ভূগোল– নবম শ্রেণি – ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়া (ষষ্ট পর্ব)।
আগের পর্বে আমরা মালভূমি সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই পর্বে রইল লাভা ও ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি সম্পর্কিত আলোচনা।
আগের পর্বটি আরো একবার পড়ে নিতে পারো এই লিঙ্ক থেকে- মালভূমি
লাভা মালভূমি
ভূত্বকের কোন দুর্বল স্থান বা ফাটল দিয়ে যখন তরল ক্ষারকীয় লাভা নির্গত হয়ে ভূপৃষ্ঠের কোনো বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে আবৃত করে এবং ধীরে ধীরে শীতল ও কঠিন হয়ে মালভূমি সৃষ্টি করে সেই মালভূমি লাভা মালভূমি নামে পরিচিত।
লাভা মালভূমির উদাহরণ
ভারতের দাক্ষিণাত্য মালভূমি, পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া ও ইথিওপিয়া মালভূমি, বলিভিয়া মেক্সিকো মালভূমি।এইসব মালভূমিগুলি ব্যাসল্ট জাতীয় ক্ষারকীয় লাভার সঞ্চয়ের ফলে সৃষ্টি হয়েছে।
লাভা মালভূমির উৎপত্তি
ভূত্বকের কোন দুর্বল স্থান যথা- চ্যুতি, ফাটল বা সন্ধিস্থল দিয়ে সাধারণত তরল ব্যাসল্ট জাতীয় ক্ষারকীয় লাভা ক্রমাগত উপরে উঠে আসে এবং সেই লাভা ক্রমে শীতল হয়ে জমে গিয়ে এই মালভূমির সৃষ্টি করে। এ ধরনের লাভা তরল প্রকৃতির হওয়ায় সহজেই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং বাতাসের সংস্পর্শে এসে জমে গিয়ে মালভূমির সৃষ্টি করে। এই মালভূমিকে আগ্নেয় মালভূমি বা সঞ্চয়জাত মালভূমিও বলা হয়।
বারবার নির্গমনের ফলে এই লাভা স্তরীভূত হয়ে ক্রমে মালভূমির রূপ নেয়।
ভারতের দাক্ষিণাত্য মালভূমি একাধিকবার লাভা নির্গমনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানত অপসারী পাত সীমানায় অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এজাতীয় মালভূমির সৃষ্টি হয়।
ব্যাসল্ট জাতীয় ক্ষারকীয় লাভা খুব তরল প্রকৃতির হয়ে থাকে এবং ফাটল দিয়ে ভূপৃষ্ঠে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, এ ধরনের লাভার সান্দ্রতা কম হওয়ায় এ ধরনের লাভা পর্বতের জায়গায় মালভূমি সৃষ্টি করে।
7 থেকে 13 কোটি বছর আগে ভারতীয় উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলে বিদার অগ্ন্যুৎপাতের ফলে আনুভূমিকভাবে ব্যাসল্ট লাভার সঞ্চয় ঘটে। আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট এই ‘মাথা চ্যাপ্টা’ পাহাড়গুলিকে সিড়ির (সুইডিশ শব্দ trap শব্দের অর্থ সিড়ি) মত দেখায়। এই জন্যেই দাক্ষিণাত্য মালভূমি ডেকানট্রাপ নামে পরিচিত।
লাভা মালভূমির বৈশিষ্ট্য
i) লাভা মালভূমি চ্যাপ্টা আকৃতির হয়ে থাকে এবং এর উপরিভাগ তরঙ্গায়িত হয়।
ii) মালভূমির অন্তর্গত কোমল পাললিক শিলাস্তরগুলি দ্রুত ক্ষয় হয় এবং কঠিন স্তরগুলি মাথা চ্যাপ্টা পাহাড়ের মত ভূপৃষ্ঠের উপর সিড়ির ন্যায় অবস্থান করে। এই প্রকার ভূমিরূপকে বলা হয় Deccan trap। অমরকন্টক মালভূমিতে এই ধরনের ভূমিরূপ দেখা যায়।
এ ধরনের ভূমিরূপ মসৃণ হয় এবং পুরু ব্যাসাল্ট জাতীয় শিলাস্তর দ্বারা আবৃত থাকে।
iii) এই ধরনের ভূমিরূপ মহাদেশের সংঘর্ষ পাত সীমানা বরাবর বা মহাদেশের অভ্যন্তরভাগে দেখা যায়।
উদাহরণ: কলম্বিয়া মালভূমি ও বেসিন রেঞ্জ অঞ্চল।
ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি
কোন প্রাচীন বিস্তৃত উচ্চভূমি বা মালভূমির কোমল শিলা স্তরগুলি যখন দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি (প্রধানত নদী) দ্বারা ক্ষয় পেতে পেতে অপসারিত হয় এবং অপেক্ষাকৃত কঠিন শিলা স্তরগুলি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিলা রূপে অবস্থান করে তখন তাকে ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি বলা হয়।
ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে নদী।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]
ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির উদাহরণ
ঝাড়খণ্ডের ছোটনাগপুর মালভূমি ,মধ্য ভারতের মালব মালভূমি, কর্নাটকের মালনাদ মালভূমি, বৃটেনের ওয়েলস মালভূমি।
এই মালভূমিগুলি বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা বর্তমানে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় নিচু ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমিতে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাংশে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলাতে এই প্রকার মালভূমি দেখা যায় যার উচ্চতা 300 মিটার।
ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি-এর উৎপত্তি
i) বিষম শিলা দ্বারা গঠিত কোন বিস্তীর্ণ উচ্চভূমি বা মালভূমি বহুযুগ ধরে বিভিন্ন ক্ষয়কারী শক্তি যেমন -আবহবিকার, ক্ষয়ীভবন,পুঞ্জিত ক্ষয়, বায়ুপ্রবাহ হিমবাহ, নদী প্রবাহ ,সমুদ্র তরঙ্গ ইত্যাদি শক্তি দ্বারা নিরন্তর ক্ষয় হতে থাকে। এই ক্ষয়কার্যের ফলে উচ্চভূমির কোমল শিলা দ্বারা গঠিত শিলার স্তরগুলির ক্ষয় হয়ে অপসারণ হয় এবং কঠিন শিলা যুক্ত স্থানগুলি উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই কঠিন শিলা যুক্ত স্থানগুলি নদীর উপত্যকা দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ii) কোন সমধর্মী শিলা দ্বারা গঠিত মালভূমি অঞ্চলেও নদীর নিরন্তর ক্ষয়কার্যের ফলে ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির সৃষ্টি হতে পারে।
ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির বৈশিষ্ট্য
ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি বৈশিষ্ট্য হল-
i) এই মালভূমিগুলি সমান উচ্চতা বিশিষ্ট।
ii) এই মালভূমির চূড়াগুলি মোটামুটি একই অনুভূমিক তলে অবস্থান করে এবং এদের উচ্চতা সাধারণত একি হয়
iii) এই মালভূমিগুলোর উপরে বিভিন্ন ক্ষয়কারী বহিরজাত শক্তি ক্রিয়াশীল হলেও মূলত ছোট ও বড় নদী দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়।
iv) এই মালভূমি প্রধানত ক্ষয় প্রতিরোধকারী কঠিন শিলা দ্বারা গঠিত হয়।এই মালভূমির উচ্চতা খুব বেশী না হলেও এর বন্ধুরতা অনেক বেশি হয়।
ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমির মধ্যবর্তী নদী উপত্যকাগুলি অত্যন্ত খাড়া ঢাল বিশিষ্ট হয়।
মালভূমির গুরুত্ব
খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার
মালভূমি অঞ্চলগুলি প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম খনিজ সম্পদ দ্বারা সমৃদ্ধ থাকে। যেমন – লোহা, তামা, টিন, বক্সাইট ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি নানা ধরনের খনিজ সম্পদ মালভূমি থেকে পাওয়া যায়।
এই কারণে ভারতের ছোটনাগপুর মালভূমিকে ভারতের ‘খনিজ ভান্ডার’ রূপে অভিহিত করা হয়।
মালভূমি অঞ্চল থেকে এই খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য প্রচুর মানুষ এই কাজে নিযুক্ত আছেন এবং এভাবেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
খনিজভিত্তিক শিল্প কেন্দ্র
মালভূমি অঞ্চলে প্রাপ্ত খনিজকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। যেমন- লৌহ ইস্পাত. অ্যালুমিনিয়াম, তামা, রাসায়নিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প।
কৃষিকাজ
মালভূমি অঞ্চলে বিভিন্ন কৃষিজ ফসলের যেমন ধান গম, তুলো, ডাল, আখ, তৈলবীজ, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা, সবজি চাষ হয়। এছাড়া বিভিন্ন ভেষজ গাছ চা-কফি প্রভৃতি চাষ হয়ে থাকে।
জলবিদ্যুৎ
মালভূমি অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির উপর দিয়ে যে নদীগুলি প্রবাহিত হয়। এই খরস্রোতা নদীর উপরে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
পশুপালন
স্বল্প বৃষ্টিপাতের জন্য ভূমিতে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি করে ওঠে ।মালভূমি অঞ্চলের মানুষ এই তৃণভূমির উপরে পশু পালন করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌত বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবন বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]
বনজ সম্পদ
মালভূমি অঞ্চলের বনভূমি থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সম্পদ যেমন- শক্ত কাঠ,পাতা, মধু, ধূনা প্রভৃতি সংগ্রহ করা হয়। মালভূমির পাহাড়, নদী উপত্যকা জলপ্রপাত ও জঙ্গলের মনোরম দৃশ্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
ষষ্ট পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → সমভূমি ও তার প্রকারভেদ
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখিকা পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী শ্রেয়সী বিশ্বাস। পড়াশোনা এবং লেখালিখির পাশাপাশি, ছবি আঁকা এবং বাগান পরিচর্যাতেও শ্রেয়সী সমান উৎসাহী।