bhagoboter-onubad
Class-11

ভাগবতের অনুবাদ | মধ্যযুগে বাংলার সমাজ সাহিত্য

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)


এর আগে মহাভারতের অনুবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা ভাগবতের অনুবাদ সম্পর্কে আলোচনা করবো।

রামায়ণ আর মহাভারতের অনুবাদের কথা তো জানলে বন্ধুরা। আগেই বলেছি ভাগবতের অনুবাদের ব্যাপারেও তোমাদের জানতে হবে। তাহলে আর দেরি না করে চলো ভাগবতের অনুবাদ আর মালাধর বসু সম্পর্কে কী কী আমাদের জেনে নিতে হবে, একবার দেখে নিই।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো শ্রীমদ্‌ভাগবত গীতা আর এই ভাগবত কিন্তু এক নয়। ভাগবত হল পুরাণ, এর পুরো নাম শ্রীমদ্‌ভাগবত পুরাণ। আমাদের হিন্দু ধর্মে মোট আঠারোটি পুরাণ আছে।

পুরাণ কী জিনিস তোমরা জানো কি?

দাঁড়াও দাঁড়াও, মাথা চুলকিয়ে না এখনই। চিন্তায় পড়ে গেলে দেখছি! খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থ বলতে তোমরা জানো বেদের কথা। এই বেদ চার প্রকার ছিল জানো নিশ্চয়ই। তো বন্ধুরা সেই বেদের মধ্যে থাকা শ্লোকগুলি এত জটিল ছিল যে তা সকলকে বোঝানোর সুবিধার জন্য কিছুটা সরলীকরণ করে লেখা হয় বেদাঙ্গ এবং সংহিতা এবং আরো পরে লেখা হয় উপনিষদ। এই উপনিষদও রয়েছে অনেকগুলি এবং এই উপনিষদ থেকেই নানা কাহিনি নিয়ে নতুনভাবে এই পুরাণগুলি লেখা হয়েছিল। পুরাণ আসলে দেবদেবীদের নিয়ে নানাবিধ গল্পের সমাহার।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

আমাদের এই যে তেত্রিশ কোটি দেবতা সবই এসেছে বিভিন্ন পুরাণ থেকে। বেদে কিন্তু নিরাকার ঈশ্বরের ধারণাই বর্ণিত ছিল। এই বিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হল, মানুষ কীভাবে এলো, কত-শত রাজা, মহারাজা প্রাচীনকালে ছিলেন, ঋষিরা ছিলেন, ছিল নানা রকম দেবতা আর উপদেবতা – এসবই পুরাণে লেখা আছে। সব থেকে বড়ো কথা হল, হিন্দুধর্মের দার্শনিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে পুরাণগুলিকে কেন্দ্র করেই। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, পদ্মপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, স্কন্দপুরাণ ইত্যাদি আরও বহু রয়েছে। প্রতিটি পুরাণেই কোনো না কোনো দেব-দেবীর কথা রয়েছে।

পুরাণ নিয়ে কথা শুরু করলে আর এই ক্লাসে অন্য আলোচনা করা হবে না বন্ধুরা, পুরাণের আলোচনা অনন্ত, অসীম। তাই আপাতত পুরাণের মাঠ থেকে আমরা ভাগবতের প্যাভেলিয়নে ফিরে আসি।

মোট আঠারোটি পুরাণের মধ্যে অন্যতম হলো ভাগবত পুরাণ যেখানে মূলত শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও লীলা বর্ণিত হয়েছে। ভাগবত পুরাণে মোট আঠারো হাজার শ্লোক রয়েছে এবং রয়েছে মোট ১২টি স্কন্দ।

পুরাণের কাহিনিতে বিষ্ণুর দশাবতারের উল্লেখের পাশাপাশি দশম ও একাদশ স্কন্দে বর্ণিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালের নানা ঘটনা। একমাত্র এই পুরাণেই শ্রীকৃষ্ণের জীবন কথা জানতে পারা যায় বলে এটি বৈষ্ণবধর্মে খুবই প্রাধান্য পায়। শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা, বলা ভালো গোপালের নানাবিধ ঘটনা কিন্তু এখান থেকে জানা যায়।

এই সংস্কৃত ভাগবত পুরাণের দশম ও একাদশ স্কন্দ অবলম্বন করেই মালাধর বসু রচনা করেছিলেন তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

আমাদের কাঠামো অনুযায়ী আমরা আগে মালাধর বসু সম্পর্কে খানিক জেনে নিই, তারপর তাঁর কাব্য সম্পর্কে জানবো।

মালাধর বসু চৈতন্য-পূর্ব যুগের কবি, বলা ভালো পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই তার জন্ম। তাঁর জন্মকাল নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে, তবে অনেকে মনে করেন ১৪২০ থেকে ১৪২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি বর্ধমানের কুলীন গ্রামে জন্মেছিলেন। কায়স্থ বংশীয় মালাধর বসুর বাবার নাম ছিল ভগীরথ এবং মায়ের নাম ছিল ইন্দুমতী।

পরবর্তীকালে মালাধর বসুর পৌত্র অর্থাৎ নাতি সত্যরাজ খান শ্রীচৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ হয়েছিলেন বলে জানা যায়। তোমরা প্রশ্ন করতেই পারো যে, মালাধর বসুর নাতির পদবি ‘খান’ কেন হল? এখানে আরেকটি ইতিহাস লুকিয়ে আছে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য রচনার জন্য গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বরবক শাহ তাঁকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধি দিয়েছিলেন। এই কথা তিনি তাঁর কাব্যেও উল্লেখ করেছেন এবং সেই থেকেই ‘খান’ পদ্ধতিটি ব্যবহার করতেন মালাধর বসু। তাহলে এখানে কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলে দিলাম অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে মালাধর বসুকে কে, কী উপাধি দিয়েছিলেন। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যটি মনে করা হয় ১৪৭৩ থেকে ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা শেষ হয়ে গিয়েছিল, এই বর্ণনাও মালাধর বসু কাব্যের মধ্যে দিয়েছেন –

‘তেরশ পঁচানই শকে গ্রন্থ আরম্ভন।
চতুর্দশ দুই শকে হইল সমাপন।।’

এই ভঙ্গিতে বর্ণিত ১৩৯৫ শকাব্দ এবং ১৪০২ শকাব্দ আসলে ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দ এবং ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দ। দীর্ঘ আট বছর ধরে তিনি এই কাব্যটি লিখেছিলেন। এখন ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যের মধ্য দিয়েই তিনি প্রথম ভাগবতের বাংলা অনুবাদ করেন।

বাংলায় ভাগবত অনুবাদের প্রথম পথিক বলা হয় মালাধর বসুকে।

তাই তাঁর কাব্য এত বিখ্যাত। এবারে কাব্যের বিষয়ে আলোচনায় আসি বন্ধুরা।
· ভাগবতের অনুবাদ করতে গিয়ে মালাধর বসু তাঁর কাব্যের নাম দিলেন ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’।

এখন এই ‘বিজয়’ কথাটির তাৎপর্য কী?

ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্দের কাহিনিতে কৃষ্ণের শক্তি ও ঐশ্বর্যের বর্ণনা রয়েছে, অশুভ শক্তির উপর কৃষ্ণের শক্তির বিজয়কেই আসলে এই নামের মধ্য দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন কবি।

· বৈষ্ণবীয় ভক্তিরসের প্রাধান্য এই কাব্যে নেই, বরং তাকে ছাপিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে কৃষ্ণের ঐশ্বরিক বিজয়গাথা, তাঁর শক্তির প্রাবল্য। প্রেমের মাধুর্য নয়, বরং শক্তির প্রাচুর্যই এই কাব্যের মূল বিষয়। আসলে সেই সময়কার তুর্কি আক্রমণে বিধ্বস্ত দুর্বল, পরাজিত, হীনমন্য বাঙালি জাতিকে বলবীর্যবান এবং হতাশামুক্ত করে তুলতেই এই প্রয়াস করেছিলেন কবি মালাধর বসু। ভক্তিরস নয়, রৌদ্ররসের কাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’।

· কাব্যের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা, মথুরা লীলা ও দ্বারকা লীলার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণের আবির্ভাব থেকে দ্বারকায় কৃষ্ণের মৃত্যু পর্যন্ত কাহিনির বিস্তার। তবে মালাধর বসু অপূর্ব মুন্সিয়ানায় গোপিনীদের কথা, রাসলীলার কথা খুব কমই কাব্যের মধ্যে বলেছেন; তার বদলে কৃষ্ণের শক্তি প্রকাশের প্রসঙ্গগুলিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলে তাঁর কাব্য রচনার মূলে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল, সেটা বোঝা যায়। তাই ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ ভাগবতের হুবহু অনুবাদ হয়ে ওঠেনি, সেখানে কবির নিজস্বতা এবং মৌলিকতাই রূপ পেয়েছে।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

· সংস্কৃত ভাষার জটিলতা থেকে মুক্ত করে সহজ, সরল বাংলায় পাঁচালির ছন্দে এই কাব্য লেখার কারণে বাঙালিদের মধ্যে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মালাধর বসু তাঁর কাব্যের মধ্যেই লিখেছেন –

ভাগবত অর্থ যত পয়ার বান্ধিয়া।
লোক নিস্তারিতে যাই পাঁচালী রচিয়া।।

অর্থাৎ স্পষ্ট বোঝা যায় লোকশিক্ষার উদ্দেশ্যেই পাঁচালি জাতীয় কাব্য লেখা কবির লক্ষ্য ছিল।
· এছাড়া কাব্যে বৃন্দাবন, মথুরা আর দ্বারকার প্রাকৃতিক বর্ণনা করে দিয়েছেন তা বাংলাদেশের সবুজ, শ্যামল, মনোরম পরিবেশের সঙ্গে মিলে যায়। কৃত্তিবাসের মতো তিনিও ভাগবতের পরিবেশকে বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, জল-হাওয়ায় মিশিয়ে দিয়েছেন বলা যায় যা কাব্যের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।

এই কাব্য ‘গোবিন্দবিজয়’, ‘গোবিন্দমঙ্গল’ নামেও পরিচিত। কৃষ্ণকথা বর্ণনায় বাঙালি কবি মালাধর বসু এই কারণেই অগ্রগণ্য। ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ গ্রন্থে বলা আছে যে স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব এই ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য পড়েছিলেন।

অন্যান্য অনুবাদ

মালাধর বসুর পরে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য ধারা থেকে তৈরি হয় ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ কাব্য ধারা। পঞ্চদশ শতাব্দীতে যশোরাজ খান, ষোড়শ শতাব্দীতে গোবিন্দ আচার্য, দ্বিজ মাধব, অষ্টাদশ শতাব্দীতে অভিরাম দাস প্রমুখ অনেক কবিই কৃষ্ণমঙ্গল কাব্য লিখেছেন।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → মঙ্গলকাব্য

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_6