forasi-biplob-part-1
WB-Class-9

ফরাসি বিপ্লব – প্রথম পর্ব

ইতিহাসনবম শ্রেণি – ফরাসী বিপ্লব (প্রথম পর্ব)

গোড়ার কথা

মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ফরাসি বিপ্লব।

এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো ফরাসি বিপ্লব নিয়ে। তবে সরাসরি ফরাসি বিপ্লবে যাবার আগে আমাদের ইউরোপের আরো কিছু ঘটনা জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

Europe,_1700—1714
১৭০০ শতকে ইউরোপ [সৌজন্যে – Wiki]
১৭০০ শতকে বিশ্বের প্রধান শক্তিশালী দেশগুলি নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারে এবং একে অপরের উপর অধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। মূলত ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে তৎকালীন সময়ে অগ্রগণ্য দেশগুলি ছিল গ্রেট ব্রিটেন এবং ফরাসি সাম্রাজ্য (এছাড়াও পর্তুগাল, স্পেন, অস্ট্রিয়া এবং প্রুসিয়াও বা প্রাশিয়াও শক্তিশালী দেশ হিসাবে নিজেদের মেলে ধরেছিল)। এরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুধুমাত্র নিজেদের দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতো না, এদের অধিগৃহীত দেশ বা দেশের অংশগুলিতেও (কলোনি বা উপনিবেশ) যুদ্ধ লেগেই থাকতো।

তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক এবং দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকতো সম্রাট বা রাজার হাতে। আর বলাই বাহুল্য বংশানুক্রমিকভাবেই সম্রাট সিংহাসনের অধিকারী হতেন। দেশে একটা নিয়ম থাকতো কিন্তু সেই নিয়ম সম্রাটের নিজের ইচ্ছায় বদলে যেত। সমাজের উচ্চ স্তরে থাকা মানুষরা যেমন ধর্মীয় যাজক, সামন্ত্রপ্রভু, মন্ত্রী – আমলা ইত্যাদি মানুষজন বিরাট সুবিধা ভোগ করতেন।

printing press renaissance
ইউরোপের একটি প্রিন্টিং প্রেস [চিত্র সৌজন্যে – UBC]
রেনেসাঁর হাত ধরে গোটা ইউরোপ জুড়ে ধীরে ধীরে ধর্মীয় গোঁড়া বিশ্বাস ও দৈবস্বত্বে বিশ্বাসী রাজতন্ত্রে বিশ্বাসের পট পরিবর্তন হতে শুরু করে, এর ফলে নিম্ন শ্রেণী এবং মূলত শিক্ষিত এবং বণিক শ্রেণির মধ্যে শাসনব্যবস্থার প্রতি অসন্তোষ জন্মাতে শুরু করে।

সম্রাট ষোড়শ লুই

বুরবোঁ রাজবংশের এই সম্রাটের আমলেই ফরাসি বিপ্লব ঘটেছিল। তার রাজত্বকাল ছিল 1774 থেকে 1793 অবধি। ষোড়শ লুইয়ের পূর্বসূরিদের অনেকেই বিলাস – ব্যসনে মগ্ন থাকতেন এবং স্বৈরাচারীভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। বিশেষ করে ষোড়শ লুইয়ের আগের সম্রাট পঞ্চদশ লুই ছিলেন পরিশ্রমবিমুখ এবং বিলাসপ্রিয় মানুষ। তার অদক্ষতায় রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে যায়।

Louis_XVI_et_La_Pérouse
মন্ত্রী ও আমলাদের সাথে পরামর্শরত রাজা ষোড়শ লুই [চিত্র সৌজন্য – Wiki]
এরপর সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের সময়ে দেশে ক্রমাগত খরা, ব্রিটিশদের সঙ্গে ক্রমাগত রক্তাক্ষয়ি যুদ্ধ এবং ফ্রান্সের, আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে ফ্রান্সের কোষাগার দুর্বল হয়ে যায় ও অর্থনীতি প্রবল দুরাবস্থার সম্মুখীন হয়।

ফরাসি বিপ্লবের আগে সামাজিক ব্যবস্থা

1789 খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লব ঘটে। তার আগে, ফরাসি সামাজিক পরিকাঠামো প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল, একে থার্ড এস্টেট বলা হত।

forasi-biplober-samajik-babostha

সম্রাট

সম্রাট ছিলেন সবার উর্ধে। তিনি নিজেকে ঈশ্বরের দুত বলে মনে করতেন।

প্রথম এস্টেট

এই শ্রেণির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাজকেরা। তাদের স্থান ছিল সম্রাটের পরেই। ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে তারা ব্যপক সুযোগ – সুবিধা পেত। গির্জা এবং নানান ধর্মীয় অনুদান থেকে তাদের প্রচুর আয় হলেও তারা প্রায় কোন কর দিত না। এদিকে, তাঁরা কর না দিলেও নানান ধরনের ধর্মকর আদায় করতো। যাজক সম্প্রদায় দুভাগে বিভক্ত ছিল, উচ্চতর যাজক এবং নিম্নতর যাজক। এদের মধ্যে উচ্চতর যাজকেরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন আর নিম্নতর যাজকেরা ছিলেন নিষ্ঠাবান।

দ্বিতীয় এস্টেট

এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ফ্রান্সের অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষেরা। মন্ত্রী – আমলা, উচ্চ পদস্থ কর্মচারী, বিচারক এবং বিত্তশালী মানুষেরা এই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হতেন। প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা মূলত এদের করায়ত্ত ছিল। মজার ব্যপার হল, সমগ্র দেশের জন সংখ্যার মাত্র দেড় শতাংশ হয়েও, এদের কাছে তিন ভাগের এক ভাগ জমির মালিকানা ছিল। বিপুল অর্থের মালিক হয়েও এরা কোন কর দিত না বরং সামন্ত প্রজাদের থেকে কর আদায় করতেন।

তৃতীয় এস্টেট

ফ্রান্সের প্রায় সাতানব্বই শতাংশ মানুষ এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে লেখক, অধ্যাপক, শিল্পপতি থেকে শুরু করে শ্রমিক, ভাগচাষী সব ধরনের মানুষরাই ছিলেন। এদের মধ্যে যারা ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি ছিলেন তাদের বুর্জোয়া বলা হত। সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে এরাই সবথেকে ক্ষুব্ধ ছিলেন, কারণ এদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অভিজাত সম্প্রদায়ের থেকে কোন অংশে কম না হলেও, এরা এদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হতেন। তৃতীয় শ্রেণিকেই সব করের ভার নিতে হত।

third-estate

এই প্রাচীন, সামন্ততান্ত্রিক, মধ্যযুগীয় সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ‘আঁসিয়া রেজিম’ বা ‘পুরাতন ব্যবস্থা ‘নামে পরিচিত ছিল।

ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে অর্থনৈতিক অবস্থা

1784 খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক দুরবস্থা চরমে ওঠে। মূলত ভ্রান্তনীতি, বিলাস বহুল জীবনযাপন ও যুদ্ধজনিত ব্যয়ের বিপুল ঘাটতি পূরণ করার জন্য সরকার বাজার থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এদিকে রাষ্ট্র চরম অর্থ সঙ্কটের মধ্যে থাকলেও ফ্রান্সের সমস্ত রাজস্বের 96 ভাগ দিত দরিদ্র জর্জরিত তৃতীয় শ্রেণির মানুষেরা।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রকর ছাড়াও তাদের নানান প্রত্যক্ষ কর দিতে হত, যেমন ‘টেইল’ (ভূমিকর), ‘ভ্যাতিয়েম’ (আয়কর), ‘টাইথ’ (ধর্মকর), ‘গ্যাবেল’ (লবণকর) ইত্যাদি। মজার ব্যপার হল, ফ্রান্সের ধনী সম্প্রদায়ের কাছে কর দেওয়া নিয়মটি ছিল ঐচ্ছিক; এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা তাদের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কর দেওয়া থেকে বিরত থাকতেন।

forasi-biplob-orthonoitik

ফান্সের এই বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীরা (ইনটেন্ডেন্ট) ভীষণ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। তারা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য চরম অত্যাচারী হয়ে ওঠেন। তাদের এই বর্বর ব্যবহারের জন্য জনসাধারণ তাদের ‘অর্থলোলুপ নেকড়ে’ (Ravening Wolves) নামে ভূষিত করে।

এরপরে ক্রমাগত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হবার ফলে খাদ্যশস্যের দাম অসম্ভব বৃদ্ধি পায়, দ্রব্যমূল্যের দাম মুদ্রাস্ফীতির ফলে আকাশছোঁয়া হয়ে যায়।


[আরো পড়ুন – কলিঙ্গ দেশে ঝড়-বৃষ্টি কবিতার সারাংশ]

ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে রাজনৈতিক অবস্থা

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সেই সময়ে ফরাসী সমাজ তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। রাজা বিশ্বাস করতেন যে তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি তাই তাঁর কোন রকম কাজের বা সিদ্ধান্তের জবাবদিহি করতেন না। এমনকি দেশের শাসন ব্যবস্থাকে অকেজো করে দেবার জন্য 1614 সাল থেকে ফ্রান্সে ‘স্টেট জেনারেলের অধিবেশন’ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

forasi-biplob-rajnoitik-obostha

সেই সময়ে ফ্রান্সের প্রদেশগুলিতে বিভিন্ন প্রাদেশিক সভা বা পার্লামেন্ট থাকতো; এই পার্লামেন্টের সম্মতি ছাড়া রাজার কোন আইন সেই প্রদেশে প্রযোজ্য হত না। বলাই বাহুল্য এই পার্লামেন্টগুলো পরিচালিত হত স্থানীয় অভিজাতদের দ্বারা। ফলে অভিজাতদের স্বার্থক্ষুণ্ণ করতে পারে এমন কোন আইন পার্লামেন্টগুলো তাদের ক্ষমতাবলে বাতিল করে দিতেন। সেই সময়ে ফ্রান্সে মোট প্রাদেশিক আইনসভা ছিল ১৩টি যাদের মধ্যে প্যারিসের আইনসভা ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাশালী।

এই সময়ে ফরাসী জনগণের ব্যাক্তি স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। ‘লেত্‌র দ্য ক্যাশে’ নামক এক পরোয়ানার সাহায্যে যে কোন  ব্যাক্তিকে বিনা বিচারে গ্রেফতার করা যেত। ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গ এই ধরনের নিরপরাধ বন্দীতে পূর্ণ হয়ে ওঠে।

এই সময়ে বিচারব্যবস্থা ছিল প্রহসনে ভরা। প্রথমত ফ্রান্সের আইনবিধি ছিল অত্যন্ত জটিল ও অবৈজ্ঞানিক, আইনগুলি ল্যাটিন ভাষায় রচিত হবার ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তা ছিল দুর্বোধ্য। এর উপরে বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন আইন প্রযোজ্য ছিল। এছাড়া, বিচারব্যবস্থা ছিল দুর্নীতিগ্রস্থ, ঋণে জর্জরিত সরকারের কাছ থেকে অভিজাতরা বিচারকের পদগুলি অর্থের সাহায্যে কিনে নিতেন। ফলে বলাই বাহুল্য, বিচার ব্যবস্থাকে তাঁরা নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতেন।

বিশিষ্ট দার্শনিক ভলতেয়ার, ফ্রান্সের এই রাজনৈতিক সঙ্কটকে ‘রাজনৈতিক কারাগার’ বলে অভিহিত করেছিলেন।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

দার্শনিকদের ভূমিকা

সামাজিক পটপরিবর্তনে চিন্তাবিদদের সর্বদাই একটা শক্তিশালী ভুমিকা থাকে, ফরাসী বিপ্লবও এই নিয়মের অন্যথা ছিল না।

অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকেই ফ্রান্সে দার্শনিক ও লেখকরা সচেষ্ট হয়ে ওঠেন, এরা মূলত ভ্রান্ত সমাজনীতি, ধর্মীয় গোঁড়ামি, দৈব রাজতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আঘাত করেন। এদের মধ্যে কয়েকজন হলেন মন্তেস্কু, রুশো এবং ভলতেয়ার। [বিস্তারিত পড়ুন – ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা]

শুনুন ফরাসী বিপ্লব প্রথম পর্বের পাঠ ?

প্রথম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব  – বাস্তিল দুর্গের পতন


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX-Hist-1a