ভূগোল – দশম শ্রেণি – আঞ্চলিক ভূগোল (সপ্তম পর্ব)
আগের পর্বে আমরা ভারতের উপকূলীয় সমভূমি সম্পর্কে আলোচনা করেছি এই পর্বে আমরা ভারতের নদনদী সম্পর্কে জেনে নেব।
ভারতবর্ষ একটি নদীমাতৃক দেশ। উত্তরে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু আবার দক্ষিণে কৃষ্ণা, গোদাবরী, কাবেরী ইত্যাদি নদ-নদী,খাল-বিল, জলাশয় ও হ্রদে পরিপূর্ণ এই দেশ।
হিমালয়ের বরফ গলা জল এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে এই নদ-নদীগুলি পুষ্ট হয় আবার কিছু জল মাটির তলায় প্রবেশ করেই ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার তৈরি করে।
এই ভাবেই ভারতবর্ষে বিশাল জলের ভান্ডার এর সৃষ্টি হয়েছে ,যা ভারতের জল সম্পদের অন্তর্ভুক্ত।
ভারতের জল সম্পদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
মৌসুমি বৃষ্টিপাত প্রতি বছর 3000 ঘনকিমি জলের যোগান দিয়ে থাকে। ভারতের জল সম্পদ মন্ত্রণালয় অনুসারে, ভারতের বার্ষিক মোট জলের পরিমাণ 1870 ঘনকিমি, যার মধ্যে 1120 ঘনকিমি হল ব্যবহারযোগ্য জল।
এর মধ্যে 690 ঘনকিমি বা 61.6% হল পৃষ্ঠ জল এবং 430 কিমি বা 38.4% হল ভৌমজল।
কেবল গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র নদী এই জলের অর্ধেকের বেশি প্রায় 55% এর বেশি জল বহন করে।
ভারতের নদনদী সম্পর্কিত আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓
ভারতের নদনদীসমূহ
বিন্ধ্য পর্বত ও সাতপুরা পর্বত, মধ্য ভারতের উচ্চভূমি ও ছোটনাগপুর মালভূমি জলবিভাজিকা রূপে ভারতের নদীগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। যথা – উত্তর ভারতের নদনদী এবং দক্ষিণ ভারতের নদনদী।
1. উত্তর ভারতের নদনদী
উত্তর ভারতের নদনদীগুলি প্রধানত হিমালয় বা সংলগ্ন অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। বেশিরভাগ নদী তাই চিরপ্রবাহী ও বরফগলা জলে পুষ্ট। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্যগুলি সম্পর্কে নীচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
গঙ্গা
গঙ্গা হল ভারতের দীর্ঘতম নদী। এর দৈর্ঘ্য 2500 কিলোমিটার এবং ভারতে এই নদী 2071 কিলোমিটার বিস্তৃত হয়েছে।
● উৎস
এই নদীর উৎপত্তি ঘটেছে উত্তরাখণ্ডের 7010 মিটার উচ্চতায় অবস্থিত গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ গুহা থেকে।
● প্রবাহ পথ
এই নদীর তিনটি গতিপথ বোঝা যায় বলে, এটি একটি আদর্শ নদীর উদাহরণ।
উচ্চগতি
উৎস স্থলে এই নদীর নাম ভাগীরথী। অলকানন্দা প্রবাহ দেবপ্রয়াগে এসে ভাগীরথী প্রবাহের সাথে মিশেছে।
দেবপ্রয়াগ থেকে অলকানন্দা ও ভাগীরথীর মিলিত প্রবাহ গঙ্গা নামে পরিচিত হয়েছে।
গোমুখ গুহা থেকে প্রায় 280 কিলোমিটার প্রবাহিত হওয়ার পর গঙ্গা হরিদ্বারে এসে পৌঁছেছে এবং এখানেই তার উচ্চগতি সমাপ্ত হয়েছে।
মধ্যগতি
হরিদ্বার থেকে বিহারের রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত গঙ্গার মধ্যগতিটি বিস্তৃত হয়েছে।
নিম্নগতি
বিহারের রাজমহল পাহাড় থেকে মোহনা পর্যন্ত হল এর নিম্নগতি। রাজমহল পাহাড় থেকে গঙ্গার দক্ষিণমুখী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানের কাছে শাখানদী রূপে ভাগীরথী- হুগলি নাম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।
মূল নদীটি পদ্মা নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
● উপনদী
গঙ্গার ডান দিক থেকে আগত উপনদীগুলির মধ্যে অন্যতম হল যমুনা যা গঙ্গার দীর্ঘতম উপনদী।
এর দৈর্ঘ্য 1376 কিলোমিটার। এছাড়া গঙ্গার ডান তীরের উপনদীর মধ্যে শোন নদী উল্লেখযোগ্য।
গঙ্গার বাম তীরের উপনদীগুলির মধ্যে অন্যতম হল গোমতী, ঘর্ঘরা, গণ্ডক, বুড়িগঙ্গা, রামগঙ্গা ইত্যাদি।
● শাখা নদী
মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলায় গঙ্গার মূল প্রবাহটি পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং গঙ্গা থেকে আরেকটি শাখা বেরিয়ে প্রথমে ভাগীরথী ও নবদ্বীপের পর থেকে হুগলি নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
সিন্ধু
সিন্ধু নদীর দৈর্ঘ্য 2880 কিলোমিটার যার মধ্যে ভারতের 1114 কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে।
● উৎস
সিন্ধু নদ তিব্বতের মানস সরোবরের কাছে 5182 মিটার উচ্চতায় কৈলাস পর্বতের একটি হিমবাহ থেকে সৃষ্টি হয়েছে।
● প্রবাহপথ
উৎস স্থলে এই নদীর নাম সেঙ্গেখাবাব। জাস্কার ও লাদাখ পর্বতের মাঝখান দিয়ে 809 কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এই নদী পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে পতিত হয়েছে।
● উপনদী
সিন্ধু নদের প্রধান পাঁচটি উপনদী আছে। সেগুলি হল শতদ্রু ইরাবতী চন্দ্রভাগা বিপাশা ও বিতস্তা।
ব্রহ্মপুত্র
ব্রহ্মপুত্র নদীর দৈর্ঘ্য 2900 কিলোমিটার যার মধ্যে ভারতে 885 কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে।
উৎস
ব্রহ্মপুত্র নদ তিব্বতের চেমায়ুং দুং হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে সাংপো নামে পরিচিত হয়েছে।
প্রবাহ পথ
ব্রহ্মপুত্র নদ ভারতবর্ষে প্রবেশের পর প্রথমে দিবং ও পরে দিহং নাম নিয়ে অরুণাচল প্রদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। উত্তর দিক থেকে আসা দিবং এবং দক্ষিণ দিক থেকে আসা লোহিত এখানে দিহং-এর সাথে মিলিত হয়।
দিবং, দিহং ও লোহিতের মিলিত প্রবাহ অসমে ব্রহ্মপুত্র নাম নিয়ে প্রবেশ করে এবং পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। এই নদ ধুবরির কাছে এসে বাংলাদেশে যমুনা নাম নিয়ে প্রবেশ করেছে। গোয়ালন্দের কাছে এটি গঙ্গার সাথে মিলিত হয়ে প্রথমে পদ্মা পরে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
উপনদী
ব্রহ্মপুত্রের ডান তীরের উপনদীগুলি হল সুবনসিড়ি, মানস, সংকোশ, তোরসা, তিস্তা প্রভৃতি এবং বাম তীরের উপনদীগুলি হল দিব্রু, বুড়ি ডিহং, ডিহিং, দিখু প্রভৃতি।
2. দক্ষিণ ভারতের নদনদী
প্রবাহের দিক অনুযায়ী দক্ষিণ ভারতের নদীগুলিকে পূর্ব বাহিনী ও পশ্চিম বাহিনী এই দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী হল পূর্ব বাহিনী নদীর উদাহরণ।
অন্যদিকে নর্মদা ও তাপ্তি হলো পশ্চিম বাহিনী নদীর উদাহরণ।
নর্মদা
নর্মদা নদীর দৈর্ঘ্য 1310 কিলোমিটার। এই নদীটি অমরকন্টক মালভূমির পশ্চিম প্রান্তে উৎপন্ন হয়ে সাতপুরা পর্বতের অন্তর্বর্তী গ্রস্ত উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে খাম্বাত উপসাগরে পতিত হয়েছে।
এই নদীটি চ্যুতি অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এই নদীর প্রবাহ পথে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়েছে।
এর মধ্যে জব্বলপুর এর কাছে অবস্থিত ধুয়াধার জলপ্রপাত এবং মাহেশ্বরের কাছে অবস্থিত সহস্রধারা জলপ্রপাত বিখ্যাত।
এই নদীর ডান তীরের উপনদীগুলির মধ্যে অন্যতম হল হিরণ, ওর সাং, বারনা, কোলার। এবং বাম তীরের উপনদীগুলির মধ্যে অন্যতম হলো বানজার, সার, সক্কর, কুন্দি প্রভৃতি।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
তাপ্তি
তাপ্তি নদীর দৈর্ঘ্য 724 কিলোমিটার।
তাপ্তি নদী মহাদেশের মুলতাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয় মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে অবস্থিত সাতপুরা পর্বতের গ্রস্ত উপত্যকার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে খাম্বাত উপসাগর পতিত হয়েছে।
পূর্ণা, গির্ণা ও পাঞ্জোরা হল এই নদীর প্রধান উপনদী।
মহানদী
মহানদীর দৈর্ঘ্য 857 কিলোমিটার। ছত্রিশগড়ের দণ্ডকারণ্যের সিয়াওয়া উচ্চভূমি থেকে এই নদী উৎপত্তি লাভ করে পূর্বঘাট পর্বতকে অতিক্রম করে কন্টকের কাছে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
এই নদীর প্রধান উপনদীগুলি হল মান্ড, ইব, হাসদেও, শেওনাথ প্রভৃতি।
গোদাবরী
এই নদীর দৈর্ঘ্য 1465 কিলোমিটার।
গোদাবরী দক্ষিণ ভারতের সর্ববৃহৎ এবং দীর্ঘতম নদী।
এই নদী দক্ষিণের গঙ্গা নামে পরিচিত। গোদাবরী নদী মহারাষ্ট্রের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ত্রিম্বক মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে এবং বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
এর ডান তীরের উপনদীগুলির মধ্যে মঞ্জিরা এবং বাম তীরের উপনদীগুলির মধ্যে পেনগঙ্গা, ওয়ার্ধা, ওয়েনগঙ্গা, ইন্দ্রাবতী ও শবরী উল্লেখযোগ্য।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
কৃষ্ণা
কৃষ্ণা নদীর উৎপত্তি হয়েছে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মহাবালেশ্বর এর উত্তর অংশ থেকে এরপর তা পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে। এই নদীর দৈর্ঘ্য 1400 কিলোমিটার।
কয়না, ঘাটপ্রভা, মালপ্রভা, ভীমা, তুঙ্গভদ্রা প্রভৃতি হলো কৃষ্ণা নদীর উপনদী।
কাবেরী
কাবেরী নদীর দৈর্ঘ্য 805 কিলোমিটার। কর্নাটকের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ব্রহ্মগিরি পর্বতে অবস্থিত তালা কাবেরী হ্রদ থেকে এই নদীর উৎপত্তি হয়েছে।
এই নদী মহীশূর মালভূমি ও দক্ষিণ কর্ণাটক মালভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পতিত হয়েছে। এই নদীর উপর শিবসমুদ্রম জলপ্রপাতটি অবস্থিত। এর উপনদীগুলি হল হেমাবতি, অর্কবতী, ভবানী, অমরাবতী প্রভৃতি।
কাবেরী নদীকে ভারতের পবিত্র নদী বলে গণ্য করা হয়।
অনেকে একে দক্ষিণের গঙ্গা নামে অভিহিত করে থাকেন।
এই নদীর বদ্বীপ অঞ্চল অত্যন্ত উর্বর বলে ইহা ‘দক্ষিণ ভারতের শস্য ভান্ডার’ হিসেবে পরিচিত।
উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের নদ নদীর তুলনা
অন্তর্বাহিনী নদী
যে সমস্ত নদী সাগরে পতিত না হয়ে দেশের ভিতরেই কোন হ্রদ বা জলাশয়ে পতিত হয় সেই নদীগুলিকে অন্তর্বাহিনী নদী বলা হয়।
যেমন – লুনি নদী আনাসাগর হ্রদ থেকে উৎপত্তি হয়ে কচ্ছের রানে পতিত হয়েছে।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতের হ্রদ ও উপহ্রদ
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-Geo-5-a-7