শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: বিজ্ঞান । অধ্যায় – স্পর্শ ছাড়া ক্রিয়াশীল বল (দ্বিতীয় পর্ব)
এই অধ্যায়ের প্রথম পর্বে আমরা অভিকর্ষজ এবং মহাকর্ষজ বল নিয়ে আলোচনা করেছি, যদি প্রথম পর্ব না পড়া থাকে, সেক্ষেত্রে এই লিঙ্ক থেকে → অভিকর্ষ ও মহাকর্ষ তা পড়ে নেওয়া যেতে পারে।
এই পর্বে আমরা অভিকর্ষ ও মহাকর্ষের প্রভাবে গতি নিয়ে আলোচনা করবো।
অভিকর্ষজ ত্বরণ
একটি বল নিয়ে উপরের দিকে খাড়াভাবে ছুঁড়ে দিলে দেখা যায় যে বস্তুটি একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত উপরে ওঠে। এই ওঠার সময় বস্তুটির বেগ ক্রমশ হ্রাস পায়। এক সময় বস্তুটির বেগ শূন্য হয়ে যায় এবং বস্তুটি নিচের দিকে নামতে শুরু করে। এই সময় বস্তুটির বেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ একটি ত্বরণ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের প্রভাবে এই ত্বরণ সৃষ্টি হয়। সেই কারণে একে অভিকর্ষজ ত্বরণ বলে। একে g অক্ষর দ্বারা নির্দেশ করা হয়।
অভিকর্ষ বলের ক্রিয়ায় অবাধে পতনশীল বস্তুতে যে ত্বরণ সৃষ্টি হয় তাকে অভিকর্ষজ ত্বরণ বলে।
এই প্রসঙ্গে একটা মজার উদাহরণ দেওয়া যায়, ছোটবেলায় তোমাদের মধ্যে অনেকেই মেলায় ঘুরতে গিয়ে মেলায় ঢোকার সাথে সাথেই এটা ওটা কেনার বায়না শুরু করতে, যথারীতি বাবা বা মা কেউই সেই বায়নায় বিশেষ পাত্তা দিতেন না, এরপর মেলার ভেতরে যতই যেতে ততই বুঝতে পারতে শুধুমাত্র ঘোরার জন্যই তোমায় নিয়ে আসা হয়েছে, কেনাকাটির কোনো বালাই নেই। তাই তোমাদের বায়না ধীরে ধীরে কমতে থাকতো এবং একটা সময় অভিমানে, দুঃখে, অপমানে কিছু পাবার বাসনা ত্যাগ করতে (অর্থাৎ বলা চলে তোমার বায়নার বেগ শূন্য হত)।
তারপরে কি শুরু হত?
হ্যাঁ ঠিক বুঝেছ, বাড়ি ফেরার তাড়া। সত্যিতো কিনে যখন কিছুই দেবেনা তখন আর মেলায় থেকে লাভ কি! তার চেয়ে ফেরাই ভালো। ব্যাস যেই ভাবা সেই কাজ। এরপর তোমাদের বাড়ি ফেরার বায়না শুরু হত (অর্থাৎ বলা যায় তোমার মধ্যে বাড়ি ফেরার ত্বরণ সৃষ্টি হত), একসময় বাড়তে বাড়তে চরম সীমায় পৌঁছাত, তখন বাধ্য হয়েই বিরক্তিতে বাবা বা মা তোমায় বাড়ি নিয়ে ফিরতেন।
[প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পড়াশুনার গভীর বিষয়গুলিকে নিজেদের জীবনের হাল্কা অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝে বুঝে পড়লে তোমাদেরই ঐ কঠিন বিষয়গুলিকে দুর্বোধ্য লাগবেনা, তাই এই ধরণের কাল্পনিক গল্পের মোড়কে বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে, এই গুলিকে আবার পরীক্ষার খাতায় লিখে এসোনা কিন্তু।]
পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য প্রভৃতিরা বিন্দু আকারের নয়। এই ক্ষেত্রে বস্তুগুলি গোলাকার বলে ধরে নেওয়া হয় ওই বস্তুর ভর তার জ্যামিতিক কেন্দ্রবিন্দুতে সঞ্চিত আছে। এই কারণে কোন বস্তুকণার উপর পৃথিবীর অভিকর্ষজ বল পরিমাপ করার সময় পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু থেকে ওই বস্তুকণার দূরত্বকে d বলে ধরা হয়।
ধরা যাক পৃথিবীর ভর এবং ব্যাসার্ধ । তাহলে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে ভরের কোন বস্তুকণার উপর পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের পরিমাণ হল:
আবার আমরা জানি, নিউটনের গতিসূত্র অনুসারে বল = ভর × ত্বরণ, অর্থাৎ (যেখানে ত্বরণ )
∴ উপরের সূত্র দুটি থেকে আমরা পাই,
⇒
এই ত্বরণকে আমরা g দিয়ে প্রকাশ করতে পারি।
∴ অভিকর্ষজ ত্বরণ
এই সূত্র থেকে আমরা দেখি যে g এর মান বস্তুর ভর m এর উপর নির্ভরশীল নয়। সুতরাং পৃথিবীতে যেকোন বস্তুর ক্ষেত্রে g এর মান একই থাকবে।
এই অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর মান R এর উপর নির্ভর করবে, কারণ G ও M উভয়ের মান স্থির। পৃথিবীতে SI পদ্ধতিতে g এর মান । CGS পদ্ধতিতে g এর মান ।
দেখা যায় যে একক ভরের বস্তুর অভিকর্ষজ বল ও অভিকর্ষজ ত্বরণের মান একই হয়। চাঁদের ভর ও ব্যাসার্ধ পৃথিবীর থেকে আলাদা। তাই চাঁদের অভিকর্ষজ ত্বরণের মানও আলাদা। চাঁদের অভিকর্ষজ ত্বরণের পরিমাণ পৃথিবীর থেকে অনেক কম।
চাঁদের অভিকর্ষজ ত্বরণের পরিমাণ পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের অংশ। এই কারণে চাঁদে কোন বস্তুর ওজোন পৃথিবীতে ওজনের হবে।
অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান
পতনশীল বস্তু
উঁচু স্থান থেকে কোন বস্তু ফেলে দিলে তা অভিকর্ষের টানে নীচে এসে পড়ে। আবার কোন বস্তুকে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিলে কিছুটা ওঠার পরে বস্তুটির গতি শূন্য হয়ে যায় এবং সেটি অভিকর্ষের টানে নীচে আসতে থাকে। এইভাবে অভিকর্ষের টানে পড়তে থাকা বস্তুকে পতনশীল বস্তু বলা হয়।
ঠিক যেমন খেলার সময় বল যখন আকাশের দিকে ছুঁড়ে দাও, সেটা আবার খানিকবাদে তোমার হাতেই এসে পড়ে। অর্থাৎ ঐ বল এখানে পতনশীল বস্তু।
হাল্কা ও ভারী বস্তুর অবাধে পতন
প্রাচীন গ্রীক পন্ডিতদের ধারণা ছিল যে, একই উচ্চতা থেকে ভারী ও হালকা বস্তু ফেলে দিলে ভারী বস্তু আগে মাটিতে পড়বে, হালকা বস্তু পরে পড়বে। কিন্তু ইটালীর বিজ্ঞানী গ্যালিলিও বলেন যে হালকা বস্তু বায়ু দ্বারা বেশী বাধা পায় বলে দেরিতে পড়ে। বায়ুর বাধা না থাকলে সকল বস্তুই একই সঙ্গে মাটিতে এসে পড়বে।
পতনশীল বস্তু সংক্রান্ত গ্যালিলিওর সূত্র
পতনশীল বস্তু সম্পর্কে গ্যালিলিও কয়েকটি সূত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলি পতনশীল বস্তুর সূত্র নামে পরিচিত।
গ্যালিলিওর সূত্রগুলি হল:
(1) স্থির অবস্থা থেকে অবাধে অবতরণের সময় সব বস্তুই সমান দ্রুততায় নীচে নামে।
(2) স্থির অবস্থা থেকে অবাধে পতনের সময় পতনশীল বস্তুর বেগ সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়।
(3) স্থির অবস্থা থেকে অবাধে পতনের সময় পতনশীল বস্তুর দ্বারা অতিক্রান্ত দূরত্ব সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়।
মুক্তিবেগের ধারণা
কোন বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে যদি একটি বস্তু অনুভূমিক ভাবে নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে বস্তুটি parabolic বা অর্ধবৃত্ত পথে ভূপৃষ্ঠের উপর কিছু দূরে গিয়ে পড়েছে। বস্তুটির নিক্ষেপ বেগ বৃদ্ধি করলে দেখা যাবে যে বস্তুটি অধিক দূরত্ব অতিক্রম করেছে।
এই প্রসঙ্গে বলা যায় বাড়ির ছাদে উঠে পাশের বাড়ির বন্ধুকে কত কি ছুঁড়ে দিয়েছ, মনে আছে তখন তোমার ছোঁড়া চকলেট বা পেয়ারা ঠিক কেমন ভাবে তোমার বন্ধুর ছাদে গিয়ে পড়েছিল ? হ্যাঁ ঠিক কেমন এক অর্ধবৃত্তাকার (যা আসলে অধিবৃত্ত) পথে সেটা পৌঁছেছিল তাইনা! হ্যাঁ এও ঠিক যত জোরে নিক্ষেপ করতে তত দূরে গিয়ে পড়ত।
এই ভাবে নিক্ষেপ বেগ একটি নির্দিষ্ট মানে গিয়ে পোঁছালে দেখা যাবে যে বস্তুটি আর পৃথিবী পৃষ্ঠে ফিরে আসছে না, একটি বৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
পৃথিবী বা কোন গ্রহের পৃষ্ঠ থেকে বস্তুকে নূন্যতম যে বেগে উৎক্ষেপণ করলে বস্তুটি পৃথিবী বা সেই গ্রহের মহাকর্ষীয় আকর্ষণের বাইরে যেতে পারে তাকে সেই গ্রহের মুক্তিবেগ (Escape Velocity) বলে।
[স্কুলে তোমার টিফিন চুরি করে খেয়ে নেওয়া বন্ধুকে এই বেগে ছুঁড়ে দেবে ভাবছ নাকি!]
মুক্তিবেগ বস্তুর ভরের উপর নির্ভরশীল নয়।পৃথিবীর মুক্তিবেগ 11.2 Km/s (প্রায়)।
চাঁদের অভিকর্ষ পৃথিবীর ভাগ। তাই চাঁদের মুক্তিবেগ পৃথিবীর তুলনায় অনেক কম, 2.4 Km/s (প্রায়)।
দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → স্থির তড়িৎ বল ও আধানের ধারণা
লেখিকা পরিচিতি
বিজ্ঞান স্নাতক এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষিতা নন্দিতা বসুর পেশা শিক্ষকতা। তিনি বই পড়তে বড় ভালোবাসেন। কাজের ফাঁকে, অবসরে, বাসে ট্রামে তো বটেই, শোনা যায় তিনি নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও বই পড়তে পারেন।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
VIII-Sc-2b