ভূগোল – দশম শ্রেণি – আঞ্চলিক ভূগোল (চতুর্থ পর্ব)
আগের পর্বে আমরা উত্তর ভারতের পার্বত্য অঞ্চল সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে ভারতের উত্তরের সমভূমি অঞ্চল সম্পর্কে জেনে নেবো।
উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓
তবে ভারতের এই উত্তরের সমভূমি কিন্তু শুধুমাত্র উত্তরেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বিস্তার পূর্ব ভারতেরও এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে (যার মধ্যে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে)। তবে আয়তনের বিচারে ভারতের উত্তর ভাগেই এর ব্যাপকতা বেশি দেখা যায় বলে, ভারতের ভূ-প্রকৃতির এই ভাগটি উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চল নামে খ্যাত।
ভারতের উত্তরের সমভূমি অঞ্চলের শ্রেণিবিভাগ
ভারতের উত্তরের সমভূমি অঞ্চলকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।
1. রাজস্থানের মরু অঞ্চল,
2. উত্তর ভারতের নদীগঠিত সমভূমি।
1.রাজস্থানের মরু অঞ্চল
রাজস্থানের মরু অঞ্চলের অবস্থান ও বিস্তার
এই মরু অঞ্চলটি আরাবল্লী পর্বতের পশ্চিমে অবস্থিত। এই মরু অঞ্চলের অধিকাংশ অংশ রাজস্থান এবং সামান্য অংশ দক্ষিণ এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মধ্যে পড়ে। এই বিস্তৃত মরু অঞ্চলটি থর মরুভূমি নামে পরিচিত। এই মরুভূমির ক্ষেত্রফল প্রায় 1.75 লক্ষ বর্গ কিলোমিটার।
ভূ-প্রকৃতি
পশ্চিমের মরু অঞ্চলের সমভূমি যার উচ্চতা 150 মিটার। ভূ-প্রকৃতিগতভাবে এই সমভূমি দুটি অংশে বিভক্ত যথা মরুস্থলি এবং বাগার। এই মরুভূমির পশ্চিমের বিস্তারিত অংশ মরুস্থলি নামে পরিচিত।
এটি একটি উদ্ভিদহীন, রুক্ষ, শুষ্ক এবং বালিয়াড়িতে পরিপূর্ণ।
এই অঞ্চলে অবস্থিত চলমান বালিয়াড়িগুলিকে ধ্রিয়ান বলা হয়।
এই মরু অঞ্চলের পূর্বদিকে আরাবল্লী পর্বতের পাদদেশে অপেক্ষাকৃত স্বল্প বালুকাময় অংশকে বাগাড় বলা হয়। এই বাগানের পূর্বাংশে নদী দ্বারা সৃষ্ট নদী বিধৌত উর্বর প্লাবনভূমিকে রোহি বলা হয়। লুনি নদীর উত্তর অংশে বালুকাময় ক্ষুদ্র মরু অঞ্চল থালি নামে পরিচিত।
এই ক্ষুদ্র মরু অঞ্চলের পশ্চিম প্রান্তে মরুস্থলি সীমানা পর্যন্ত বালি এবং শিলা দিয়ে গঠিত শুষ্ক অংশটি হামাদা নামে পরিচিত।
2. উত্তর ভারতের নদী গঠিত সমভূমি
উত্তর ভারতের নদী গঠিত সমভূমির অবস্থান
উত্তরে হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশ থেকে দক্ষিণে উপদ্বীপীয় মালভূমির উত্তরাংশ এবং পশ্চিমে আরাবল্লী পর্বতের পূর্ব থেকে গঙ্গা নদীর মোহনা পর্যন্ত এই সমভূমি বিস্তৃত হয়েছে। এটি হল ভারতের বৃহত্তম সমভূমি।
সিন্ধু গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের নদ-নদীর পলি দ্বারা সৃষ্ট এই পলিগঠিত এই সমভূমির নাম সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সমভূমি।
উত্তর ভারতের নদী গঠিত সমভূমির বিস্তার
এই নদী গঠিত সমভূমি পশ্চিম থেকে পূর্বে 3200 কিলোমিটার এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় 150 থেকে 300 কিলোমিটার বিস্তৃত। এই সমভূমির গড় উচ্চতা 200 মিটার।
উত্তর ভারতের নদী গঠিত সমভূমির ভূপ্রকৃতি
নদী গঠিত এই সমভূমিকে দৈর্ঘ্য বরাবর তিন ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি নিম্নে আলোচিত হল।
i. সিন্ধু সমভূমি
আরাবল্লী পর্বতের পূর্বে অবস্থিত রাজস্থানের সামান্য অংশ, সমগ্র পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় এই সমভূমি বিস্তৃত হয়েছে। এই সমভূমির দৈর্ঘ্য প্রায় 680 কিলোমিটার এবং প্রস্থ 300 কিলোমিটার। এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা 250 মিটার এবং এটি মূলত পঞ্চনদী অর্থাৎ শতদ্রু, বিপাশা, বিতস্তা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা নদীর পলি দ্বারা গঠিত হয়েছে। এই নদীগুলির মধ্যবর্তী স্থানকে দোয়াব বলা হয়।
যেমন – বিপাশা ও ইরাবতী নদীর মধ্যবর্তী অংশ হল বারি দোয়াব এবং ইরাবতী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল হলো রেচনা দোয়াব। এই সমভূমি অঞ্চলে কিছু সুউচ্চ টিলাময় ঢিবি দেখা যায় যেগুলো ‘ধায়া ‘ নামে পরিচিত। এই অঞ্চলের নবীন পলি গঠিত মৃত্তিকা অঞ্চলকে বলা হয় ‘ বেট ‘। এই সমভূমি অঞ্চলে শিবালিক পর্বতমালা থেকে আগত ছোট ছোট নদী দ্বারা যে ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমি ভাগ সৃষ্টি হয়েছে তাকে স্থানীয় ভাষায় চোস বা খোস (Chos) বলা হয়।
ii. গঙ্গা সমভূমি
অবস্থান অনুসারে সমগ্র গঙ্গা সমভূমিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়, যথা – উচ্চ গঙ্গা মধ্য গঙ্গা ও নিম্ন গঙ্গা।
• উচ্চ-গঙ্গা সমভূমি
এই সমভূমি উত্তরে 300 মিটার সমোন্নতি রেখা এবং দক্ষিণে উপদ্বীপীয় ভারত, পূর্বে 100 মিটার সমোন্নতি রেখা এবং পশ্চিমে যমুনা নদীর গতিপথের মধ্যবর্তী স্থানে বিস্তৃত হয়েছে এই সমভূমির গড় উচ্চতা 100 থেকে 300 মিটার রামগঙ্গা, যমুনা, গোমতী, ঘর্ঘরা নদী এই সমভূমির উপর দিয়ে বাহিত প্রধান নদী।
এই অঞ্চলে তরাই এবং ভাবর অঞ্চল দেখা যায়।
শিবালিকের পাদদেশে 8 থেকে 16 কিলোমিটার প্রস্থবিশিষ্ট নদী বাহিত নুড়ি, কাকর, বালি ও পলি দ্বারা গঠিত অংশটি ভাবর নামে পরিচিত।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
এই অঞ্চলে নদীগুলি অন্তঃসলিলা রূপে প্রবাহিত হয়। ভাবরের দক্ষিণে সমান্তরালে 20 থেকে 30 কিলোমিটার বিস্তৃত অংশটি তরাই নামে পরিচিত। এই অংশটি মূলত বালি ও পলি দ্বারা গঠিত। অন্তঃসলিলা নদীগুলি এই অংশে আত্মপ্রকাশ করে থাকে। উচ্চ গঙ্গা সমভূমির পুরানো পলি দ্বারা গঠিত অংশটি ভাঙ্গড় নামে পরিচিত। এই অংশটি কাদামাটি ও কাঁকর দ্বারা গঠিত হওয়ায় একে কঙ্করও বলা হয়।
এই অঞ্চলের নবীন পলি গঠিত সমভূমিটি খাদার নামে পরিচিত। পরিত্যক্ত নদী বাঁক, নদীবাক, স্বাভাবিক বাঁধ ইত্যাদি হল এই অঞ্চলের ভূমিরূপের বৈশিষ্ট্য।
এই অঞ্চলে নদীগুলি উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়েছে।
• মধ্য গঙ্গা সমভূমি
এই সমভূমি উচ্চ গঙ্গা সমভূমির পূর্ব অংশে উত্তর প্রদেশ বিহার নিয়ে গঠিত হয়েছে এই সমভূমির গড় উচ্চতা 150 মিটার। ঘর্ঘরা, গণ্ডক, কোশী হল এই অঞ্চলের প্রধান নদী। এই সমভূমিটি গভীর। এর গড় গভীরতা 2000 মিটার এবং এই সমভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলি প্রায়ই গতিপথ পরিবর্তন করে থাকে।
এর মধ্যে কোশী নদীকে বিহারের দুঃখ বলা হয়।
• নিম্ন গঙ্গা সমভূমি
নিম্ন সমভূমি বিহারের পূর্বভাগ থেকে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এই সমভূমির গড় উচ্চতা 30 মিটার। ভাগীরথী, জলঙ্গি, চূর্ণী, হুগলি, বিদ্যাধরী, পদ্মা হলো এই অঞ্চলের প্রধান নদী। এই সমভূমির দক্ষিণ অংশে প্রায় 2/3 অংশ বদ্বীপ সমভূমি নামে পরিচিত। যেখানে খাঁড়ি, ম্যানগ্রোভ বনভূমি, এবং বালিয়াড়ির দেখা মেলে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
ভাঙ্গর ও খাদারের পার্থক্য
iii. ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অপর নাম হল অসম উপত্যকা। এই সমভূমি শিবালিক পর্বতমালার পাদদেশ থেকে দক্ষিণে মেঘালয় মালভূমির পাটকই, নাগা, গারো, খাসি, জয়ন্তিয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী অংশে বিস্তৃত হয়েছে। এই উপত্যকাটি দৈর্ঘ্য 720 কিলোমিটার এবং প্রস্থ 60 থেকে 100 কিলোমিটার নদীর পলি দ্বারা সমভূমির গঠন হয়েছে।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতের মালভূমি অঞ্চল
লেখিকা পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী শ্রেয়সী বিশ্বাস। পড়াশোনা এবং লেখালিখির পাশাপাশি, ছবি আঁকা এবং বাগান পরিচর্যাতেও শ্রেয়সী সমান উৎসাহী।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-Geo-5-a-4