forasi-biplob-part-2
WB-Class-9

ফরাসী বিপ্লব | টেনিস কোর্টের শপথ | বাস্তিল দুর্গের পতন

ইতিহাসনবম শ্রেণি – ফরাসী বিপ্লব (দ্বিতীয় পর্ব)।

আমরা আগের পর্বে  ফরাসী বিপ্লবের প্রারম্ভিক বিষয়গুলির কথা পড়েছি।

আমরা বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার কথা জেনেছি। এই পর্বে আমরা আর্থিক সংস্কারের উদ্যোগ, টেনিস কোর্টের শপথ ও বাস্তিল দুর্গের পতনের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তবে মূল পর্বে যাবার আগে নীচে দেওয়া সময় সারণি ভালো ভাবে দেখে নাও।

forashi-biplob-dates-jump-2

সম্রাটের আর্থিক সংস্কারের উদ্যোগ

রাজা ষোড়শ লুই-য়ের সময়কাল থেকেই ফ্রান্সে ঘোরতর অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়। অনিয়ন্ত্রিত খরচ, লাগামছাড়া বিলাস-বাসন, বিকলাঙ্গ কর-ব্যবস্থা এবং অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ ব্যায়ের জন্য ফ্রান্সের রাজকোষ এক গভীর অর্থসংকটের মুখোমুখি হয়।

 poor-people-of-france
ফ্রান্সের রাস্তায় অসহায় মানুষের দল।

সংকট এমন সঙ্গীন হয় যে দৈনন্দিন খরচ চালনা করাও মুশকিল হয়ে যায়। এমতবস্থায় রাজার কাছে আর্থিক সংস্কারের পথে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। 

turgo

ষোড়শ লুই সর্ব প্রথমে তাঁর অর্থমন্ত্রী ‘তুর্গো’-কে (Turgot) এই সংস্কারের দায়িত্ব দেন। তুর্গো এই অবস্থার অবসানের জন্য প্রধানত  রাজপ্রাসাদের বিলাসব্যয় কমানো, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির উপর কর বাধ্যতামূলক করা এবং যুদ্ধ ব্যয় সঙ্কোচের প্রস্তাব দেন।

কিন্তু, তার এই পরামর্শ রানি মারি আঁতোয়ানেত (উল্লেখ্য ষোড়শ লুই-এর স্ত্রী মারি আঁতোয়ানেত অত্যন্ত বিলাসপ্রিয়া ছিলেন) এবং অভিজাতদের স্বার্থ-সংঘাত করে ফলে সম্রাট প্রবল চাপের সম্মুখীন হন এবং তুর্গোকে পদচ্যুত করতে বাধ্য হন।

এর পরবর্তী সময়ে যথাক্রমে নেকার (1776 থেকে 1781), ক্যালোন (1783 থেকে 1787) এবং শেষে ব্রিয়েন অর্থমন্ত্রির পদ সামলান। সেই সময়ে ফ্রান্সের রাজকোষ বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন ছিল রাজপ্রাসাদের ব্যয়সংকোচ করা এবং অভিজাতদের উপর কর বৃদ্ধি করা। কিন্তু এই দুটি পদক্ষেপই ছিল রাজপরিবার ও অভিজাতদের স্বার্থ বিরোধী, তাই বিচারব্যবস্থার উপর অভিজাতদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে তাঁরা রাজার আর্থিক সংস্কারের পদক্ষেপের বিরোধিতা করে তাকে বাঁধা দেয়।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

শেষে রাজা বলপূর্বক আর্থিক সংস্কারের আইন প্রণয়নের কথা ঘোষণা করলে, অভিজাত সম্প্রদায় এর বিরোধিতা করে রাজাকে স্টেটস জেনারেল অধিবেশন ডেকে আর্থিক আইন পাশের দাবী জানায়। রাজা এই দাবী মানতে না চাইলে সারা দেশ জুড়ে অভিজাতরা বিদ্রোহ শুরু করে, এই বিদ্রোহ ‘অভিজাত বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।

অবশেষে রাজা অভিজাতদের দাবী মেনে নেন এবং 1789 এর মে মাসের মধ্যে স্টেটস জেনারেল অধিবেশন ডাকার প্রতিশ্রুতি দেন।

ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে এই অধিবেশনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম কারণ এই প্রথম অভিজাতরা সর্বসমক্ষে রাজার আদেশ অমান্য করে। এর ফলে রাজা ও রাজতন্ত্রের অধিকার খর্বিত হয়। এছাড়া, স্টেটস জেনারেল অধিবেশন ডাকার আহ্বানের মধ্যে দিয়ে পুরাতনতন্ত্রের অবক্ষয় শুরু হয়।

Estates General of 1789
শিল্পীর কল্পনায় স্টেটস জেনারেল অধিবেশন [চিত্র সৌজন্য – wikipedia]

টেনিস কোর্টের শপথ

অভিজাতদের প্রস্তাব মতো 1789 এর 5ই মে প্যারিস থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ভার্সাই নগরে প্রায় 175 বছর পরে স্টেটস জেনারেল অধিবেশন বা জাতীয় সভা আয়োজন করা হয়। এই সভায় 1214 জন নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন, যাদের মধ্যে যাজকদের (প্রথম সম্প্রদায়) প্রতিনিধি ছিলেন 308 জন, অভিজাতদের (দ্বিতীয় সম্প্রদায়) প্রতিনিধি ছিলেন 285 জন এবং তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলেন 621 জন।

voting-rights

নিয়ম অনুযায়ী তিনটি সম্প্রদায়, তিনটি ভিন্ন কক্ষে বসতেন এবং তাদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে মূলবিষয়ে ভোট করতেন। ভোটের অধিকার ছিল সম্প্রদায় পিছু একটি করে। আর্থিক সংস্কারের বিষয়ে যাজক ও অভিজাতদের স্বার্থ একই রকম হবার ফলে তাদের মিলিত ভোট (দুই), তৃতীয় সম্প্রদায়ের থেকে (এক) জিতে যেত।


এই পর্বের ভিডিও ক্লাস ↓


তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবী বারবার অগ্রাহ্য হবার কারণে, তৃতীয় শ্রেণির সদস্য পিছু ভোটের দাবী করে। এই সময়ে উদারপন্থী কিছু অভিজাত যেমন মিরাবো, অ্যাবে সিয়েস তৃতীয় সম্প্রদায়ের সাথে যোগ দিলে, তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা শক্তিশালী হয় এবং তাঁরা তাদের সভাকেই ‘জাতীয় সভা’ বলে দাবী করেন।

bibad
সভ্যদের মধ্যে বিবাদ

রাজা তৃতীয় শ্রেণির এই বিপ্লবী দাবী মানতে অস্বীকার করেন, তৃতীয় শ্রেণির সভাগৃহে তালা লাগিয়ে দেন। তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা তাদের সভাগৃহে তালা দেওয়া দেখে, ক্ষুব্ধ প্রতিনিধিরা কাছাকাছি একটি টেনিস কোর্টে যান ও একযোগে শপথ করেন যে ‘যতদিন না অবধি ফ্রান্সে একটি নতুন সংবিধান রচিত হচ্ছে, ততদিন তারা একত্রিত হয়ে কাজ করবেন’।

এই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় ‘টেনিস কোর্টের শপথ’ (20শে জুন 1789) নামে খ্যাত।

tenis court er sopoth
টেনিস কোর্টের শপথ অনুষ্ঠিত হচ্ছে [চিত্র সৌজন্য – thoughtco.com]

বাস্তিল দুর্গের পতন

রাজা প্রথমে তৃতীয় সম্প্রদায়য়ের দাবী মানতে না চাইলেও, ধীরে ধীরে যাজক ও অভিজাতদের একটা বড় অংশ তৃতীয় সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত হতে শুরু করেন। অবশেষে 27শে জুন, রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়য়ের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হন।

বলা যায় যে এই সময় থেকেই ফরাসী বিপ্লবের সূত্রপাত হয়।

জাতীয় সভায় তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবী কার্যকর হবার ফলে সারা দেশ জুড়ে উল্লাস দেখা যায়। বলাই বাহুল্য, রাজা কিন্তু এই ঘটনার ফলে খুশী ছিলেন না। ইতিমধ্যে তিনি তাঁর জনপ্রিয় মন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত করেন এবং আন্দোলন দমন করার জন্য সেনা মোতায়েন করেন। অপর্যাপ্ত খাদ্য, আর্থিক কষ্ট ও সামাজিক পীড়নে জর্জরিত ফ্রান্সের নাগরিকরা অসন্তুষ্ট ছিলেন, তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অসন্তোষ দানা বাঁধছিল। নেকারের অপসরণ তাদের অসন্তোষের আগুনে ঘি দেয়। শত শত মানুষ খাদ্যের দাবীতে প্যারিস জমায়েত হন এবং রাজধানী প্যারিস সম্পূর্ণ ভাবে দখল করেন নেন।

বাস্তিল দুর্গের পতন [চিত্র সৌজন্য – History.com]
14ই জুলাই উত্তেজিত জনতা কারারক্ষীদের হত্যা করে বাস্তিল দুর্গের দখল নেয়। বাস্তিল দুর্গ ছিল ফরাসী সাম্রাজ্যের স্বৈরাচারী শাসনতন্ত্রের প্রতীক।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিনা বিচারে শুধুমাত্র রাজা বা রাজেন্যবর্গের ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে বহু নিরপরাধ মানুষকে এই দুর্গে বন্দী করা হত। তাই এই দুর্গের পতন ফরাসী বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই ঘটনার ফলে রাজা ও অভিজাতদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয় এবং একপ্রকার রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।

14ই জুলাই দিনটিকে ফ্রান্সের জাতীয় দিবস হিসাবে পালন করা হয়।

শুধুমাত্র ফ্রান্সের ইতিহাসেই নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসে বাস্তিল দুর্গের পতন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

 

দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব পড়ুন


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX-Hist-1b