vartoter-khonijo-sompod
WB-Class-9

ভারতের খনিজ সম্পদ

শ্রেণিঃ নবম | বিষয়: ভূগোল । অধ্যায় – ভারতের সম্পদ (দ্বিতীয়পর্ব)

এই অধ্যায়ের প্রথম পর্বে আমরা সম্পদের ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছি। এই পর্বে ভারতের দুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি খনিজ সম্পদ নিয়ে আলোচনা করবো। তবে তার আগে আমরা জেনে নেব যে খনিজ সম্পদ বলতে আমরা কি বুঝি?

প্রকৃতিতে প্রাপ্ত রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন এবং প্রায় একই উপাদানে গঠিত পদার্থকে খনিজদ্রব্য বলা হয়। যেমন- আকরিক লোহা, কয়লা, খনিজ তেল প্রভৃতি। এই পর্বে আমরা ভারতে প্রাপ্ত দুটি প্রধান খনিজ পদার্থ সম্পর্কে আলোচনা করবো।

আকরিক লোহা

লোহা একটি ধাতব খনিজ পদার্থ যা লোহার আকরিক থেকে নিষ্কাশন করা হয়। লোহা খনিজ হিসাবে অপুনর্ভব, সীমিত ও ক্ষয়িষ্ণু প্রকৃতির হয়। দৈনন্দিন জীবনে লোহা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

আকরিক লোহার গুরুত্ব এবং ব্যবহার:

আধুনিক সভ্যতায় লোহা শিল্পের ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য উপাদান। মানুষের প্রায় সমস্ত কাজেই লোহা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজে লাগে। যেমন-

  • কৃষি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরির ক্ষেত্রে লোহা ব্যবহৃত হয়। যেমন- লাঙ্গল, কোদাল, কাস্তে, ট্রাক্টর প্রভৃতি।
  • বসতবাড়ি নির্মাণ ও গৃহস্থালি সামগ্রী নির্মাণের ক্ষেত্রেও লোহার ব্যবহার হয়। যেমন- লোহার রড, ছুরি ,কাঁচি, বটি, হাঁড়ি, কড়াই প্রভৃতি।
  • লোহা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের যন্ত্র তৈরিতেও কাজে লাগে। যেমন-সাঁড়াশি ,কাটারি প্রভৃতি।
  • লোহা পরিবহনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং গাড়ির কাঠামো তৈরিতে কাজে লাগে। যেমন- সাইকেল ,রিক্সা, ট্রাম, রেলগাড়ি, জাহাজ প্রভৃতি।
  • শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ভারী যন্ত্রপাতি লোহা দ্বারা তৈরি হয়। যেমন- জেনারেটর, বয়লার, টারবাইন প্রভৃতি।
  • যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র তৈরিতে লোহা ব্যবহৃত হয়। যেমন – রাইফেল, পিস্তল ইত্যাদি।
শ্রেণী লোহার পরিমাণ রং গুরুত্ব
ম্যাগনেটাইট (Fe2O4) 72.4% কালো সবথেকে উন্নত মানের লৌহ আকরিক। লোহা উৎপাদনে ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব সবথেকে বেশি।
হেমাটাইট (Fe2O3) 70% গাঢ় বাদামী বা লাল উন্নত মানের আকরিক। এর ব্যবহার সবথেকে বেশি হয়।
লিমোনাইট (2Fe2O3, 3H2O) 62.9% বাদামী বা হলদে বাদামি মাঝারি মানের আকরিক ব্যবহার ও অপেক্ষাকৃত কম।
সিডেরাইট (FeCO3) 48.2 % বাদামি বা ধূসর হলুদ সব থেকে নিচু মানের আকরিক তাই এর ব্যবহার কম।

ভারতবর্ষে আকরিক লোহার বন্টন ও উত্তোলন:

ভারতে যে আকরিক লোহা পাওয়া যায় তার অধিকাংশই হলো হেমাটাইট ও ম্যাগনেটাইট গোষ্ঠীর।

ভারতে মোট দশটি রাজ্যে আকরিক লোহা উত্তোলন করা হয়। Indian bureau of mines 2013 এর দেওয়া তথ্য অনুসারে –

ওড়িশা জেলা আকরিক লোহা উৎপাদনে প্রথম স্থান অধিকার করে (76,188 হাজার টন)। ওড়িশার প্রধান লোহা উৎপাদক অঞ্চল গুলি হল কেওনঝড় জেলার কিরিবুরু, ময়ূরভঞ্জ জেলার গুরুমহিসানি, বাদাম পাহাড় ও সুন্দরগড় জেলার বোনাই।

ছত্রিশগড় আকরিক লোহা উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে (29250 হাজার টন)। এই অঞ্চলের প্রধান লোহা উৎপাদক কেন্দ্র গুলি হল দান্তেওয়াড়া জেলার বায়লাডিলা, কাঁকের জেলার রাওঘাট, বালোর জেলার দাল্লি-রাজ্হারা ইত্যাদি।


[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]

ঝাড়খণ্ড রাজ্য আকরিক লোহা উৎপাদনে তৃতীয় স্থান দখল করে (22624 হাজার টন)। এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান লোহা উৎপাদক অঞ্চল গুলি হল পশ্চিম সিংভূম জেলার গুয়া, নয়ামুন্ডি, বাদাবুরু ইত্যাদি।

কর্ণাটক জেলা আকরিক লোহা উৎপাদনে চতুর্থ স্থান দখল করে (18684 হাজার টন)। এর প্রধান লোহা উৎপাদক অঞ্চল গুলি হল বাগলকোট বেল্লারী টুমাকুরু, চিত্রদুর্গ ইত্যাদি।

গোয়া আকরিক লোহা উৎপাদনে পঞ্চম স্থান দখল করে (10897 হাজার টন)। উত্তর ও দক্ষিণ গোয়ার প্রধান লোহা উৎপাদক অঞ্চল গুলি হল সিরিগাও, বিচলিম, সাতারি, মাপুসা, সাঙ্গুয়েম ইত্যাদি।

উতপ্ত আকরিক লোহা।

মধ্যপ্রদেশ লৌহ আকরিক উৎপাদনে ষষ্ঠ স্থান দখল করে (2090 হাজার টন)। এর প্রধান লোহা উৎপাদক অঞ্চল গুলি হল বালাঘাট, গোয়ালিয়র, জব্বলপুর ,সাগর ইত্যাদি।

মহারাষ্ট্র আকরিক লোহা উৎপাদনে সপ্তম স্থান দখল করে (1888 হাজার টন)। এর প্রধান লোহা উৎপাদক অঞ্চল গুলি হল চন্দ্রপুর, সিন্ধুদূর্গ, গড়চিরোলি, গণ্ডিয়া প্রভৃতি।

অন্ধ্রপ্রদেশ আকরিক লোহা উৎপাদনে অষ্টম স্থান অর্জন করে (709 হাজার টন)। প্রধান লোহা উৎপাদক অঞ্চল গুলি হল অনন্তপুর, কাডাপা, কুর্ণুল, কৃষ্ণা ইত্যাদি।

রাজস্থান আকরিক লোহা উৎপাদনে নবম স্থান অর্জন করে (708 হাজার টন)। প্রধান লোহা উৎপাদক অঞ্চল গুলি হল -জয়পুর, শিকার, ভিলওয়ারা প্রভৃতি।

তেলেঙ্গানা আকরিক লোহা উৎপাদনে দশম স্থান অর্জন করে (42 হাজার টন)। প্রধান লোহা উৎপাদক অঞ্চল গুলি হল করিমনগর, খাম্মাম, ওয়ারঙ্গল ইত্যাদি।


[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌতবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবনবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]

আকরিক লোহার সঞ্চয় ও বাণিজ্য:

ভারত বর্ষ আকরিক লোহার সঞ্চয়ের দিক থেকে বিশ্বের একটি অন্যতম সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে পরিচিত।

এই দেশে মোট সঞ্চিত লোহার পরিমাণ 2058 কোটি টন। ভারত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আকরিক লোহা রপ্তানি করে থাকে। Indian Bureau of Mines এর তথ্য অনুযায়ী 2013-2014 সালে ভারত থেকে প্রায় 163 লক্ষ টন আকরিক লোহা রপ্তানি করা হয়েছিল। ভারত অন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর দক্ষিণ কোরিয়া,পোল্যান্ড, জাপান, ইতালি, ইরান প্রভৃতি দেশে লৌহ আকরিক রপ্তানি করে।

ভারতের খনিজ সম্পদ সম্পূর্ণ আলোচনা↓

কয়লা

কয়লা হল একটি স্তরীভূত জৈব শিলা। উদ্ভিদের দেহাবশেষ পাললিক শিলা স্তরে যুগের পর যুগ ধরে চাপা থেকে স্তরীভূত হয়ে কয়লার সৃষ্টি করে। কয়লা হল একটি গচ্ছিত শক্তি সম্পদের উদাহরণ।

কয়লা খনির অভ্যন্তরে

কয়লার ব্যবহার ও গুরুত্ব:

বর্তমান সভ্যতায় কয়লার ব্যবহার ও গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা এবার কয়েকটি কয়লার ব্যবহার দেখে নেব।

  • লৌহ ইস্পাত শিল্পে
  • তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন
  • সিমেন্ট উৎপাদনে
  • গৃহস্থালির জ্বালানি, রেল ইঞ্জিন ,জাহাজ ও স্টিমার চালাতে
  • রাস্তা তৈরিতে
  • শীতপ্রধান দেশে ঘর গরম রাখতে
  • কয়লার বিভিন্ন উপজাত দ্রব্য রাসায়নিক শিল্পে ব্যবহৃত হয়

কয়লার মধ্যে কার্বন ও অন্যান্য পদার্থ যেমন- অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, ফসফরাস, বেঞ্জিনের উপস্থিতির তারতম্যের ভিত্তিতে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হলো –

কয়লা কার্বনের পরিমাণ রং গুরুত্ব
অ্যানথ্রাসাইট 85- 95% লোহার মত কালো এটি ভালো মানের কয়লা, দহনে কম ধোঁয়া হয়।
বিটুমিনাস 50- 80% ধূসর কালো কোক কয়লা তৈরি হয়।
লিগনাইট 35-50% বাদামি রাসায়নিক শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
পিট <35% হালকা বাদামি ব্যবহার নেই বললেই চলে।

ভারতে কয়লা উৎপাদন ও বন্টন

গন্ডোয়ানা যুগের কয়লা খনি

ভারতের উত্তোলিত প্রায় 99% কয়লা হল গন্ডোয়ানা যুগের। এই ভূতাত্ত্বিক যুগের কয়লা যে সমস্ত অঞ্চলে পাওয়া যায় সেগুলি হল- 

ছত্রিশগড়: কয়লা উৎপাদনে এই রাজ্য শ্রেষ্ঠ। এখানকার বেশিরভাগ কয়লা কোক হীন হয়। এই রাজ্যের প্রধান কয়লা উৎপাদক অঞ্চল গুলি হল সুরগুজা জেলার তাতাপানি, রামকোলা, ঝিলিমিলি, বিসরামপুর, লক্ষণ পুর;  বিলাসপুর জেলার কোবরা, দামহামুন্ডা, সেন্দুর; রায়গর জেলার রায়গর ও মান্ড নদীর উপত্যকা ইত্যাদি। এই রাজ্যের মোট কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ 12.72 কোটি টন (2013-2014)।

ঝাড়খন্ড: ঝাড়খন্ড জেলার ঝরিয়া, পূর্ব-পশ্চিম বোকারো, উত্তর-দক্ষিণ করণপুরা, গিরিডি, রামগড় প্রভৃতি অঞ্চলে কয়লা খনি আছে। এই রাজ্যের মোট কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ 11.31 কোটি টন (2013-2014)।

উড়িষ্যা: উড়িষ্যা জেলার তালচের, সম্বলপুর, সুন্দরগড় জেলার রামপুর, হিঙ্গির, লাজকুরা ইত্যাদি অঞ্চলে কয়লা খনি রয়েছে। এই রাজ্যের মোট কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ 11.29 কোটি টন (2013-2014)।

মধ্যপ্রদেশ: মধ্যপ্রদেশ জেলার উমারিয়া, সোহাগপুর, ছিন্দওয়ারা জেলার পেঞ্চ-কামহান নদী উপত্যকা অঞ্চলে কয়লা পাওয়া যায়। এই রাজ্যের মোট কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ 7.56 কোটি টন (2013-2014)।

কয়লা উৎপাদন চলছে।

তেলেঙ্গানা: তেলেঙ্গানার গোদাবরী নদী উপত্যকার অন্তর্গত আদিলাবাদ, করিমনগর, ওয়ারঙ্গাল, খম্মাম ইত্যাদি জেলায় কয়লা খনি গুলি অবস্থিত। এই রাজ্যের মোট কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ 5.05 কোটি টন (2013-2014)।

মহারাষ্ট্র: মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা উপত্যকা, কামথি, উমরের মাকরধকরা, বোখারায় ও নান্দ বান্দেরে কয়লা উত্তোলন করা হয়। এই রাজ্যের মোট কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ 3.72 কোটি টন (2013-2014)।

পশ্চিমবঙ্গ: পশ্চিমবঙ্গের রানীগঞ্জ, জামুরিয়া, মেজিয়া, অন্ডাল, তিনধরিয়া, জয়ন্তী ইত্যাদি কেন্দ্রে কয়লা পাওয়া যায়। এই রাজ্যের মোট কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ 2.82 কোটি টন (2013-2014)।

টারশিয়ারী যুগের কয়লা খনি

অসম: অসম রাজ্যের মাকুম, ডিলি জয়পুর ও মিকির পাহাড়ে কয়লা পাওয়া যায়।

অরুণাচল প্রদেশ: এখানকার নামচিক- নামফুক ও মিয়াও বুনো হলো কয়লা উত্তোলন কেন্দ্র।

মেঘালয়: এই রাজ্যের খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড়ে কয়লা উত্তোলিত হয়।

নাগাল্যান্ড: এখানকার বোরজান ও তিয়েনসাং কেন্দ্রে কয়লা উত্তোলন করা হয়।

ভারতের কয়লা সঞ্চয় ও বাণিজ্য

Indian bureau of mines এর 2015 তথ্য অনুযায়ী ভারতের মোট কয়লা সঞ্চয়ের পরিমাণ 30,660 কোটি টন। এর মধ্যে 13,161 কোটি টনের সঞ্চয় প্রমাণ হয়েছে বাকি 14,324 কোটি টন কয়লা সঞ্চয়ের অনুমান করা হয়েছে।

এই সঞ্চিত কয়লার মধ্যে উচ্চ মানের কোক কয়লার পরিমাণ 531 কোটি টন, মাঝারি মানের কোক কয়লার পরিমাণ 2738 কোটি টন, সেমি কোক কয়লার পরিমাণ 171 কোটি টন ও কোক কয়লার পরিমাণ 27,070 কোটি টন। ভারতবর্ষ বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, ইরান ও পাকিস্তানে কয়লা রপ্তানি করে এবং অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া থেকে ভারত কয়লা আমদানি করে।

দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতের খনিজ তেল

লেখিকা পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী শ্রেয়সী বিশ্বাস। পড়াশোনা এবং লেখালিখির পাশাপাশি, ছবি আঁকা এবং বাগান পরিচর্যাতেও শ্রেয়সী সমান উৎসাহী।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX_Geo_7b