himalya-darshan-begam-rokeya
WB-Class-9

হিমালয় দর্শন – বেগম রোকেয়া

বাংলানবম শ্রেণি – হিমালয় দর্শন (গদ্য)

লেখিকা পরিচিতি

বেগম রোকেয়া বাংলার একজন অগ্রগণ্য নারী সংস্কারক। ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত BBC দ্বারা পরিচালিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির বিচারে তিনি ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন।

১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে বেগম রোকেয়া অধুনা বাংলাদেশের রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা গৃহেই সম্পন্ন হয়। কিন্তু তাঁর জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম। প্রধানত বড়দাদার উৎসাহে তিনি বাংলা ও ইংরাজি শেখেন। এরপর মাত্র ষোল বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে তাঁর বিবাহ হয়। রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন আধুনিক মনস্ক মানুষ। মূলত তাঁর উৎসাহেই রোকেয়ার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়।

বেগম রোকেয়া
বেগম রোকেয়া [চিত্র সৌজন্য – thedailynewnation.com]
পাঠক মনে রাখবেন, তৎকালীন সময়ে মহিলাদের সাহিত্যচর্চা ছিল বিরলতম ঘটনা। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি মহিলাদের জন্য ভাগলপুরে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তী সময়ে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল নামে এটি এখনো পরিচালিত হয়।

বেগম রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল পদ্মরাগ, মতিচুর, Sultana’s Dream। তার উপন্যাস ও রচনাগুলিতে তিনি নারীশিক্ষা ও লিংগ সমতার উপরে বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন।

তাঁর স্মৃতির উদ্দ্যেশ্যে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ রাখা হয়।     

উৎস

বর্তমানে আলোচ্য ‘হিমালয় দর্শন’ শীর্ষকটি ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে ‘মহিলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কূপমণ্ডূকের হিমালয় দর্শন’ রচনার সংক্ষিপ্ত রূপ।

সারসংক্ষেপ

এই রচনাংশটিকে আমরা আমাদের সুবিধার জন্য তিনটি ভাগে বিভক্ত করে নেব।

প্রথম ভাগ – হিমালয়ের বর্ণনা

রচনাংশের প্রথমে আমরা জানতে পারি যে লেখিকা দার্জিলিং চলেছেন।

এই গদ্যটি যখন লেখা হয়েছে তখন ভারতীয় রেল এতটা উন্নত ছিল না এবং ভারতের বিভিন্ন অংশের রেলপথ আলাদা আলাদা কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত হত। তৎকালীন সময়ে হুগলী নদীর পূর্ব দিকের বিস্তীর্ণ অংশ (অধুনা বাংলাদেশ, আসাম, উত্তরপূর্বের রাজ্য ইত্যাদি) পরিচালিত হত ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে দ্বারা এবং হুগলী নদীর পশ্চিম অংশ (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি) পরিচালিত হত ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে দ্বারা।

বলাই বাহুল্য এরা আলাদা আলাদা ধরণের রেল চালাতো; লেখিকা বলেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তুলনায় ইস্টার্ন বেঙ্গলের রেলগাড়িগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট হত। এছাড়া শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং অবধি যে রেলপথ ছিল, তা পরিচালিত হত হিমালয়ান রেলওয়ে দ্বারা।  প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে অন্য দুই রেল কোম্পানি বর্তমানে অবলুপ্ত হলেও, এই হিমালয়ান রেলওয়ের (ভারতীয় রেলওয়ের একটি বিভাগ) অস্তিত্ব আছে এবং বর্তমানে এটি UNESCO World Heritage তালিকার অন্তর্গত।

১৯৩০ সালে দার্জিলিং রেল [Image by © Hulton-Deutsch Collection/CORBIS]
লেখিকা এই হিমালয়ান রেলওয়ের টয়ট্রেনে চড়ে পাহাড়ে উঠছেন। পাহাড়ের আঁকিবুঁকি রাস্তা চিরে, মেঘের মধ্য দিয়ে ‘কটাটটা’ শব্দ করতে করতে রেলগাড়ি এগিয়ে চলেছে। পথের দুই ধারের মনোরম দৃশ্য লেখিকার মন ছুঁয়ে যাচ্ছে, পাহাড়ের চুড়ো, নীচে নেমে যাওয়া উপত্যকার পাশাপাশি চারিপাশের লতা, ঘাস পাতা ইত্যাদিও লেখিকার মনোরম লাগছে।

এদের মধ্যে লেখিকার বিশেষভাবে মনোগ্রাহী হয়েছে পাহাড়ি ঝর্না বা জলপ্রপাত। তার নিজের ভাষায় জলপ্রপাতের ‘সৌন্দর্য বর্ণনাতীত’। যান্ত্রিক কারণে রেলগাড়িটি একটি বড় ঝর্ণার সামনে দাঁড়ালে লেখিকার প্রাণভরে ঝর্নার সৌন্দর্য পান করার সৌভাগ্য হয়।

ধীরে ধীরে রেল তার গন্তব্য ‘কারসিয়ং’ পৌছায়।

এখানে লেখিকার পরিবারের সঙ্গে একটি মজার ঘটনা ঘটে, তাদের জিনিসপত্র ভুলবশত কারসিয়ং-এর পরিবর্তে ভুল করে দার্জিলিং পৌঁছে যায়। যদিও সেইসকল জিনিসপত্র সন্ধ্যার ট্রেনে আবার ফিরে আসে, তবুও কিছু সময়ের জন্য লেখিকার পরিবার ‘গৃহসুখ’ থেকে বঞ্চিত হন। লেখিকা যে সময় হিমালয় দর্শনে গেছেন, সেইসময় আবহাওয়া বড়ই মনোরম এবং পাহাড়ের আবহাওয়াও নির্মল। লেখিকা এই সময়টিকে ‘পার্বত্য বসন্তকাল’ বলে উল্লেখ করেছেন, কারণ এই সময়ে শীতের আধিক্য যেমন নেই তেমনই গ্রীষ্মের জুলুমও অনুপস্থিত।  

যাদের পাহাড়ে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে তারা লেখিকার মনের উপলব্ধি সহজেই বুঝতে পারবে। যেকোনো পাহাড়ি অঞ্চলেই চলমান মেঘেদের ভ্রমণ দেখা একটি অসাধারণ অনুভুতি; এবার সেই মেঘেদের ভ্রমণের সাথে সাথে যদি আকাশে সূর্যাস্তের রং (যাকে লেখিকা তরল স্বর্ণের সাথে তুলনা করেছেন) যোগ হয়, তাহলে তার সৌন্দর্য বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই লেখিকা বলেছেন যে, প্রতিদিন সূর্যাস্ত ও মেঘেদের শোভা দেখতে দেখতে তাঁর অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

পাহাড়ে যেন সবকিছুই সুন্দর! সামান্য ঢেঁকিতরু; যা কিনা লেখিকা একপ্রকার ক্ষুদ্র গুল্ম বলে ভাবতেন, সেই সামান্য গুল্মকে যখন ২০/২৫ ফিট উচ্চ তরুবর হিসাবে তিনি দেখেন, তখন তাঁর মন বিস্ময়ে ভরে যায়।

দ্বিতীয় ভাগ – নারী স্বাবলম্বিতা

লেখিকাদের ভুটিয়া চাকরানীর নাম ‘ভালু’। ভালু কিন্তু সাধারণ একজন ভুটিয়া মহিলা; কিন্তু এক সাধারণ পাহাড়ি মহিলা যখন রক্তখেকো জোঁককে বিন্দুমাত্র ভয় না পায়, আবার সংকীর্ণ, অসমান পথে (আবুড়াখাবুড়া) বোঝা নিয়ে অবলীলাক্রমে উঠে যায়, তখন তার সাহস দেখে লেখিকা রোমাঞ্চিত হন।

একজন ভুটানি মহিলা
একজন ভুটানি মহিলা

শুধু তাই নয়, পাহাড়ে মহিলারা শুধু যে সাহসী তা কিন্তু নয়, তারা রাস্তা তৈরি করার মতো পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজেও পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। মহিলা জাতিকে যারা দুর্বল – অবলা বলে মনে করেন; লেখিকা সেই সকল মানুষের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে চান যে, এই পরিশ্রমী মহিলাদেরও কি তারা দুর্বল মনে করেন?

আবার ভুটিয়ানী যারা নিজেদের ‘পাহাড়নি’ বলে পরিচয় দেন, তারা যে শুধু পরিশ্রমী তা নয়, এরা সত্যবাদীও বটে। তবে এই ভুটিয়ানীদের মতে আজ কাল ‘নীচেকা আদমির’ অর্থাৎ সমতল থেকে আসা মানুষদের সঙ্গদোষে তাদের সত্য কথা বলার সদগুণ হারিয়ে যাচ্ছে।

তৃতীয় ভাগ – সৌন্দর্যের দর্শন

লেখিকা পাহাড়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। এর আগে তাঁর সাগর প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হলেও, পাহাড় তিনি জীবনে প্রথমবার দেখেছেন এবং যতই দেখছেন, ততই তাঁর সৃষ্টি কর্তার প্রতি ভক্তি বেড়ে চলেছে। লেখিকা যেন এক পিপাসিত মানুষ, যার দর্শন পিপাসা ক্রমবর্ধমান। তাঁর আফসোস হয় এই ভেবে যে তাঁর দুটি মাত্র চোখ এবং দেখার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ অথচ দ্রষ্টব্যের সংখ্যা কি বিপুল!

লেখিকা পাহাড়ের দিকে তাকালে, ঝর্না বলে আমাকে দেখ, ঝর্নার দিকে তাকালে পাহাড়চুড়ো আবার বলে আমায় দেখ। দ্রষ্টব্যের সৌন্দর্যে আবেশিত লেখিকার হঠাৎ স্রষ্টার কথা মনে হয়। যে ‘মহাশিল্পী’ এমন চমৎকার চিত্র অঙ্কন করতে পারেন, তাঁর নৈপুণ্য কল্পনাতীত। তিনি ভাবেন যে আমাদের চোখে হিমালয় কি বিপুল কিন্তু যিনি এই বিশাল মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন তাঁর কাছে হিমালয় একটি বালুকণার থেকেও ক্ষুদ্র।


[আরো পড়ুন – নোঙর কবিতার সারাংশ]

মন্ত্র অথবা প্রার্থনার ব্যবহার প্রায় সকল প্রকার সংস্কারে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সেই প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা যখন সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করি, তা অধিকাংশ সময়েই আবেগহীন হয়। লেখিকা বলেছেন যার সৃষ্টি এত সুন্দর তাকে উপাসনা করার সময়ে ‘মন, মস্তিষ্ক, প্রাণ সব কিছু’ নিয়ে উপাসনা করলে তবেই প্রাণ তৃপ্ত হয়। তাই প্রকৃতির কাছে এলে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করলে, মন আপনা থেকেই ঈশ্বরের জয়ধ্বনি করে ওঠে, আলদা করে ঈশ্বরের প্রার্থনার প্রয়োজন হয় না।

দেখে নাও হিমালয় দর্শন গদ্যের বিস্তারিত আলোচনা↓


মূল বক্তব্য

আপাত দৃষ্টিতে ‘হিমালয় দর্শন’ গদ্যাংশটিকে একটি নিছক ভ্রমণ বৃত্তান্ত বলে মনে হলেও, এটি একটি গতানুগতিক ভ্রমণকাহিনী হিসাবে সীমাবদ্ধ নয়। এই গদ্যাংশে লেখিকা বেগম রোকেয়া স্বয়ং হলেন প্রধান চরিত্র; তাই গদ্যাংশটিকে ভালোভাবে বুঝতে গেলে লেখিকার চরিত্রের কয়েকটি দিক আমাদের ফিরে দেখতে হবে। ‘লেখিকা পরিচিতি’ অংশে আমরা জেনেছি যে বেগম রোকেয়া ছিলেন বাংলার একজন অগ্রগণ্য নারী সংস্কারক এবং তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত জ্ঞানপিপাসু। তাঁর জ্ঞান আহরণের আকাঙ্ক্ষা ছিল অন্যান্যদের তুলনায় অনেকটাই বেশি।

তাঁর এই দুই সত্ত্বার সংমিশ্রণ আমরা ‘হিমালয় দর্শন’ শীর্ষকটির মধ্যে খুঁজে পাই।

প্রথম অংশে যেখানে তিনি হিমালয়ের রাস্তা ও অতুলনীয় পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন তার মধ্যে আমরা লেখিকার জ্ঞান আহরণের তীব্র আকাঙ্খার চিত্র খুঁজে পাই।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

একজন তৃষ্ণার্ত পথিকের যেমন এক কাপ জলে তৃষ্ণা নিবারণ হয় না, ঠিক তেমনভাবে একজন প্রকৃত জ্ঞানপিপাসু মানুষের জ্ঞানের তৃষ্ণা সহজে মেটে না। জ্ঞানের ভাণ্ডার যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, জ্ঞান প্রাপ্তির ইচ্ছা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। হিমালয়ের বর্ণনাতীত সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে লেখিকা আকণ্ঠ সৌন্দর্য পান করেছেন। এই প্রকৃতির মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর ঈশ্বর উপলব্ধি।


তাঁর দ্বিতীয় স্বত্তা হল নারীর সমানাধিকার।

সাধারণ একটি ভুটিয়া মহিলার মধ্যে লেখিকা খুঁজে পান একজন পরিশ্রমী ও সত্যবাদী নারীকে। নারী জাতিকে যারা দুর্বল মনে করেন, তাদের সামনে লেখিকা এই মহিলাদের উদাহরণ পেশ করতে চান। এই মহিলারা পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। কোনো অংশেই মহিলারা পুরুষদের থেকে কম জান না। তাহলে সমাজ মহিলাদের কেন অবলা মনে করবে?

সর্বপরি, বেগম রোকেয়া রচিত গদ্যাংশটি একটি সৌন্দর্য মণ্ডিত, সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত ভ্রমণকাহিনী যার মধ্যে লুকিয়ে আছে লেখিকার আধ্যাত্মিক উপলব্ধি।

সমাপ্ত। আরো পড়ো → খেয়া কবিতার সারাংশ


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX-Ben-Himalaya-darshan