বাংলা – একাদশ শ্রেনি – নীলধ্বজের প্রতি জনা (প্রথম পর্ব)
নীলধ্বজের প্রতি জনা কবিতাটি মোট তিনটি পর্বে আলোচিত হবে।
আজকের পর্বে থাকছে কবি পরিচিত এবং কাব্য পরিচিতি।
কবি পরিচিতি
পাঠ্যাংশের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতাটির রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
১৮২৪ সালে অধুনা বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন রক্ষণশীল হিন্দু জমিদার আর মাতা জাহ্নবী দেবী ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণা। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে মধুসূদন ১৮৩৩ সালে কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। তিনি হিন্দু কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন, স্বনামধন্য ইংরেজ অধ্যাপক ডিরোজিও’র ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন মধুসূদন, আরেক অধ্যাপক রিচার্ডসনের অনুপ্রেরণায় ইংরেজিতে কবিতা লিখতে শুরু করেন।
ইতিমধ্যে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে হিন্দু কলেজ ছেড়ে বিশপ্স কলেজে ভর্তি হয়ে গ্রিক, লাতিন, হিব্রু ও সংস্কৃত ভাষা শেখেন তিনি। আর এসময়েই মধুসূদন ভার্জিলের ‘ঈনিড’, হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’, মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর মতো বিখ্যাত রচনাগুলি পড়ে ফেলেন এবং কাব্য-প্রতিভার স্ফূরণ তাঁর মধ্যে আরো প্রকট হয়। ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজে গিয়ে ‘spectator’ পত্রিকায় ইংরেজি কবিতা ও নিবন্ধ লিখতে থাকেন মধুসূদন। এছাড়াও ‘Madras Circulator and General Chronicle’ এবং ‘Athenaeum’ ইত্যাদি পত্রিকাতেও নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হতো মধুসূদনের।
এই পর্বে পত্রিকার পাতায় ‘টিমোথি পেনপোয়েম’ ছদ্মনামে অনেক লেখা লিখতেন মধুসূদন। তিনি সেসময় একটি ইংরেজি কাব্যও লিখেছিলেন ‘The Captive Lady’ নামে। বলা যায় এটাই তাঁর লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ। পরে ১৮৬৭ সালের শেষদিকে দেশে ফিরে এসে বাংলা ভাষায় আত্মোৎসর্গ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬০), ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ (১৮৬০), ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০), ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১), ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ (১৮৬০), ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬১) ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২) ইত্যাদির কথা বলতেই হয়।
বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম মধুসূদন পত্রকাব্য বা epistle-এর সূচনা করেন। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’তেই প্রথম তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ করেন যা বাংলা সাহিত্যে এক আমূল পরিবর্তন ঘটায়। তাঁর আগে পর্যন্ত মহাকাব্য লেখা হতো পয়ার ছন্দে অর্থাৎ খানিকটা পাঁচালির মতো। তিনিই প্রথম অমিল পয়ার অর্থাৎ এই অমিত্রাক্ষর ছন্দে মহাকাব্য লিখে সাড়া ফেলে দেন। একে ইংরেজিতে বলা হয় ব্ল্যাঙ্ক ভার্স। মধুসূদনের প্রথম বাংলা ভাষায় সাহিত্যকর্মের দৃষ্টান্ত হল ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি। তৎকালীন উনিশ শতকের সমাজে থিয়েটারে সংস্কৃত নাটকের অক্ষম অনুবাদের মঞ্চায়ন দেখে ব্যথিত মধুসূদন নিজেই নাটক লেখার সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়াও হোমারের ‘ইলিয়াড’-এর একটি কাহিনি অবলম্বনে ‘হেকটর-বধ’ নামে একটি গদ্যও লিখেছিলেন তিনি।
মধুসূদনের লেখায় বারবারই বিভিন্ন ভাষার পুরাণের অনুষঙ্গ উপস্থিত হয়েছে। এতেই শেষ হয় ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে বসে তিনি লিখে ফেলেছিলেন ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ যেখানে বাংলা সনেটের নতুন পথের দিশা দেখান তিনি। তাঁর ‘মায়া কানন’ নাটকটি তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন এই মহান কবির মৃত্যু হয়।
একাদশ শ্রেণি থেকে→ Physics | Chemistry | Biology | Computer
নীলধ্বজের প্রতি জনা কবিতার উৎস
পাঠ্য ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতাটি মধুসূদন দত্তের লেখা ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের অংশ। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘বীরাঙ্গনা’ একটি পত্রকাব্য যার একাদশতম পত্রটি হল পাঠ্যাংশের কবিতা। মূল কাব্যে একাদশ সর্গ হিসেবে এই পত্রকবিতাটি চিহ্নিত হয়েছে।
কাব্য পরিচয়
আঙ্গিকগত দিক থেকে বীরাঙ্গনা কাব্যকে বলা হয়েছে পত্রকাব্য বা Epistle।
প্রথমেই জানতে হবে পত্রকাব্য বিষয়টি কী?
আসলে কাব্যের গঠনে পত্রের ন্যায় কাউকে উদ্দেশ্য করে কোনো চরিত্রের স্বগতোক্তি থাকলে তাকে আঙ্গিকগতভাবে পত্রকাব্য বলে ধরা হয়।
বাংলায় পত্রকবিতার দৃষ্টান্ত থাকলেও পত্রকাব্যের এই রীতির প্রচলন ছিল না। মধুসূদনই প্রথম গ্রিক কবি ওভিদের অনুপ্রেরণায় এই কাব্যখানি রচনা করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব তেতাল্লিশ অব্দে রোমান কবি পাবলিয়াস ওভেদিয়াস নাসোকেই সংক্ষেপে কবি ওভিদ বলে আমরা চিনি। ওভিদের কাব্যটির নাম ছিল ‘দ্য হিরোইডস্’ (The Heroids or Epistle of The Heroines) যেখানে গ্রিক-রোমান পুরাণের থেকে নেওয়া কাহিনীর প্রেক্ষাপটে একুশটি প্রণয়-পত্র রয়েছে। প্রতিটি পত্রের বক্তাই এক একজন নারী। একুশটি পত্রের মধ্যে প্রথম পনেরোটি নিজ নিজ প্রিয়তমের উদ্দেশে তাঁর প্রেয়সীর লেখা পত্র আর পরের ছয়টি পত্র আসলে তিনটি প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের যৌথ পত্র-বিনিময়। পত্রের মধ্যেই গীতিকাব্যের বৈশিষ্ট্য, নাট্যগুণ সবই বিদ্যমান। গ্রিক-রোমান পুরাণের এই নায়িকারা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, আত্মদর্পে বলীয়ান হয়েও তাঁদের পুরুষ-সঙ্গীর প্রতি প্রেম ও প্রণয় জ্ঞাপন করেছে।
নারীর এক অনন্য আখ্যান এই হিরোইডস্ কাব্যটি।
এই কাব্যের অনুসরণে লেখা হলেও মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নায়িকারা তাঁদের স্বামী বা প্রেয়সীর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে তাঁদের ভুল সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে কোথাও, কোথাও আবার শুধুই প্রণয়ের পিপাসা ফুটে উঠেছে। তবে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের ভিত্তিভূমি মূলত উনিশ শতকের নবজাগরণের ফলে নারীচেতনার প্রসার। আজ যে আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে নারী-স্বাধীনতার এক বিপুল আন্দোলন দানা বাঁধছে, মধুসূদনের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ বা অন্যান্য পত্রকাব্যগুলি পড়লে বোঝা যায় কত আগেই তিনি চেয়েছিলেন নারীর মুক্তি। বীরাঙ্গনা কাব্যে ‘হিরোইডস’-এর মতো একুশটি পত্রকাব্য নেই, তার বদলে এগারোটি পত্রকাব্য লিখেছেন মধুসূদন। গ্রিক-রোমান পুরাণের বদলে মধুসূদনের কাব্যের প্রেক্ষাপট হয়ে উঠেছে ভারতীয় পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি। ফলে এই কাব্যে বর্ণিত এগারোজন নারীই ভারতীয় পুরাণের কোনো না কোনো চরিত্র।
দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, সোমের প্রতি তারা, দ্বারকনাথের প্রতি রুক্মিণী, দশরথের প্রতি কেকয়ী, লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখা, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, দূর্যোধনের প্রতি ভানুমতী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা, শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী, পুরুবার প্রতি উর্বশী এবং সবশেষে নীলধ্বজের প্রতি জনা এই এগারোটি পত্রে বিন্যস্ত সমগ্র বীরাঙ্গনা কাব্যটির প্রতিটি পত্রকে একেকটি নাটকীয় স্বগতোক্তি (Monologue) বলা যেতে পারে।
এখানে বলা ভালো এই এগারোটি পত্র ছাড়াও তিনি আরো পাঁচটি পত্র লেখা শুরু করেছিলেন – ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি গান্ধারী, অনিরুদ্ধের প্রতি ঊষা, যযাতির প্রতি শর্মিষ্ঠা, নারায়ণের প্রতি লক্ষ্মী এবং নলের প্রতি দময়ন্তী এই পত্রগুলি অসমাপ্তই থেকে যায়।
একাদশ শ্রেণি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
এই কাব্যটি মধুসূদন বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেছিলেন।
‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে পত্রকাব্যের যে প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যগুলি সেগুলি পূর্ণমাত্রায় রয়েছে যা কিনা আমাদের আলোচ্য ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রটিতেও দেখা যাবে।
নীলধ্বজের প্রতি জনা কবিতার বিস্তারিত আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে↓
এই বৈশিষ্ট্যগুলি কী?
প্রথমত, সাধারণ চিঠির মতো সম্বোধন থাকবে অর্থাৎ কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হচ্ছে তার উল্লেখ
দ্বিতীয়ত, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে কিছু সম্ভাষণ জানানো। সবসময় এই অংশটি মধুসূদনের পত্রকাব্যে দেখা যায় না। বিশেষত নীলধ্বজের প্রতি জনা কাব্যে সম্ভাষণ ছাড়াই মূল কাহিনিতে প্রবেশ করেছেন কবি।
তৃতীয়ত, চিঠি লেখার কারণ যেমন লেখা হয় সাধারণভাবে, তার উল্লেখ
চতুর্থত, কবির নিজের অনুভূতি বা বয়ান
পঞ্চমত, সম্পূর্ণ বিষয়টি দ্বিমুখী (প্রেরক-প্রাপক)।
নীলধ্বজের প্রতি জনা পত্রে এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য কীভাবে ফুটে উঠেছে তা আমরা পরের পর্বে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
প্রথম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → নীলধ্বজের প্রতি জনা কবিতার বিষয়বস্তু
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতিঃ
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।