বাংলা – একাদশ শ্রেণি – ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা (দ্বিতীয় অধ্যায়)
এর আগে ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা- দ্বিতীয় পর্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, এই পর্বে আমরা ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা- তৃতীয় পর্বটি আলোচনা করে নেব।
আমরি বাংলা ভাষা
খুব বেশি দেরি করে ফেলিনি আশা করি। ভারতের ভাষা পরিবার নিয়ে আগে দু দুটো ক্লাস শুনে ফেলেছো, অনেকটা জানা হয়েও গেছে তোমাদের বন্ধুরা। আজকে আরেকটা নতুন ক্লাস নিয়ে চলে এসেছি। বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে সবে আমাদের আগের ক্লাসে। আজকের ক্লাসে বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে নাড়াঘাঁটা করবো আমরা। দেখে নেবো কেমন ছিল আদ্যিকালের বাংলা ভাষার রূপ।
তোমরা তো সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদ পড়েছো, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পড়েছো। তাহলে এই ক্লাসটা বুঝতেও তোমাদের খুব একটা অসুবিধে হবে না। আমরা তো জেনেই গিয়েছি যে চর্যাপদই হল বাংলা ভাষার আদিম নিদর্শন। তাহলে বন্ধুরা এবারে মনে করে দেখো দিকি, চর্যাপদের ক্লাসে কতগুলি পদ বলেছিলাম, সেই পদের ভাষারূপটা ঠিক কেমন ছিল? সেই ভাষার সঙ্গে আজকের ভাষার তো অনেক অনেক অমিল তাই না?
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এসে কিন্তু এই ভাষাটাই আবার অনেকটা বদলে গেল। অনেকটা সরল হল, বোধগম্য হল। চর্যাপদের ভাষার দূর্বোধ্যতা কমে এল। এভাবেই বিবর্তনটা ঘটেছে বাংলা ভাষার। এই বিবর্তনের ধারাক্রমটাই জানবো বন্ধুরা আজকের ক্লাসে। দেখো, সাহিত্যের ইতিহাসের ক্লাসে যেমন গল্পের ছলে পুরো বিষয়টা বুঝে নেওয়া যেতো, ভাষার ক্লাসে কিন্তু ততটা গল্প করা যাবে না। এক্ষেত্রে একেবারে টেকনিক্যালি টপিকটাকে আমাদের বুঝে নিতে হবে।
সেভাবে বুঝলেই খুব সহজে বোঝা হবে। পরীক্ষা বৈতরণীও তো পেরোতে হবে নাকি!
বন্ধুরা ভারতীয় আর্যভাষা ঠিক যেভাবে প্রাচীন, মধ্য ও নব্য ভারতীয় আর্যভাষা এই তিনটি পৃথক স্তরের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও কিন্তু একই ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। বাংলা ভাষার বিবর্তনের যুগবিভাজনটা এইরকম। পাশের ছবিটা খেয়াল করো।
প্রাচীন বাংলা, মধ্য বাংলা এবং আধুনিক বাংলা এই তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে বাংলা ভাষার বিবর্তনের গতিপথকে।
এখন সালের হিসেব করলে প্রাচীন বাংলার সময়কাল ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ, মধ্য বাংলার সময়কাল ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ এবং আধুনিক বাংলা তারপর থেকে আজ অবধি চলে আসছে এবং ক্রমবিবর্তিত হচ্ছে।
মধ্য বাংলার ক্ষেত্রে বন্ধুরা দুটো উপবিভাগ লক্ষ্য করেছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা – ১) আদি-মধ্য বাংলা আর ২) অন্ত্য-মধ্য বাংলা। অর্থাৎ শুরুর দিক আর শেষের দিক। আমরা বাংলা ভাষার এই বিবর্তনের রূপরেখাটা পড়তে গিয়ে চারটি পয়েন্ট মাথায় রাখবো, মানে এই চারটি পয়েন্ট ধরেই আমরা পুরো বিষয়টা আলোচনা করবো।
কী সেই পয়েন্টগুলো দেখে নিই চলো –
• সময়কাল বা ব্যাপ্তি
• ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
• রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
• নিদর্শন
একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
সময়কালের কথা তো আগেই বলে দিয়েছি। ঐ সালগুলো যত কষ্টই হোক, মাথায় রাখতে হবে বন্ধুরা। নাহলে যে পরীক্ষার অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর করতে পারবে না। আমরা প্রথমে জেনে নিই প্রাচীন বাংলা ভাষার সম্পর্কে। এখানে একটা বিষয়ে খটকা লাগতে পারে তোমাদের যে এই ধ্বনিতাত্ত্বিক আর রূপতাত্ত্বিক ব্যাপারটা আবার কি! খুব সহজ করে বলি।
ভাষার উচ্চারণ সংক্রান্ত যা কিছু ব্যাপার তা ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আর ভাষার লেখ্যরূপ বা ভাষার গঠন, ব্যাকরণের রূপ সংক্রান্ত যা কিছু বিষয় তা হল রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে। এটুকু মাথায় রেখেই তোমরা বৈশিষ্ট্যগুলি পড়বে।
প্রাচীন বাংলা ভাষা
সময়কাল
৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ। এক্ষেত্রে একটা কথা তোমাদের সাহিত্যের ইতিহাসের ক্লাসেও বলেছি। ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকারময় যুগ বলা হয়। ফলে অনেকে প্রাচীন বাংলার সময়কাল হিসেবে ৯০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ বলে থাকেন, কিন্তু তা আসলে ঠিক নয়। কারণ মাঝের ঐ দেড়শো বছর সময়পর্বে কোনো সাহিত্যিক নিদর্শনই পাওয়া যায়নি। তুর্কি আক্রমণের পরবর্তী পর্যায়ে তখন বাঙালি সমাজ সংস্কৃতি পুনর্গঠিত হচ্ছে।
নিদর্শন
প্রাচীন বাংলা ভাষার প্রধান নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা
আমরা করেইছি আগে সাহিত্যের ইতিহাসের ক্লাসে। তোমরা নিশ্চয়ই পড়েছো। এছাড়া সর্বানন্দের লেখা অমরকোষের টীকা, সেকশুভোদয়া গ্রন্থের দু-চারটি বাংলা গান, বৌদ্ধকবি ধর্মদাসের বিদগ্ধ মুখমণ্ডল ইত্যাদিকে এই স্তরের বাংলা ভাষার নিদর্শন মানা হয়।
একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
তবে চর্যাপদ ছাড়া আর কোনো নিদর্শনে প্রকৃষ্ট বাংলা ভাষার প্রাচীন স্তরের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় না। তাই চর্যাপদের কথা আগে উল্লেখ করতেই হবে আবশ্যিকভাবে, অন্যগুলি সেভাবে না উল্লেখ করলেও চলে।
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
ক) প্রাচীন বাংলার উচ্চারণে হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরের পার্থক্য ছিল না এবং ‘ণ’ ও
‘ন’–এর মধ্যেও সেই রকম কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। শ, ষ ও স খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করা হত। যেমন – চর্যাপদের ক্ষেত্রেই কোথাও লেখা হচ্ছে ‘শবরী’, কোথাও আবার লেখা হচ্ছে ‘সবরী’।
খ) অন্যদিকে সংস্কৃত ভাষায় যেখানে ‘য’ উচ্চারিত হত ‘ইয়’ হিসেবে, কিন্তু চর্যাপদের ভাষাতে সেই উচ্চারণ ‘জ’ হিসেবে লক্ষ্য করা যায়।
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
ক) প্রচুর অনুসর্গের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন – সম, অন্তরে ইত্যাদি।
খ) বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ এই তিনটি কালেরই প্রয়োগ দেখা যায়। তবে নিত্যবৃত্ত অতীত কালের প্রয়োগ ছিল না।
আদি-মধ্য বাংলা ভাষা
সময়কাল
১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
নিদর্শন
বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’, মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ এবং কয়েকটি মঙ্গলকাব্যকে এই পর্যায়ের নিদর্শন বলে ধরা হয়। কিন্তু এদের মধ্যে ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথির ভাষার উপর ভিত্তি করেই আদি-মধ্য বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
ক) মহাপ্রাণ-নাসিক্য ধ্বনির মহাপ্রাণতা লোপ পায় বা ক্ষীণ হয়ে যায়।
যেমন – কাহ্ন > কান কিংবা আহ্মি > আমি।
খ) অনেকক্ষেত্রেই শব্দের মধ্যে পাশাপাশি দুটি স্বরধ্বনির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
ক) সর্বনামের কর্তৃকারকের বহুবচন পদের ক্ষেত্রে ‘রা’ বিভক্তির ব্যবহার হয়।
যেমন – আহ্মারা, তোহ্মারা ইত্যাদি।
খ) যৌগিক ক্রিয়া গঠনের ক্ষেত্রে অসমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে আছ ধাতু যুক্ত হয়। যেমন – লই + (আ) ছে = লইছে।
অন্ত্য-মধ্য বাংলা ভাষা :
সময়কাল
১৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
নিদর্শন
বৈষ্ণব পদাবলী, চৈতন্য জীবনী কাব্য, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল,
আরাকান রাজসভার কবিদের রচনা ইত্যাদি।
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
ক) আদি অক্ষরে শ্বাসাঘাতের কারণে মধ্যস্বর লোপ পায়। যেমন – গামোছা
গামছা।
খ) অপিনিহিতি ও অভিশ্রুতির বহুল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য : ক) একটিমাত্র ক্রিয়াপদের পরিবর্তে একাধিক ক্রিয়াপদের প্রয়োগ দেখা যায়।
গ) আরবি, ফারসি, তুর্কি, পর্তুগিজ ইত্যাদি বিদেশি শব্দের ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ দেখা যায়।
এই বৈশিষ্ট্যগুলি পড়তে নীরস মনে হলেও পরীক্ষা পাশ করার জন্য এগুলি মুখস্থ করতেই হবে। তবে একটু বুঝে নিলে জলের মত সহজ হয়ে যায়। দেখো একটা জিনিস পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে এই আলোচনা থেকে যে বাংলা ভাষার বিবর্তনের ক্ষেত্রে যত ভাষা এগিয়েছে, সময় এগিয়েছে তত কিন্তু ভাষার মধ্যে বিদেশি শব্দের প্রয়োগ বেড়েছে।
এছাড়া আরেকটি বিষয় দেখার যে, ভাষার জটিলতা যেমন কমেছে, একইসঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যাকরণগতভাবে অনেক পরিশীলিত হয়েছে। মধ্য পর্বের বাংলা ভাষার স্তর পেরিয়ে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা হয় এবং বাংলা ভাষারও আধুনিক স্তরের জন্ম হয়। এই ধারা আজও সমানভাবে অব্যাহত রয়েছে।
একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
সেই চর্যাপদের ভাষার দিকে এখন ফিরে তাকালে সত্যই অবাক হতে হয় যে কত ব্যাপক পরিবর্তিত হয়েছে আমাদের এই প্রাণের বাংলা ভাষা। রবীন্দ্রনাথের একটা কথা দিয়ে আজকের ক্লাস শেষ করবো। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলছেম যে নদী যেমন বাঁক নেয়, তার গতি বদলায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সেই বাঁক আসে আর এই বাঁকটাকেই বলতে হবে আধুনিক। ফলে ভাষা কিংবা সাহিত্যের বিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রতিটি পর্বের সন্ধিক্ষণেই তোমরা লক্ষ্য করে দেখো বন্ধুরা নতুন কিছুর সূত্রপাত ঘটতে দেখা যায়।
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে অন্ত-মধ্য বাংলা শেষ হয়ে আধুনিক বাংলায় প্রবেশ ঘটলো। আর এই বছরই মধ্যযুগের শেষ কবি ভারতচন্দ্রের মৃত্যু হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই ভারতচন্দ্রের মৃত্যু আর চৈতন্যদেবের মৃত্যু দুটি গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল বন্ধুরা। ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই আধুনিক যুগের সাহিত্যের সূচনা হয় বন্ধুরা। তাহলে আজ এতটুকুই থাক। দেখা হবে আবার পরের ক্লাসে।
পর্ব সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XI_Beng_Bhasa_Poribar_3