সহজে ব্যাকরণ সিরিজ (দ্বিতীয় পর্ব) – ধ্বনি
আগের পর্বে আমরা ধ্বনির ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছি। আগের পর্ব পড়া না থাকলে এই লিঙ্ক থেকে → ধ্বনির ধারণা পড়া যেতে পারে।
এই পর্বে আমরা দেখে নেব স্বরধ্বনি এবং ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি কীভাবে উচ্চারণ করা হয়ে থাকে এবং মুখবিবরের কোন কোন স্থান থেকে সেগুলি উচ্চারিত হয়।
মূলত জিভ আর ঠোঁট ধ্বনির উচ্চারণে প্রধান ভূমিকা নেয়। এরা দলের ক্যাপ্টেন এবং ভাইস ক্যাপ্টেন। এদের সঙ্গে খেলে আরো কয়েকজন খেলোয়াড় যেমন – কণ্ঠ, তালু, মূর্ধা, দন্ত এবং নাসিকা। স্বরধ্বনিগুলি কেবলমাত্র কন্ঠ দ্বারাই উচ্চারিত হয় বলে সেগুলির বিশদে প্রকারভেদ নেই, তবে ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি কোন কোন স্থান থেকে উচ্চারিত হয় তার একটা তালিকা নীচে দেওয়া হল:
এটাও মনে রাখতে হবে যে বাংলায় ক থেকে ম পর্যন্ত যে ২৫টি ধ্বনি রয়েছে তা উচ্চারণের সময় জিভ কেবল মুখবিবরের মধ্যে নানা স্থানে স্পর্শ করে বলে এই ২৫টি ধ্বনির নাম হয়েছে স্পর্শ ধ্বনি।
আর এই স্পর্শধ্বনিগুলিকে মোট পাঁচটি বর্গে বিভক্ত করা হয়েছে – ক-বর্গ, চ-বর্গ, ট-বর্গ, ত-বর্গ, প-বর্গ।
প্রতিটি বর্গে পাঁচটি করে ধ্বনি থাকে এবং প্রতিটি বর্গ একেকটি পৃথক স্থান থেকে উচ্চারিত হয় যা আগের তালিকায় দেখলাম আমরা। এবারে এই ছবিটির দিকে তাকাও আর নিজে নিজে একেকটি ধ্বনি উচ্চারণ করে দেখো তো বন্ধুরা আমার কথার সঙ্গে মেলে কিনা। এও একরকমের খেলা। আশা করি মজাই লাগবে, নাও শুরু করো।
প্রথমে বলো ক খ গ ঘ। ভালো করে অনুভব করলে দেখবে জিভ আমাদের নরম তালুর যে পিছন দিক সেইটে স্পর্শ করছে। ঐ জায়গাটি আসলে জিহ্বামূল, আমরা সুবিধার্থে কণ্ঠ ধরে নিয়েছি একে।
তারপর বলো চ ছ জ ঝ। এবারে বুঝতে পারবে জিভ ঠিক তালুর ঠিক সামনের ভাগে স্পর্শ করছে।
এখন যদি তোমরা ধরে ধরে উচ্চারণ করো ট ঠ ড ঢ ণ, তাহলে বেশ ভালোমতোই টের পাবে ব্যাঙের মতো আমাদের জিভটা উলটে গেলো খানিকটা আর মূর্ধায় স্পর্শ করলো। জেনে রাখা ভালো যে উপরের দাঁতের পাটির পিছনে যে শক্ত অংশ সেটাকেই মূর্ধা বলে।
তারপর ত থ দ ধ ন এই ধ্বনিগুলি উচ্চারণের সময় বুঝতে পারবে জিভ আমাদের উপরের পাটির দাঁতের পিছনে স্পর্শ করছে।
সবশেষে শত চেষ্টা করলেও তোমরা ঠোঁট খুলে প ফ ব ভ ম উচ্চারণ করতেই পারবে না। বাড়িতে বহু প্র্যাক্টিস করলেও পুরোপুরি সম্ভব না। কারণ এই ধ্বনিগুলি শুধুমাত্র জিভ আর ঠোঁটের স্পর্শেই উচ্চারিত হয়ে থাকে।
আর ঙ ঞ ণ ন ম এইগুলি উচ্চারণের সময় অল্প হলেও নাসিকা সক্রিয় হয় তাই একটু নাকি সুর (nasal tune) আসে উচ্চারণে। ফলে নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে প্রতিটি বর্গের ব্যঞ্জনধ্বনি আলাদা আলাদা স্থান থেকে উচ্চারিত হচ্ছে।
ক থেকে ম পর্যন্ত ২৫টি ব্যঞ্জনধ্বনিকে এভাবে বর্গে ভাঙা হয়েছে –
বন্ধুরা এবারে দেখো এই ছকটার দিকে। প্রতিটি বর্গের ১ম আর ৩য় ধ্বনির দিকে তাকাও। উচ্চারণ করলেই তোমরা বুঝতে পারবে এই ধ্বনিগুলি উচ্চারণের সময় বেশিমাত্রায় বায়ু নিঃসৃত হয় না, এগুলির নাম অল্পপ্রাণ ধ্বনি।
আর ঐ একই বর্গের ২য় ও ৪র্থ ধ্বনিগুলি উচ্চারণের সময় অতিরিক্ত বায়ু নিঃসৃত হয় বলে তাদের বলা হয় মহাপ্রাণ ধ্বনি। আসলে ‘প্রাণ’ কথার অর্থ হল বায়ু বা শ্বাস। আবার গ, জ, ড, ব, ঘ, ঝ ইত্যাদি ধ্বনি উচ্চারণের সময় আমাদের কণ্ঠ গম্ভীর হয়ে যায়, আমাদের স্বরতন্ত্রী অনুরণিত হয়। তোমরা বুঝতে পারবে যে এগুলি উচ্চারণ করলে গলার স্বর ভারী ও মোটা হয়ে যায়। তাই এদের নাম দেওয়া হয়েছে ঘোষ ধ্বনি।
বর্গের ৩য় ও ৪র্থ ধ্বনিগুলি হল ঘোষ ধ্বনি। আর বর্গের ১ম ও ২য় ধ্বনিগুলি উচ্চারণের সময় কোনো গাম্ভীর্য থাকে না কণ্ঠে, মৃদু স্বরে উচ্চারিত হয় বলে এদের নাম অঘোষ ধ্বনি।
একেবারে শেষ অর্থাৎ বর্গের ৫ম ধ্বনিগুলি উচ্চারণ করলে দেখবে নাকি সুর (nasal tune) আসছে, তাই এদের নাসিক্য ধ্বনি বলা হয়েছে। কি অনায়াসে ছকের মাধ্যমে কঠিন জিনিসটা জলের মত সহজ হয়ে গেল। আশা করি ব্যাকরণে আর ভয় লাগছে না তোমাদের।
এই ছকের বাইরে এসো জেনে নিই উষ্ম ধ্বনি সম্পর্কে। শ, ষ, স এই তিনটি ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের মধ্যে কোথাও বাধা পায় না বায়ু, তাই একপ্রকার শিসধ্বনি তৈরি হয় বলে এদের উষ্ম ধ্বনি বলে।
এবারে নিজেরাই বলে দেখো ‘আশীষ’ কিংবা ‘শিশি’। শিসধ্বনি তৈরি হচ্ছে তো! আরেকটু অপেক্ষা করো বন্ধুরা। তাড়নজাত ধ্বনি-টি বাকি আছে। ড় এবং ঢ় উচ্চারণের সময় জিভ আমাদের মুখের মধ্যে অতিরিক্ত বায়ুর চাপ তৈরি করে। যেন মনে হয় জিভকে ঠেলে বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করে এগুলি উচ্চারিত হচ্ছে। তাই এদের এমন খটমট নাম দেওয়া হয়েছে তাড়নজাত ধ্বনি।
তবে বন্ধুরা এ প্রসঙ্গে তোমাদের উৎসাহ বাড়িয়ে তোলার জন্য বলে রাখি বাংলায় র, ড় এবং ঢ় এই তিনটি ধ্বনির আলাদা আলাদা উচ্চারণ যেমন আছে তেমনই শব্দে আলাদা আলাদা প্রয়োগও রয়েছে। সে ব্যাপারে আমরা আগেই একটি লেখা প্রকাশ করেছি। তোমরা চাইলে এই লিঙ্ক থেকে সেটি পড়ে নিতে পারো → বাংলা ভাষায় র, ড় এবং ঢ় এর প্রয়োগ।
ব্যঞ্জনধ্বনিগুলির মতো স্বরধ্বনিগুলিও মুখবিবরের বিভিন্ন অবস্থানে উচ্চারিত হয়। নিজেরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একেকটা করে উচ্চারণ করে করে মুখের আকৃতি বদল লক্ষ করলেই টের পাবে। যেমন ‘ই’ যেভাবে উচ্চারণ করো মানে উচ্চারণের সময় মুখের গড়ন যেমন হয়, ‘উ’ উচ্চারণের সময় পুরো পালটে যায় আবার ‘আ’ উচ্চারণের সময় এত বিস্তৃত হয় মুখবিবর তা অন্য কোনো স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে ঘটে না। ভালো করে অনুভব করে দেখবে, ‘ই’ উচ্চারণের সময় আমাদের জিভ সামনের দিকে এগিয়ে আসে, আবার ‘এ’ বলার সময়েও তাই।
ফলে, ই’ এ ধ্বনিগুলিকে বলা হয় সম্মুখ স্বরধ্বনি। ‘
উ’, ‘অ’ উচ্চারণের সময় জিভ পিছিয়ে আসে বলে সেগুলিকে বলে পশ্চাৎ স্বরধ্বনি।
এইরকম বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে যা একইভাবে ছকের মাধ্যমে দেখাচ্ছি তোমাদের বোঝার সুবিধের জন্য। ছকটি দেখে নিলে আশা করি কঠিন মনে হবে না আর বিষয়টি।
এখন শুধু পরিভাষাগুলি একটু বুঝিয়ে দিই।
মুখবিবর অল্প উন্মুক্ত করে যে স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয় তাকে আমরা সংবৃত স্বরধ্বনি বলি, অনেকটা উন্মুক্ত করে উচ্চারিত হলে বিবৃত স্বরধ্বনি বলি।
এই দুয়ের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে অর্ধসংবৃত এবং অর্ধবিবৃত স্বরধ্বনি। উদাহরণ ছকে দেখলেই পাবে, সেই সঙ্গে নিজেরাও উচ্চারণ করে দেখো। আর মুখবিবরের মধ্যে উল্লম্বভাবে জিভ কোন অবস্থানে থেকে স্বরধ্বনি উচ্চারণ করে তার ভিত্তিতে উচ্চ, মধ্য, নিম্ন ইত্যাদি ভাগ করা হয়েছে। দেখবে ‘ই’ উচ্চারণের সময় জিভ উপর দিকে থাকে আবার ‘আ’ বললে জিভ নেমে চলে আসে নিচে। এভাবে সহজে ছকের মাধ্যমে ধ্বনির উচ্চারণের স্থান ও প্রকারের ভিত্তিতে করা ভাগগুলি সম্পর্কে তোমাদের একটি ধারণা তৈরি হল।
এরপরের পর্বে এই উচ্চারণের সুবিধার জন্যেই কিভাবে ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে যায় তা তোমাদের বলবো। আজকের পর্ব এই অবধিই, ফিরে আসবো পরের পর্বে।
দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বর্ণ
লেখক পরিচিতিঃ
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা