chondi-mongol-kabyo
Class-11

চণ্ডীমঙ্গল কাব্য | মধ্যযুগে বাংলা সমাজ সাহিত্য

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)

এর আগে মনসামঙ্গল কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা চণ্ডীমঙ্গল কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করবো।
বন্ধুরা আবার দেখা হয়ে গেল তোমাদের সাথে। আগের ক্লাসগুলোতে একেবারে বাংলার আদ্যিকাল থেকে শুরু করে অনেকদূর এগিয়ে এসেছি আমরা তাই না? চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পেরিয়ে এখন আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসের ট্রেন এসে থেমেছে মঙ্গলকাব্যের স্টেশনে। স্টেশনে চারটে প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। একটা প্ল্যাটফর্ম ঘুরে দেখা হয়ে গেছে আমাদের, মনসামঙ্গল কাব্য।

আজকের প্ল্যাটফর্মের নাম চণ্ডীমঙ্গল কাব্য।

মঙ্গলকাব্য বলতে তোমরা নিশ্চয়ই এখন জানো যে, প্রতিটি মঙ্গলকাব্যের কাহিনির পর্যায়ক্রম একই রকমের। কোনো এক দেবীর পূজা প্রচারের জন্য সেই কাব্যের কাহিনীর অবতারণা করা হয়।

মনে রাখতে হবে, সেই সব দেবীরা কিন্তু কেউই পৌরাণিক দেবী নন, সকলেই লৌকিক দেবী। চণ্ডীও তাই, মনসাও তাই। ফলে তাঁদের পূজা প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল।

এখন দেখার বিষয় চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনীটা ঠিক কীরকম। দেবী চণ্ডীর প্রকৃত নাম কিন্তু ‘অভয়া’, চণ্ডীমঙ্গলের কবিরাও তাঁদের কাব্যের নাম অনেকক্ষেত্রেই ‘অভয়ামঙ্গল’ রেখেছেন।
ঐতিহাসিকেরা বলছেন চৈতন্যদেবের সময়কালে বাংলায় মঙ্গলচণ্ডীর গীত আয়োজিত হত। সেটা মোটামুটিভাবে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে। তবে এই মঙ্গলচণ্ডীর গীত আসলে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনীরই সাঙ্গীতিক রূপ মাত্র।

বন্ধুরা একটা তথ্য মনে রেখো, মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে একমাত্র চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেই মঙ্গলকাব্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়।

কাহিনীর বৈশিষ্ট্য স্বরূপ চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও দুটি খণ্ড রয়েছে – দেবখণ্ড ও নরখণ্ড। দেবখণ্ডের মধ্যে রয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব, নীলাম্বরের অভিশাপ প্রাপ্তি, হরগৌরীর সংসার-জীবন ইত্যাদি। অন্যদিকে এই কাব্যের নরখণ্ড দুটি ভাগে বিভক্ত – একটিকে বলা হচ্ছে আখেটিক খণ্ড আর অন্যদিকে বলা হচ্ছে বণিক খণ্ড।


একাদশ শ্রেণি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

আখেটিক খণ্ড হল কালকেতু আর ফুল্লরার গল্প এবং বণিক খণ্ড হল ধনপতি, খুল্লনা, লহনা ও ধনপতির পুত্র শ্রীমন্তের গল্প। তোমরা হয়তো ভাবছো এ কোন দেশী গল্প? কেই বা নীলাম্বর? কেনই বা হর-গৌরীর সংসার জীবন? তাই তো? অত ভাবনার কিছুই নেই। খুব সহজ করে জলের মত তরল করে তোমাদের জন্য গল্পটা সাজিয়ে দিচ্ছি। একবার পড়লেই মাথায় থেকে যাবে।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের সূচনা অংশে এই দেবখণ্ডটি রয়েছে। আসলে এই কাহিনির আখেটিক খণ্ডের প্রধান চরিত্র কালকেতু ও ফুল্লরা। কিন্তু যেহেতু সেকালের কাব্যে মানুষের কথা বলা যেত না, দৈবী প্রাধান্যের কারণে মঙ্গলকাব্যের কবিরা লিখেছেন যে এই কালকেতু আর ফুল্লরা আসলে মানুষ নয়, অভিশাপগ্রস্ত দেব-দেবী। স্বর্গলোকে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর আর আরেক দেবী ছায়া অভিশাপগ্রস্ত হয়ে মর্ত্যে কালকেতু আর ফুল্লরা হয়ে জন্মেছেন। ফলে দেবখণ্ডে আগে নীলাম্বর আর ছায়ার গল্প বলা দরকার, তাই তা বলা হয়েছে আর মঙ্গলকাব্যের চিরাচরিত দেব-বন্দনার অংশের মত এখানে হর-গৌরীর জীবনযাপনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

এটা একপ্রকার একটা বড় উপন্যাসের উপকাহিনির মত। এই নীলাম্বর আর ছায়ার পরবর্তী আখ্যান শুরু হয় আখেটিক খণ্ডে কালকেতু আর ফুল্লরা হিসেবে। কালকেতু একজন ব্যাধ, পশু শিকার করে তা বাজারে বিক্রি করে তাঁর অন্নসংস্থান হয়, ফুল্লরা তাঁর স্ত্রী। তাঁদের অভাবের সংসারে একদিন দেবী চণ্ডী স্বর্ণগোধিকার (সোনার গোসাপ) বেশে তাঁদের ঘরে আসেন এবং বর দেন। দেবীর বরে বন কেটে কালকেতু গুজরাট নগর পত্তন করেন এবং ছলে-বলে দৈবী মায়ার সহায়তায় সেই নগরে লোকজনের সমাগম ঘটান।

ক্রমে গুজরাট নগরের রাজা হিসেবে কালকেতুর জীবন শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে আরো দুর্বিপাকে পড়ে তাঁকে কারাবাস করতে হয়, এর মধ্যেই চলে আসে ফুল্লরার বারমাস্যার বর্ণনা এবং কালকেতুর মুক্তির জন্য চৌতিশা স্তব। এভাবে কালকেতু আর ফুল্লরার নশ্বর দেহের মৃত্যু ঘটে এবং আখেটিক খণ্ডের কাহিনি সমাপ্ত হয়। তারপরে শুরু হয় বণিক খণ্ডের কাহিনি। তবে বণিক খণ্ডে প্রবেশের আগে তোমাদের পরীক্ষায় যদি চণ্ডীমঙ্গলের আখেটিক খণ্ডের কাহিনি নিয়ে উত্তর লিখতে হয় সেক্ষেত্রে এত সংক্ষেপে তো লিখলে চলবে না। তাই এবারে পরীক্ষার উপযোগী করে কী লিখতে হবে দেখে নাও বন্ধুরা।]

আখেটিক খণ্ডের কাহিনি

চণ্ডীর প্ররোচনায় শিব ইন্দ্রের পুত্র নীলাম্বরকে ফুল তোলার কাজে ভুল করায় অভিশাপ দিয়ে মর্ত্যে পাঠান। মর্ত্যে ব্যাধ ধর্মকেতুর পুত্ররূপে নীলাম্বরের জন্ম হয় এবং তাঁর নাম হয় কালকেতু। নীলাম্বরের পত্নী ছায়ারও মনুষ্যজন্ম হয় কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরা রূপে। ফুল্লরা আরেক ব্যাধ সঞ্জয়কেতুর কন্যা। বড়ো হয়ে কালকেতুর সঙ্গে ফুল্লরার বিবাহ হয়। কালকেতুর অত্যাচারে এদিকে বনের পশুরা সকলে অতিষ্ঠ হয়ে দেবী চণ্ডীর কাছে একযোগে প্রার্থনা জানায় এবং তাঁদের সেই আবেদনে চণ্ডী একদিন সোনার গোসাপের বেশে তথা স্বর্ণগোধিকা সেজে কালকেতুর শিকারে যাওয়ার পথে পড়ে থাকেন।


একাদশ শ্রেণি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

অশুভ সোনালি গোসাপ দেখে কালকেতু প্রচণ্ড রাগে সেটিকে ধনুকের গুণে বেঁধে নিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন। সেদিন সারা বন ঘুরেও কোনো শিকার পাননি কালকেতু। এদিকে কালকেতু বেরিয়ে যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী ফুল্লরার স্বল্পকালীন অনুপস্থিতির সুযোগে দেবী চণ্ডী এক সুন্দরী ষোড়শী রমণীর বেশ ধারণ করেন এবং তাঁকে নিজের সতীন ভেবে আশঙ্কিত ফুল্লরা তাঁর দুঃখের বারমাস্যা শুনিয়ে তাঁকে বিদেয় করার চেষ্টা করেন। তারপর কালকেতু ফিরে আসে ঘরে আর তিনিও দেবীকে বিদেয় করতে ব্যর্থ হওয়ায় ধনুকের ছিলায় গুণ পরাতে উদ্যত হন। সেই মুহূর্তেই দেবী চণ্ডী নিজ মূর্তি ধারণ করে কালকেতু ও ফুল্লরাকে সাত ঘড়া ধন ও একটি মহামূল্যবান হিরের আংটি দিয়ে গুজরাত নগর পত্তনের আদেশ দেন।

দেবীর পরামর্শ অনুযায়ী বিপুল অর্থ ব্যয় করে বন কেটে কালকেতু পত্তন করেন এই গুজরাত নগর। এদিকে ভাঁড়ু দত্ত নামে এক শঠ ব্যক্তির অত্যাচারে অতিষ্ঠ প্রজাদের নালিশ শুনে তাঁকে রাজ্য থেকে বের করে দেন কালকেতু। ভাঁড়ু দত্ত রাগে-ক্রোধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কলিঙ্গরাজকে কালকেতুর বিরুদ্ধে উক্ত্যক্ত করেন এবং কলিঙ্গরাজের সঙ্গে যুদ্ধে কালকেতু বন্দি হন। অবশেষে কাব্যে দেখা যায় দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে মুক্ত করেন এবং কালকেতু তাঁর রাজ্যপাট ফিরে পান। এরপরই মহাসমারোহে দেবী চণ্ডীর পূজা প্রচলিত হয় মর্ত্যে। দীর্ঘকাল রাজ্যভার সামলানোর পর পুত্রের হাতে তা অর্পণ করে কালকেতু ও ফুল্লরা স্বর্গে চলে যান।
এই কাহিনিতে একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে বন্ধুরা, দেবী চণ্ডীর পূজা কিন্তু প্রথমে সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষদের হাতেই প্রচারিত হয়েছে। দেবী এতে খুশি ছিলেন না, তিনি চেয়েছিলেন সমাজের উচ্চবিত্ত লোকেরাও তাঁর পূজা করুক। ঠিক যেমন মনসা চেয়েছিলেন চাঁদ সদাগর তাঁর পূজা করুক।

এখানেও দেবী চণ্ডী চাইলেন বণিক ধনপতি আর শ্রীমন্ত তাঁর পূজা করুক। এই কাহিনি থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে মধ্যযুগের সমাজে বণিকদের এক বিরাট স্থান ছিল। যে কারণে দেবীরাও তাঁদের হাতে পূজিতা হতে চাইতেন। ফিরে আসি আলোচনায়। বন্ধুরা এবার আমরা আগের মতোই খুব সংক্ষেপে চণ্ডীমঙ্গলের বণিক খণ্ডের কাহিনিটি জেনে নেবো।

বণিক খণ্ডের কাহিনি

এই অংশের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ধনপতি আর তাঁর দুই স্ত্রী লহনা ও খুল্লনার কাহিনিকে কেন্দ্র করে। উজানী নগরের নিঃসন্তান বণিক ধনপতি তাঁর স্ত্রী লহনার সম্মতি আদায় করে খুল্লনাকে বিবাহ করেন। বাণিজ্যে যাওয়ার আগে তিনি খুল্লনার সমস্ত ভার দিয়ে যান লহনার উপরে। লহনা ও খুল্লনার মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তাঁদের দাসী দুর্বলা।

ধনপতির নাম দিয়ে একটি জাল চিঠি খুল্লনাকে দেওয়া হয় আর সেই চিঠির বয়ান অনুযায়ী খুল্লনা ছাগল চরাবে, ঢেঁকিশালে শোবে, এক বেলা আধপেটা খাবে এবং খুঁয়ার বস্ত্র অর্থাৎ শণের সুতোয় তৈরি মোটা কাপড় পরবে। একদিন বনে ছাগল চরাবার সময় অসতর্কতাবশত খুল্লনার সর্বশী নামে ছাগলটি হারিয়ে যায়। সেই ছাগলের খোঁজ করতে গিয়ে খুল্লনা আবিষ্কার করে পঞ্চদেবকন্যাকে। তাঁদের কাছে চণ্ডীপূজা করতে শেখে সে। এদিকে ধনপতি বাড়ি ফিরে এসে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে লহনাকে অত্যন্ত তিরস্কার করেন। এর কিছুদিন পরেই ধনপতি সপ্তডিঙা সাজিয়ে সিংহল যাত্রা করেন এবং স্বামীর মঙ্গলকামনায় খুল্লনায় চণ্ডীপূজায় রত হয়।

শিবের উপাসক ধনপতি তা জানতে পেরে লাথি মেরে চণ্ডীর ঘট ভেঙে দেন। দেবী চণ্ডী এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ-পরায়ণ হয়ে সমুদ্রে বিশাল ঝড় তুলে ধনপতির ছয়টি ডিঙা ডুবিয়ে দেন জলে।

কোনোরকমে একটি ডিঙা নিয়ে ধনপতি পৌঁছান কালীদহে আর সেখানেই দেবী চণ্ডীর ‘কমলে-কামিনী’ রূপ দেখেন।


একাদশ শ্রেণি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

সিংহলে গিয়ে সেখানকার রাজাকে এই ‘কমলে-কামিনী’র কথা বলায় রাজা তা বিশ্বাস না করে উপরন্তু ধনপতিকে কারারুদ্ধ করেন। এদিকে খুল্লনার পুত্র শ্রীমন্ত বড় হয়ে বাবার খোঁজে সিংহল যাত্রা করেন এবং পথে তিনিও সেই ‘কমলে-কামিনী’ মূর্তি দেখতে পান। কিন্তু তাঁর কথাও সিংহলের রাজার বিশ্বাস হয় না, ফলে তাঁর শিরশ্ছেদ করার জন্য তাঁকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চণ্ডীর কৃপায় অবশেষে সিংহলরাজ ‘কমলে-কামিনী’ মূর্তি দেখেন। ফলশ্রুতিতে রাজা শ্রীমন্তকে অর্ধেক রাজত্ব দেন এবং তাঁর কন্যা সুশীলার সঙ্গে তাঁর বিবাহও দেন। কিছুকাল পরে পুত্র ও পুত্রবধূকে সঙ্গে ধনপতি ফিরে আসেন স্বদেশে। তারপর ধনপতি নিজেই চণ্ডীর পূজা শুরু করেন।

মনসামঙ্গলের কাহিনি আর এই চণ্ডীমঙ্গলের বণিক খণ্ডের মধ্যে কিছু মিল খুঁজে পাচ্ছো কি বন্ধুরা? ভালো করে দুটো গল্পই একবার করে পড়ো। দেখবে অনেক মিল খুঁজে পাবে। আচ্ছা আমি বলেই দিই। আগে শোনো, তারপর নিজেরাই মিলিয়ে দেখো। মনসামঙ্গলে চাঁদ সদাগর বণিক, সে সপ্তডিঙা সাজিয়ে বাণিজ্যে যায়-তার মধ্যে মনসার অভিশাপে সাতটি ডিঙাই ডুবে যায়; এদিকে চণ্ডীমঙ্গলেও দেখো ধনপতি বণিক সাতটি ডিঙা সাজিয়ে বাণিজ্যে যায়, একইভাবে তাঁরও ছয়টি ডিঙা ডুবে যায়।

আরেকটা মিলও আছে। মনসামঙ্গলে মনে করে দেখো চণ্ডীর কোপে লখিন্দরের প্রাণ গিয়েছিল সাপের বিষে, এখানে অনেকটা একইরকম কাহিনির ছায়া আছে। বণিক খণ্ডে ধনপতির পুত্র শ্রীমন্তকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মারার জন্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়নি। এখন প্রশ্ন হল দুটি খণ্ডে দুটি আলাদা কাহিনি বলার দরকার পড়লো কেন?

আসলে আগেই বলেছি, সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষের পাশাপাশি উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছেও পূজা প্রচারিত হওয়ার মানসেই এই দুটি কাহিনির অবতারণা। তবে মনসামঙ্গলই হোক বা চণ্ডীমঙ্গল, তা মধ্যযুগে লেখা হলেও আজও অত্যন্ত আধুনিক।
বন্ধুরা, চণ্ডীমঙ্গল পড়া হল, কাহিনি জানা হল, বাকি রইল কবিকে জানা।

চণ্ডীমঙ্গলের প্রথম কবি হিসেবে ঐতিহাসিকদের মতে মানিক দত্তের নামই উঠে আসে।

কিন্তু চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিখ্যাত হলেন কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। আমরা এবারে তাঁর সম্পর্কে এবং তাঁর লেখা চণ্ডীমঙ্গল কাব্যটির সম্পর্কে দু-চার কথা জেনে আজকের ক্লাসে ইতি টানবো। মনসামঙ্গলের মতোই কবি মুকুন্দরাম তাঁর কাব্যের গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশে নিজের জীবনকথা সম্পর্কে বলেছেন। তা ছাড়া অন্য কোথাও বিশেষ তাঁর সম্পর্কে জানা যায় না।

মুকুন্দরাম চক্রবর্তী : জীবন ও কবিপ্রতিভা

বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে কবির বসবাস ছিল। তাঁর বাবার নাম হৃদয় মিশ্র, মায়ের নাম দৈবকী। চাষ-আবাদ করেই তাঁদের অন্নসংস্থান হত। কিন্তু এক সময় দেশে অরাজকতা দেখা দেয়। মোগল শাসক আর জোতদারদের অত্যাচারে জমি-বাড়ি, ভিটেমাটি খুইয়ে কবি সপরিবারে চলে আসেন কুচট্যা গ্রামে। সেখানেই ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় আর পরিশ্রমের ক্লান্তিতে নিদ্রামগ্ন হন কবি আর তখনই দেবী চণ্ডীর স্বপ্নাদেশ পান মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।

সেই স্বপ্নাদেশেই চণ্ডীমঙ্গল রচনার কথা দেবী তাঁকে প্রথম বলেন। সেই স্বপ্নাদেশের কথা মাথায় রেখেই মুকুন্দরাম মেদিনীপুরের আড়রা গ্রামে পৌঁছান, সেখানকার জমিদার বাঁকুড়া রায়ের কাছে আশ্রয়ও পান তিনি। বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথ রায় মুকুন্দরামকে চণ্ডীমঙ্গল রচনার আদেশ দেন। গবেষকদের মতে আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর শেষ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর মধ্যেই এই চণ্ডীমঙ্গল কাব্যটি লিখেছিলেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।

এই কাব্যকে অনেক নামেই চিহ্নিত করেছেন মুকুন্দরাম। তাঁর কাব্যের মধ্যে অভয়ামঙ্গল, অম্বিকামঙ্গল, চণ্ডিকামঙ্গল ইত্যাদি নাম পাওয়া যায়।

সবথেকে বড় কথা মধ্যযুগের সময়ে দাঁড়িয়ে মুকুন্দরাম তাঁর কাব্যে যে গভীর নিপুণতায় চরিত্রগুলিকে অঙ্কন করেছেন তা প্রশংসনীয়। মুরারী শীল, ফুল্লরা, ভাঁড়ু দত্ত, দুর্বলা দাসী প্রভৃতি চরিত্র তাঁর কাব্যে অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাছাড়া এই কাব্যে মুকুন্দরামের কৌতুকরস সৃষ্টির নৈপুণ্যেরও পরিচয় মেলে। কাব্যের ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কারের প্রতি কবি যে একবারেই উদাসীন ছিলেন না, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। অনেক সমালোচক বলে থাকেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মধ্যে আধুনিক উপন্যাসের গুণ লুকিয়ে আছে। আজকের যুগে জন্মালে মুকুন্দরাম হয়তো বা উপন্যাসই লিখে ফেলতেন।

[তোমরা পরবর্তীকালে যদি কখনো নিজেদের ব্যক্তিগত আগ্রহে এই কাব্যটি পড়ো, তাহলে এর অধ্যায় বিভাজন বা কাহিনির গঠন-কাঠামোর দিকে একবার নজর দিলেই বিষয়টি আদ্যোপান্ত স্পষ্ট হয়ে যাবে। সে অনেক পরের কথা। আপাতত যে যে বিষয়গুলি আজকের ক্লাসে আলোচনা করলাম, তা দিয়ে অনায়াসেই তোমরা পরীক্ষা-বৈতরণীটি পেরোতে পারবে। মঙ্গলকাব্যের ক্ষেত্রে আবারো বলছি গল্পটা জানা জরুরি, প্রশ্নেও অনেক ক্ষেত্রে দেয়। ফলে সেই অংশগুলি অবহেলা করা একদমই উচিত হবে না। তাহলে আজকের মত চণ্ডীমঙ্গলের গল্প শুনেই ইতি টানবো, তোমাদের আর বেশি বিরক্ত করবো না। আপাতত ছুটি। পরের ক্লাসে অন্নদামঙ্গল নিয়ে আলোচনা করা যাবে। আপাতত বিদায়।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব – অন্নদামঙ্গল কাব্য

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_9