শ্রেণিঃ নবম | বিষয়: ভূগোল । অধ্যায় – ভারতের সম্পদ (প্রথম পর্ব)
কয়েকটি পর্বে আমরা সম্পূর্ণ সপ্তম অধ্যায়ের আলোচনা করব। এই পর্বে আমরা সম্পদ সম্পর্কে ধারণা লাভ করার চেষ্টা করবো।
সম্পদ কাকে বলে?
সম্পদ শব্দের ইংরেজি পরিভাষা হলো Resource (Re+Source)। অর্থাৎ যে উৎস থেকে বারেবারে মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় তাকে সম্পদ বলা হয়। অন্যরূপে বলা যায় কোন বস্তু বা পদার্থ কোন কাজ সম্পন্ন করলে বা কোন বস্তু বা পদার্থের মধ্যে যে কার্যকারিতা শক্তি নিহিত আছে এবং যার ফলে মানুষের চাহিদা বারবার মেটানো সম্ভব হয় তাকে সম্পদ বলা হয়।
অধ্যাপক E.W Zimmerman এর লেখা ‘ World Resources and Industries’ থেকে ‘সম্পদ ‘ সম্পর্কে আমরা একটি স্পষ্ট ধারণা পেয়ে থাকি। তাঁর মতে –
সম্পদ কোন বস্তু বা পদার্থ নয় কিন্তু কোন বস্তু বা পদার্থ যে কার্যকারিতা শক্তি রয়েছে তাই হল সম্পদ।
অর্থাৎ সম্পদ হলো পদার্থের বা বস্তুর সেই কার্য শক্তি যা মানুষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। সুতরাং বলা যেতে পারে যে মানুষের নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের উপায় ও মানুষের অর্থনৈতিক বিকাশের মূল ভিত্তি হল সম্পদ।
Encyclopaedia of Social Science অনুসারে “Resources are those aspects of men’s environment which render possible or facilitate the satisfaction of human wants and the attainment of social objectives.” (volume xi)
তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারছি যে পৃথিবীতে অবস্থিত জল, আলো-বাতাস, উর্বর জমি, উদ্ভিদ, জীবজন্তু ,কয়লা, পেট্রোলিয়াম সব কিছু সম্পদের আওতায় পড়ে। এগুলি কিন্তু সবই বস্তুগত সম্পদ, এর পাশাপাশি কিছু অবস্তুগত সম্পদও বর্তমান, যেমন – মানুষের বিদ্যা ,বুদ্ধি, জ্ঞান ,সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি।
তাহলে বোঝা গেল যে, সম্পদ বস্তুগত ও অবস্তুগত দুই ধরনেরই হতে পারে। আবার, কিছু সম্পদ ছোঁয়া যায় বা অনুভব করা যায় আবার কিছু ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না; সুতরাং সম্পদ স্পর্শযোগ্য বা অস্পর্শযোগ্য দুইধরনেরই হতে পারে। বস্তুর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেলে সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
সম্পদের ধারণা পর্বের আলোচনা↓
সম্পদের বৈশিষ্ট্য
সম্পদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্তমান সেগুলি হল
- প্রত্যেক সম্পদের তার নিজস্ব কার্যকারিতা আছে
- সম্পদ মানুষের অভাব দূর করতে পারে
- সম্পদের গ্রহণযোগ্যতা আছে
- সম্পদের ব্যবহার যোগ্যতা আছে
- সম্পদের উপযোগিতা বর্তমান
- সম্পদের যোগ্যতা এবং হস্তান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা বর্তমান
- সম্পদের সুগমতা আছে
- সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে
- সম্পদের চাহিদা আছে
- সর্বোপরি সম্পদ পরিবেশ বান্ধব অর্থাৎ সম্পদ পরিবেশের কোনো ক্ষতি সাধন করে না
সম্পদের শ্রেণীবিভাগ
সম্পদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। আমরা এগুলো সম্পর্কে জেনে নেব।
সম্পদ সৃষ্টির উপাদান অনুসারে সম্পর্কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রাকৃতিক সম্পদ: প্রকৃতি থেকে সৃষ্ট সম্পদ। উদাহরণ -খনিজ সম্পদ, প্রাণী সম্পদ ইত্যাদি।
মানবিক সম্পদ: মনুষ্য সৃষ্ট সম্পদ হলো মানবিক সম্পদ। উদাহরণ- মানুষ বা জনসংখ্যা।
সাংস্কৃতিক সম্পদ: এই সম্পদ মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি ,প্রযুক্তিগত দক্ষতার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। উদাহরণ -মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি ইত্যাদি।
সম্পদের স্থায়িত্ব অনুযায়ী সম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
গচ্ছিত বা অপুনর্ভব সম্পদ: এই সম্পদ পৃথিবীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে রয়েছে এবং ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে ভবিষ্যতে শেষ হয়ে যাবে। উদাহরণ- খনিজ সম্পদ।
প্রবাহমান বা পুনর্ভব সম্পদ: এই সম্পদের যোগান পৃথিবীতে অফুরন্ত এবং বহুবার ব্যবহার করলে কোনদিন শেষ হবে না। উদাহরণ -সূর্যালোক, নদীর জল।
সম্পদের জৈব বৈশিষ্ট্য অনুসারে সম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়
জৈব সম্পদ: এই সম্পদ জীবজগৎ বা প্রাণী জগৎ থেকে পাওয়া যায়। উদাহরণ- মৎস্য সম্পদ।
অজৈব সম্পদ: সম্পদ প্রাণহীন জড়বস্তু থেকে পাওয়া যায়। উদাহরণ- লোহা, খনিজ তেল।
সম্পদের বন্টন অনুসারে সম্পদকে চার ভাগে ভাগ করা যায়
সর্বত্র প্রাপ্ত সম্পদ: এই সম্পদ পৃথিবীর সব জায়গায় পাওয়া যায়। উদাহরণ- সূর্যালোক, বাতাস।
সহজলভ্য সম্পদ: এই সম্পদ পৃথিবীর সব জায়গায় না পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ জায়গাতেই পাওয়া যায়। উদাহরণ- কৃষিভূমি।
দুষ্প্রাপ্য সম্পদ: এই সম্পদ পৃথিবীর কিছু নির্দিষ্ট স্থানে পাওয়া যায়। উদাহরণ- খনিজ সম্পদ।
অদ্বিতীয় সম্পদ: এই সম্পদ পৃথিবীর একটিমাত্র স্থানে পাওয়া যায়। উদাহরণ- ক্রায়োলাইট।
সম্পদের মালিকানা অনুসারে সম্পদকে চার ভাগে ভাগ করা যায়
ব্যক্তিগত সম্পদ: এই সম্পদের অধিকারী কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষ। যেমন- বসত বাড়ি , গাড়ি ইত্যাদি।
সামাজিক সম্পদ: এই সম্পদের মালিকানা সমগ্র মানব সমাজের। যেমন- বিদ্যালয় ,পাঠাগার ইত্যাদি।
জাতীয় সম্পদ: এই সম্পদের মালিকানা সমগ্র দেশের মানুষের কাছে বর্তমান। যেমন -নদনদী ,খাল ইত্যাদি।
আন্তর্জাতিক সম্পদ: এই সম্পদের অধিকারী গোটা বিশ্বের মানুষ। যেমন- মহাসাগর ,বায়ুমণ্ডল ইত্যাদি।
সম্পদের প্রাপ্যতা অনুসারে সম্পদকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়
প্রাথমিক সম্পদ: এই সম্পদ সরাসরি প্রকৃতি থেকে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ জল, বাতাস ইত্যাদি।
প্রকৃত বা বিকশিত সম্পদ: এই সম্পদটি তৈরি হওয়া সম্পন্ন হয়ে গেছে এবং বর্তমানে ব্যবহারের যোগ্য। উদাহরণ- কয়লা।
সম্ভাব্য সম্পদ: এই সম্পদ তৈরি হয়েছে কিন্তু বর্তমানে এর ব্যবহার নেই। উদাহরণ- জৈব গ্যাস।
সম্পদের স্পর্শযোগ্যতা অনুসারে সম্পদ কে দুই ভাগে ভাগ করা যায়
বস্তুগত সম্পদ: এই সম্পদের নির্দিষ্ট আকার, আয়তন রয়েছে এবং একে স্পর্শ করা যায়। যেমন – রাস্তাঘাট, বাড়ি প্রভৃতি।
অবস্তুগত সম্পদ: এই সম্পদ স্পর্শ করা যায় না শুধুমাত্র অনুভব করা যায়। যেমন- মানুষের জ্ঞান, সংস্কৃতি প্রভৃতি।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌত বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবন বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]
সম্পদ সৃষ্টির উপাদান সমূহ
কোনো অব্যবহৃত বস্তুকে সম্পদে পরিণত করতে তিনটি উপাদানের প্রয়োজন হয়। সেগুলি হলো- প্রকৃতি, মানুষ ও সংস্কৃতি।
প্রকৃতি: প্রকৃতি হল সম্পদের প্রাথমিক ভান্ডার। প্রকৃতি থেকেই পুনর্ভব ও অপুনর্ভব সম্পদ পাওয়া যায়।
মানুষ: মানুষ নিজের শ্রম, জ্ঞান ও কর্ম দক্ষতার মাধ্যমে সম্পদ সৃষ্টি করে। সুতরাং মানুষ সম্পদের সৃষ্টিকর্তা এবং ধ্বংসকর্তা উভয়েরই ভূমিকা পালন করে থাকে।
সংস্কৃতি: মানুষের শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান হল সংস্কৃতির অঙ্গ। এই উপাদানটি সম্পদ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সম্পদ সৃষ্টির পথে বাধা
মনুষ্য সৃষ্ট বা প্রকৃতিগত প্রতিবন্ধকতা সম্পদ আহরণ ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করলে সেই প্রতিবন্ধকতাকে প্রতিরোধ বলা হয়। যেমন- ঝড়, বন্যা, সাইক্লোন ও ভূমিকম্প হল প্রাকৃতিক প্রতিরোধ। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ হলো মানবিক প্রতিরোধ।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]
সম্পদের সংরক্ষণের উপায়
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণ ও দীর্ঘস্থায়ী উন্নতির কথা ভেবে বর্তমানে প্রাকৃতিক সম্পদকে মিতব্যয়ী, যথাযথ এবং বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ব্যবহার করাকে সম্পদ সংরক্ষণ বলা হয়। সম্পদ সংরক্ষণের উপায়গুলি হল-
মিতব্যয়িতা বা অযাচিত ব্যবহার প্রতিরোধ: অতিরিক্ত সম্পদ ব্যবহারের ফলে সম্পদের পরিমাণ কমতে থাকে। তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
অপচয় রোধ: সম্পদ উৎপাদন ও ব্যবহারের সময় যাতে অপচয় না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যবহার: যে কাজে যে সম্পদ সর্বাপেক্ষা বেশি উপযোগী সেই কাজেই সেই সম্পদকে ব্যবহার করতে হবে। যেমন- ডিজেল তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার না করে পরিবহনের জ্বালানি রূপে ব্যবহার করা বেশি উপযোগী।
সম্পদের পুনর্ব্যবহার: একই সম্পদকে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বারংবার ব্যবহার করার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- লোহা, তামা ও অ্যালুমিনিয়াম কে একবার ব্যবহারের পর ফেলে না দিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে।
পরিবর্ত দ্রব্যের ব্যবহার: কোন কোন ক্ষেত্রে একটি দ্রব্যের পরিবর্তে তার পরিপূরক হিসেবে অন্য দ্রব্য ব্যবহার করলে সম্পদের সাশ্রয় হয়। যেমন- কাঠের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের আসবাবপত্র ব্যবহার করলে বনসম্পদ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।
সম্পদের পুনঃস্থাপন: সম্পদ ব্যবহারের পরে আবার যদি তার পুনরায় উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে সম্পদের ঘাটতি পূরণ করা যায়। যেমন- বনভূমি কাটার পর সেই স্থানে আবার চারা গাছ রোপন করা।
কার্যকারিতা বৃদ্ধি: প্রযুক্তি ও কারিগরি কৌশলের মাধ্যমে কোন সম্পদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে পারলে সম্পদ সংরক্ষণ সম্ভব হয়। যেমন- আগে 1 টন ইস্পাত উৎপাদনে 4 টন কয়লা প্রয়োজন হতো সেখানে বর্তমানে সমপরিমাণ ইস্পাত উৎপাদনে মাত্র 1 টন কয়লা লাগে।
দূষণমুক্ত পরিবেশ: পরিবেশ দূষিত হলে সম্পদের হ্রাস বা অবনমন ঘটে। তাই পরিবেশ যাতে দূষিত না হয় সেদিকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
সচেতনতা বৃদ্ধি: পৃথিবীতে গচ্ছিত সম্পদের ভাণ্ডার সীমিত। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়। এই ভাবে সম্পদের যোগান ও ব্যবহারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাহলেই সম্পদের সংরক্ষণ সম্ভব হবে।
আইন প্রণয়ন: বিভিন্ন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সম্পদের অবৈধ এবং অবিবেচ্য ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
প্রথম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতের খনিজ সম্পদ।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX_4_a