ইতিহাস – নবম শ্রেণি – নেপোলিয়নের সংস্কার এবং কোড নেপোলিয়নের প্রণয়ন (দ্বিতীয় পর্ব)
আমরা জানি যে মধ্যযুগে ইউরোপ জুড়ে ছিল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা।
ফ্রান্সে বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বপ্রথম এই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অধ্যায়ের প্রথম পর্বে আমরা জেনেছি যে ফ্রান্সের জনপ্রিয় সেনানায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেনাঅভ্যুথানের মাধ্যমে ফ্রান্স অধিকার করেন এবং ‘কনসালের’ শাসনের মাধ্যমে ফ্রান্সে নেপোলিয়নের শাসনকাল শুরু হয়।
সেই সময় ইউরোপের দেশগুলিতে বংশাণুক্রমে রাষ্ট্রনায়ক, রাজা বা সম্রাট হওয়ার প্রচলন ছিল। সেখানে এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও ফ্রান্সের মতন একটি শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠার প্রধান কারণ ছিল ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপট। নেপোলিয়নের বর্ণময় শাসনকালে ফ্রান্স তথা ইউরোপ এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছিল।
নেপোলিয়ন ‘প্রথম কনসাল’ পদে অধিষ্ঠিত হবার পরেই ফ্রান্সের শাসন, অর্থনৈতিক এবং সমাজ সংস্কারের দিকে দৃষ্টিপাত করেন।
রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করার জন্য তিনি সংবিধানের পরিবর্তন করেন, তিনি আইন করেন যে দেশের মধ্যে সকল জেলার বা প্রদেশের শাসকেরা পুরানো নিয়ম মতো আর নির্বাচিত হবেন না তারা শুধুমাত্র প্রথম কনসাল (নেপোলিয়ন) দ্বারা মনোনীত হবেন। এর ফলে সকল জেলার বা প্রদেশের শাসকেরা নেপোলিয়নকে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হন; দেশের মধ্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হন নেপোলিয়ন। তিনি ফ্রান্সে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ করেছিলেন, এর মধ্যে কয়েকটা আমরা এখন সংক্ষেপে জানবো।
কোড নেপোলিয়ন (Code Napoléon)
সম্ভবত নেপোলিয়নের জীবনের সেরা কীর্তি হল এই ‘কোড নেপোলিয়ন’ বা নেপোলিয়নের আইন সংহিতা।
আমরা জানি যে বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ে ফ্রান্সের শাসন ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ এবং বৈষম্যমূলক ছিল। দেশে প্রায় ৩৬০টির অধিক বিভিন্ন ধরণের আইন প্রচলিত ছিল। সবচেয়ে বড় কথা সমগ্র দেশে কোন ঐক্যবদ্ধ আইন ছিল না। কনভেনশন এবং ডাইরেক্টরির শাসন কালে তৎকালীন শাসকগণ এই ত্রুটিপূর্ণ আইনগুলি সংশোধনের চেষ্টা করেন কিন্তু তারা এই কাজের পূর্ণতা দিতে পারেননি।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]
ফ্রান্সের শাসনক্ষমতা লাভ করে নেপোলিয়ন দেশের আইন সংস্কারের দিকে নজর দেন।
তিনি ফ্রান্সের বিশিষ্ট চারজন আইনজীবীদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন প্রায় চার বছরের চেষ্টায় (১৮০০ – ১৮০৪) সংকলন করেন এই বিখ্যাত আইন সংহিতা। ১৮০৭ সালে এই আইন সংহিতা ফ্রান্সে ‘কোড নেপোলিয়ন’ নামে বলবৎ হয়। এই আইন সংহিতায় ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম আদর্শ ‘সাম্য’কে সামনে রেখে আইন সংস্কার করা হয়। এতে মোট ২২৮৭টি ধারা ছিল।
কোড নেপোলিয়নের মূল আইনগুলি
এই আইন সংহিতায় মোট তিনটি অংশ ছিল দেওয়ানি কোড, ফৌজদারি কোড এবং বাণিজ্যিক কোড। এর প্রধান দিকগুলি ছিল –
- আইনের চোখে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা।
- বিচার ব্যবস্থা পূর্ণগঠন করে ‘জুরিপ্রথা’ শুরু করা।
- সমাজে কোনো বিশেষ পরিবার বা ব্যক্তির বিশেষ অধিকার বিলোপ করা, ফলে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
- সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ চালু করা।
- ত্রুটিপূর্ণ এবং অনৈতিক কর ব্যবস্থা রদ করা।
- সামন্ততন্ত্র সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে নতুন ভুমি ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া, এর ফলে বিপ্লবের সময়ে যারা ভূমিলাভ করেছিল তাদের জমি বৈধতা লাভ করে।
- পারিবারিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যেমন রেজিস্ট্রি বিবাহ বৈধতা পায়, সন্তানদের ভরণ-পোষণ পিতার সামাজিক দায়িত্ব হিসাবে মান্যতা পায়।
কোড নেপোলিয়নের ত্রুটি
মনে রাখতে হবে যে নেপোলিয়নের আইন সংহিতা কিন্তু ত্রুটিহীন ছিল না। এই আইনে প্রাচীন রোমান আইনকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে সামাজিক প্রগতিশীলতা মন্দীভূত হয়।
ফরাসী বিপ্লবের একটি প্রধান আদর্শ ছিল সমান অধিকার কিন্তু নেপোলিয়নের আইন সংহিতায় নারীর অধিকার খর্ব করা হয়েছিল। নারীদের পুরুষের অধীন রাখা হয়। পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীদের বঞ্চিত করা হয়। নারীরা শুধুমাত্র তার স্বামীর সম্পত্তি ছাড়া কোনো সম্পত্তি বিক্রি বা দান করতে পারত না। শুধুমাত্র তাই নয়, এই আইন সংহিতায় বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়াকে জটিল করে দেওয়া হয় ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ করা কঠিন হয়ে যায়।
এই আইন সংহিতায় শ্রমিকদের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এমনকি তাদের মজুরি, কাজের সাম্যতা ইত্যাদি কোন বিষয়ের উল্লেখ এই আইন সংহিতায় ছিল না।
কোড নেপোলিয়নের আলোচনা শুনুন। ↓
কোড নেপোলিয়নের গ্রহণযোগ্যতা
নেপোলিয়নের আইন সংহিতায় রোমান আদব – কায়দা এবং বিপ্লবের আধুনিক মনস্কতার এক বিশেষ মিশেল লক্ষ্য করা যায়। আইন সংহিতায় কয়েকটি বিশেষ দিক ছিল আইনের সমানাধিকার, সামন্ততন্ত্রের বিলোপ, ব্যাক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক ও পারিবারিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের বৈধতা। প্রসঙ্গত, নেপোলিয়নের মূলনীতিগুলি এতটাই যথাযথ ছিল যে পরবর্তী সময়ে ইউরোপের বহু রাষ্ট্র এগুলি গ্রহণ করেছিল।
অর্থনৈতিক সংস্কার
বিগত কয়েক দশক ধরে ধুঁকতে থাকা ফ্রান্সের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা ছিল নেপোলিয়নের অন্যতম লক্ষ্য। তিনি সরকারি ব্যয় সঙ্কোচ করেন এবং জনগণকে সঠিক কর দেবার জন্য আগ্রহী করার চেষ্টা করেন। নেপোলিয়ন ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ব্যাঙ্ক অফ ফ্রান্স প্রতিষ্ঠা করেন যা সেই সময়কার অর্থনীতিকে (মুদ্রা ব্যবস্থার সাম্যতা, সহজ শর্তে ঋণদান ইত্যাদি) সঠিক দিশায় যেতে সাহায্য করে। প্রসঙ্গত আজ ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ব্যাঙ্ক ফ্রান্স এবং ইউরোপের অর্থনীতির একটি স্তম্ভ হিসাবে কাজ করে চলেছে। নেপোলিয়ন তার সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমেও পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের কোষাগারের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন। এই বিষয়ে আমরা পরবর্তী পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
শিক্ষা ও শিল্পে সংস্কার
নেপোলিয়ন ফ্রান্সে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করেন। তার উদ্যোগে ফ্রান্সে কারিগরি, সামরিক, চিকিৎসা, আইন ইত্যাদি বিষয়ক প্রচুর বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
নেপোলিয়নের সময়ে শিল্প সংস্কৃতিও গুরুত্বলাভ করে।
তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা সংগ্রহশালা ‘লুৎভের মিউজিয়াম’ (Louvre) পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এই মিউজিয়াম আজকের সময়েও একটি অসাধারণ নিদর্শন। এছাড়া রাষ্ট্রের প্রতি সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ নাগরিকদের ‘লিজিয়ন অব অনার’ (Legion of Honour) নামক উপাধির প্রচলন করেন। প্রসঙ্গত এই উপাধি শুধুমাত্র ফ্রান্সের নাগরিকদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্বের নানান গুণী মানুষদের এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বিখ্যাত ভারতীয় চিত্র পরিচালক শ্রী সত্যজিৎ রায় এই উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
তৎকালীন সময়ে ফ্রান্স জুড়ে যখন এক নৈরাজ্যের শাসন চলছে এবং গোটা একটি দেশ দিশেহারা, সেই সময়ে নেপোলিয়ন তার শৃঙ্খলাবদ্ধ শাসন এবং সংস্কারের মাধ্যমে দেশের স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনেন।
একটা বিশেষ বিষয় মনে রাখতে হবে, নেপোলিয়নের সকল সংস্কারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের নাগরিকদের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য গড়ে তোলা এবং নাগরিকদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটানো।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌতবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবনবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত]
নেপোলিয়নের সব পদক্ষেপই কি জনহিতকারী ছিল?
উত্তর হল না। তিনি তাঁর ক্ষমতা ও আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ক্ষমতার ব্যপক অব্যবহার করেছিলেন এবং ‘বিপ্লবের তরবারি’ নেপোলিয়ন ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন ‘একনায়ক’ এবং ‘সাম্রাজ্যবাদী’ নেপোলিয়ন। আমরা পরের পর্বে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যবাদ
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-hist-2b