকাছি সেই অংশে জলের অনুগুলির সাথে টিউবের দেওয়ালের অনুর ঘর্ষনজনিত কারনে বা উভয় প্রকার অনুর আন্তঃ আনবিক আকর্ষন বল জনিত (আসঞ্জন বল) কারনে ঐ অংশের তরলের বেগ সর্বনিম্ন হয়। কিন্তু যত টিউবের ব্যাসার্ধ বরাবর অক্ষের দিকে যাওয়া যায় অর্থাৎ টিউবের মাঝ বরাবর উপরোক্ত বল জনিত কোন বাধা না থাকায় অক্ষবরাবর তরলের বেগ সর্বাধিক হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে তরল প্রবাহের সময় তরলের মধ্যে বিভিন্ন বেগ বিশিষ্ট স্তরের সৃষ্টি হয়।
স্বভাবতই কম বেগ বিশিষ্ট স্তর বেশি বেগ, বিশিষ্ট স্তর বেশি বেগ বিশিষ্ট স্তরের অনুগুলির গতিতে বাধার সৃষ্টি করে। এই প্রকার বাধাই তরলের সান্দ্রতা বা Viscosity নামে পরিচিত।
বিভিন্ন রাশির মত তরলের সান্দ্রতাও একটি পরিমাপ যোগ্য রাশি।
কিন্তু আমরা সরাসরি সান্দ্রতা বলে কোন রাশি পরিমাপ করি না। যা পরিমাপ করি, তা হল, সান্দ্রতা গুনাঙ্ক। এই সান্দ্রতা গুনাঙ্ককে গ্রীক অক্ষর ‘η’ (ইটা) দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
ধরা যাক, কোন তরলের মধ্যে পরপর দুটি স্তরের বেগ যথাক্রমে v1ও v2এবং এই দুটি স্তরের মধ্যে দূরত্বের পার্থক্য হল Δx (ডেল্টা x)।
আমরা পার্থক্য বোঝাতে ডেল্টা (Δ) ব্যবহার করে থাকি, তাই Δ1 – Δ2 = বেগের পার্থক্য = ΔV আসলে, আগে আমরা Δx বসিয়েছি সেটি আসলে দুটি বিন্দু x1 ও x2 এর দূরত্বের পার্থক্য = x1 ও x2 = Δx
সুতরাং তরলটি প্রতি একক দূরত্বের বেগের পার্থক্য =
এই কে, এক কথায় বলা হয় Velocity Gradient।
আমরা আগেই জেনেছি যে তরলের সান্দ্রতা আসলে তরলের দুটি স্তরের মধ্যে বেগের ভিন্নতার কারনে সৃষ্ট বাধা। ধরি এই বাধা জনিত বল হল ‘f’। এই ‘f’ ও এর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন বিজ্ঞানী নিউটন।
তাঁর মতে
বা,
এই ‘η’ আমরা সান্ত্রতা গুনাঙ্ক হিসাবে আগেই জেনেছি।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে প্রবাহমান তরলের ক্ষেত্রেই সান্দ্রতার উদ্ভব হয় এর সাথে তরলের ঘনত্বের কোন সম্পর্ক নাই। এখন তরল প্রবাহ আবার দুই প্রকার হতে পারে –
ক) ধারারেখ প্রবাহ বা Stream line motion
আমরা যদি প্রবাহমান তরলের অভ্যন্তরে কিছু কিছু কল্পনা করে নিই এবং যদি এই প্রত্যেক বিন্দুতেই সময়ের স্বাপেক্ষে প্রবাহিত তরলের বেগের মান ও অভিমূখ একই থাকে বা অপসারিত থাকে তবে তরলটির প্রবাহ ধারারেখ বা Stream line হয়ে থাকে।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
খ) অশান্ত প্রবাহ বা Turbulent motion
আগের মতই আমরা প্রবাহমান তরলের অভ্যন্তরে কিছু বিন্দু কল্পনা করে নেব। যদি এই সকল বিভিন্ন বিন্দু গুলিতে প্রবাহিত তরলের বেগের মান ও অভিমূখ সময়ের সাথে পরিবর্ত্তিত হয় তবে উক্ত তরল প্রবাহকে অশান্ত প্রবাহ বলা হয়ে থাকে।
আমরা এতক্ষন প্রবাহী (তরল বা গ্যাস) পদার্থের বিভিন্ন প্রকার ধর্ম নিয়ে আলোচনা করছিলাম।
এক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখ করা অত্যন্ত জরুরী যে সকল প্রকার প্রবাহী পদার্থকেই আমরা অসংনম্য বলে কল্পনা করে নিয়েছি। অর্থাৎ যে চাপের পার্থক্য থাকার কারনে তরল বা গ্যাসীয় পদার্থ প্রবাহিত হচ্ছে বা প্রবাহী পদার্থ হিসাবে আচরণ করছে সেই চাপের পার্থক্যের কারনে কিন্তু তরল বা গ্যাসীয় পদার্থের ঘনত্বের কোনরুপ পরিবর্ত্তন হয় না। এটাই হল প্রবাহী পদার্থের অসংনম্যতা।
সান্দ্র তরলের প্রান্তীয় বেগঃ
আমরা আগেই জেনেছি যে তরল প্রবাহিত হওয়ার সময়ে বিভিন্ন গতিবেগ বিশিষ্ট স্তরের সৃষ্টি হয়। সুতরাং, আমরা এও জেনেছি যে তরলের মধ্যে যদি কিছু বিন্দু কল্পনা করা যায় তবে প্রতি বিন্দুতেই একটি নির্দিষ্ট অভিমুখে বেগের মান পাওয়া যাবে যদি সময়ের সাথে তরলের অভ্যন্তরে প্রত্যেক বিন্দুতেই বেগের মান ও অভিমুখ একই থাকে তবে শান্ত প্রবাহ ঘটবে আর যদি উক্ত বিন্দুতে সময়ের সাথে বেগের মান ও অভিমুখ পরিবর্তিত হতে থাকে তবে অশান্ত প্রবাহ সৃষ্টি হয়।
আমরা এও জেনেছি যে তরল প্রবাহের কারন হল তরলের উভয় প্রান্তের চাপের পার্থক্য। এখন চাপের পার্থক্য যদি বৃদ্ধি পায় তবে কোন এক সময় শান্ত প্রবাহ অশান্ত প্রবাহে পরিণত হবে।
সুতরাং সান্দ্র তরলের শান্ত প্রবাহ যে মূহুর্তে শান্ত থেকে অশান্ত প্রবাহে পরিণত হয় সেই মূহুর্তে তরলের প্রতিটি বিন্দুতে বেগকেই প্রান্তীয় বেগ বা Critical Velocity বলে।
সাধারণভাবে প্রান্তীয় বেগ তরলের সান্দ্রতা গুণাঙ্কের সাথে সমানুপাতিক এবং তরলের ঘনত্ব ও যে নলের মধ্যে দিয়ে তরল প্রবাহিত হচ্ছে সেই নলের ব্যাসার্ধের সাথে ব্যাস্তানুপাতিক।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
তরল প্রবাহের হার
সাধারনভাবে প্রতি একক সময়ে যে পরিমাণ তরল (v) কোন নলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় তা।
- নলের উভয় প্রান্তের চাপের পার্থক্যের সাথে সমানুপাতিক, অর্থাৎ
- নলের দৈর্ঘ্যের সাথে ব্যাস্তানুপাতিক অর্থাৎ
- তরলের সান্দ্রতা গুণাঙ্কের (η → ইটা) সাথে ব্যাস্তানুপাতিক
- তরলের প্রস্থচ্ছেদের ব্যাসার্ধের (a) চতুর্থ ঘাতের সাথে সমানুপাতিক
অর্থাৎ, সুতরাং যৌগিক ভেদের সূত্রানুসারে →
বা,
K, হল একটি ধ্রুবক যার মান =
∴ প্রতি একক সময়ে প্রবাহিত তরলের আয়তন
সান্দ্রতা এবং ঘর্ষন বলের পার্থক্য
ঘর্ষন বল | সান্দ্রতা |
এটি বস্তুর পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফলের উপর নির্ভরশীল নয়। | এক্ষেত্রে, সান্দ্রতা জনিত বাধা তরলের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফলের সমানুপাতিক। |
এটি বস্তুর বেগের উপর নির্ভরশীল নয়। | এটি তরলের বেগের উপর নির্ভরশীল |
পঞ্চম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব পড়ুন → স্থিতিস্থাপকতা।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – সাপ্তাহিক ইমেইল আপডেট
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-PSc-3e