বাংলা – দ্বাদশ শ্রেণি – মহুয়ার দেশ (সারসংক্ষেপ)
মহুয়ার দেশ কবিতার কবি পরিচিতি
বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা সাহিত্যে নাগরিক চেতনার কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত সমর সেন। মধ্যবিত্ত সমাজের চেতনার ক্লান্তি, নৈরাশ্য আর হতাশা বিপন্নতাবোধের নিপুণ রূপকার ছিলেন কবি সমর সেন। ১৯১৬ সালের ১০ অক্টোবর কলকাতার বাগবাজারে সমর সেনের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম অরুণচন্দ্র সেন এবং মায়ের নাম ছিল চন্দ্রমুখী দেবী। বিখ্যাত সাহিত্যের ইতিহাসকার ও প্রাবন্ধিক দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন তাঁর ঠাকুরদাদা। বাড়িতেই কবির প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। পরে বারো বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পরে সমর সেন কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন।
স্কুলে খুব একটা যেতেন না সমর সেন, তার থেকে শরীরচর্চা, খেলাধুলার প্রতিই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। পারিবারিক সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দিন, গায়ক আব্বাসউদ্দিন কিংবা রাধারমণ মিত্র, বঙ্কিমবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ করেছিলন সমর সেন। ১৯৩২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করে স্কটিশ চার্চ কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়া শুরু করেন তিনি। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানে উত্তীর্ণ হন সমর সেন।
সেই সময় বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে ‘কালিকলম’, ‘কল্লোল’ ইত্যাদি পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে চলেছে, সমর সেন ছিলেন এগুলির নিয়মিত পাঠক। আবার অন্যদিকে ইয়েটস, শেকস্পিয়রের রচনার প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল খুবই গভীর। ১৯৩৩ সালে সমর সেনের প্রথম কবিতা প্রকাশ পায় ‘শ্রীহর্ষ’ পত্রিকায়। তারপর ক্রমে ক্রমে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’, বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ ইত্যাদি পত্রিকাতেও তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে।
প্রাথমিকপর্বে রবীন্দ্রনাথ সমর সেনের কবিতা পড়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে ‘কয়েকটি কবিতা’ নামে সমর সেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ইতিমধ্যে ১৯৪০ সালে স্নাতকোত্তর স্তরে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে নজরকাড়া নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানে উত্তীর্ণ হন সমর সেন। ঐ বছরই প্রকাশ পায় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘গ্রহণ’। সে বছর কাঁথি কলেজে তিনি অধ্যাপনা করতে শুরু করেন। ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নানা কথা’। এরপরে ‘তিনপুরুষ’, ‘খোলা চিঠি’ ইত্যাদি নামে আরও কিছু কবিতার বই প্রকাশ পায়। কিন্তু এর পর থেকে কবিতা লেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তিনি।
১৯৪৬ সালে লেখা ‘জন্মদিনে’ কবিতাটিই তাঁর শেষ লেখা। ইতিমধ্যে অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতা করতে শুরু করেছিলেন সমর সেন। ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’, ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এ চাকরি করে পরে অনুবাদক হিসেবে মস্কোতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। তারপরে ভারতে ফিরে এসে তিনি যোগ দেন ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডস’ পত্রিকায়। এছাড়াও ‘নাউ’ (Now) এবং ‘ফ্রন্টিয়ার’ (Frontier) পত্রিকায় তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৭ সালের ২৩ আগস্ট সমর সেনের মৃত্যু হয়।
মহুয়ার দেশ কবিতার উৎস
সমর সেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কয়েকটি কবিতা’ থেকে পাঠ্য ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতাটি নেওয়া হয়েছে। জানা যায়, ১৯৩৭ সালে মাত্র একুশ বছর বয়সে এই কবিতাটি লিখেছিলেন তিনি।
মহুয়ার দেশ কবিতার সারসংক্ষেপ
সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতাটি নাগরিক জীবনের ক্লান্তি-যন্ত্রণা থেকে শান্তি খুঁজে নেওয়ার আখ্যান। নগরজীবনের যান্ত্রিকতা, প্রাণহীনতা ও ভণ্ডামি সমর সেনের অন্যান্য কবিতাতেও ফুটে উঠেছে বারেবারে আর এই কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। কংক্রিটের জঙ্গলে মোড়া মহানগরের বুকে প্রতি মুহূর্তের আলকাতরা আর পেট্রোলের গন্ধ, কফি-রঙের সন্ধ্যা, জীবনের ক্লান্তি আর অবক্ষয় থেকে কবি কোথাও পালিয়ে যেতে চান। কবির শান্তির স্বর্গ এই মহুয়ার দেশ।
কবিতার শুরুতে কবি সমর সেন নাগরিক জীবনের অবসন্ন ও গ্লানির মর্মান্তিক ছবি এঁকেছেন। শহরেরে আকাশে অস্তগামী অলস সূর্যের আলো রঙিন সোনা গলানো আভায় ছড়িয়ে পড়ে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে এভাবেই।
সেই সন্ধ্যাকে কবি তুলনা করেছেন জলস্রোতের মত।
প্রবহমান সেই সন্ধ্যা কখনই চিরস্থায়ী নয়। সেই সন্ধ্যার জলস্রোতে অস্তগামী সূর্য নানা বিচিত্র রঙের খেলায় মেতে ওঠে। কবিকে আলোড়িত করে প্রকৃতির এই রূপ। কবি ভেসে যান কোনো এক স্বপ্নিল দুনিয়ায় যেখানে নেই নাগরিক ক্লান্তি, যেখানে নেই যান্ত্রিক কলধ্বনি। কবির স্বপ্নের সেই প্রশান্তিময় দেশেও ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘোরা-ফেরা করে। নগরজীবনে কবির রোমান্টিক সত্তা স্বাধীনতা পায় না। নিত্যদিনের গতে বাঁধা জীবনের নাগপাশ ছাড়িয়ে কবি তাই চলে যেতে চান মেঘ-মদির মহুয়ার দেশে যেখানে পথের দুপাশে সারাক্ষণ ছায়া ফেলে দেবদারু গাছেদের দীর্ঘ রহস্য।
দ্বাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
দূরাগত সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস রাত্রের নির্জনতাকে ভেঙে ভেঙে দেয়। প্রকৃতির মধ্যেই কবি সমর সেন প্রাণের আরাম খুঁজে নিতে চেয়েছেন। নাগরিক ক্লান্তি ও অবসন্নতার প্রতিষেধক হিসেবে তাই মহুয়ার দেশই হয়ে ওঠে কবির কাছে স্বপ্নের স্বর্গ। কবি চান তাঁর দেহের উপর, তাঁর ক্লান্তির উপর ঝরে পড়ুক মহুয়া ফুল, মহুয়ার গন্ধে ভরে উঠুক কবির চারপাশ। তাতেই কবি অবসন্নতা থেকে মুক্তি পাবেন।
কিন্তু তবু যেন কবি মুক্তি পান না।
স্বপ্ন-কল্পনার এই মায়াময় জগতের থেকে ধুলোর কলঙ্ক মাখা কঠিন বাস্তব নাগরিক জীবনই কবির কাছে সত্য হয়ে দেখা দেয়, তা থেকে যেন তাঁর নিষ্কৃতি নেই। এভাবেই ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় নাগরিক জীবনের বিবর্ণতা আর হতাশার ছবি তুলে ধরেন সমর সেন আর একইসঙ্গে ফুটে ওঠে তাঁর রোমান্টিক কবিমনের কল্পনাবিলাস ও স্বপ্নময়তার সঙ্গে রূঢ় বাস্তবের সংঘাতের ছবিও।
সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → শিকার কবিতার বিশদে আলোচনা।
লেখক পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XII_Beng_Mohuyar_Desh_1