shilpobiplober-suchona
WB-Class-9

শিল্পবিপ্লবের সূচনা ও বিস্তার | শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ

ইতিহাসনবম শ্রেণি – শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ (প্রথম পর্ব)

শিল্প এবং বিপ্লব এই পরিচিত দুটি শব্দ সংযুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছে, শিল্পবিপ্লব।

সর্বপ্রথম ফরাসী দার্শনিক আগুস্ট ব্লকি (Auguste Blanqui) এই শব্দটি ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্যবহার করেন। আমরা জানি যে কাঁচামাল এবং প্রাথমিক দ্রব্যকে নির্দিষ্ট প্রণালীর মাধ্যমে দ্রব্যে পরিণত করাকে শিল্প বলা হয়। আবার কোন ব্যবস্থায় যদি ব্যাপক পরিবর্তন হয় তখন তাকে বিপ্লব বলে।

অষ্টাদশ শতকে মূলত ইউরোপ জুড়ে শিল্প পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে; যার ফলে বদলে যায় পৃথিবীর ইতিহাস। এই অধ্যায়ের বেশ কয়েকটি পর্বে আমরা শিল্পবিপ্লব এবং বিশ্বে তার প্রভাব সম্পর্কে বুঝে নেবার চেষ্টা করবো।


শিল্পবিপ্লবের সূচনা পর্বটি ভালোভাবে বুঝে নাও এই ভিডিও থেকে↓


শিল্পবিপ্লবের পূর্ববর্তী অবস্থা

শিল্পবিপ্লব শুরু হবার আগে মানুষ মূলত কৃষিকাজ নির্ভর ছিল। কৃষি ছাড়া, অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য মূলত হাতে কাজ করে প্রস্তুত করা হত, যেমন বাসন, জামাকাপড় ইত্যাদি। যেহেতু দ্রব্যগুলি হাতে তৈরি করা হত, তাই তা অধিক সংখ্যায় উৎপন্ন করা ছিল সময় এবং ব্যয় সাপেক্ষ। শুধু তাই নয়, শিল্পকর্ম কোন স্থায়ী কর্মসংস্থান ছিলনা। মূলত কৃষি কাজের ফাঁকে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে শিল্পকর্ম চলতো।

দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মূলত চালিত হত কর থেকে প্রাপ্ত অর্থের দ্বারা। সুতরাং দেশের আয় ছিল সীমিত।

স্বাভাবিক ভাবে দেশের কৃষিজমি এবং তাতে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল সীমিত। ধীরে ধীরে দেশগুলির জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে, দেশের অভ্যন্তরে খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকে। অন্যদিকে কর্মসংকোচন ঘটে। এই অবস্থা থেকে শুরু হয় শিল্পবিপ্লবের সূত্রপাত।

subscribe-jump-magazine-india

শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার

শিল্প বিপ্লবের আগে সব কাজ হাতে করা হত। ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে নতুন নতুন যন্ত্র এবং প্রযুক্তির উদ্ভব হয়; এর ফলে শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়া বহুলাংশে সহজ হয়ে যায়।

কয়েকটি যন্ত্র, যেগুলি শিল্পবিপ্লবের গতি ত্বরান্বিত করেছিল।

উড়ন্ত মাকু (flying shuttle) 

জন কে ১৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন। উড়ন্ত মাকু বস্ত্র শিল্পে ব্যাপক গতি আনে।

স্পিনিং জেনি (Spinning jenny)

জেমস হারগ্রিভস ১৭৬৫ সালে স্পনিং জেনি আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে সেই সময়ে একত্রে আট জন মানুষ কাপড় বোনার কাজ করতে পারত; এই যন্ত্রের সাহায্যেই বস্ত্র কারখানাগুলি গড়ে উঠতে শুরু করে।

ওয়াটার ফ্রেম (Water Frame)

স্যর রিচার্ড অর্করাইট ১৭৬৫ সালে ওয়াটার ফ্রেম তৈরি করেন। এই যন্ত্র জলের স্রোতের সাহায্য নিয়ে কাপড় বুনতে সক্ষম ছিল।

স্পিনিং মিউল (spinning mule)

স্যমুয়েল ক্রম্পটন ১৭৭৯ সালে স্পিনিং মিউল উদ্ভাবন করেন। এটিও কাপড় বোনার একটি যন্ত্র ছিল। তৎকালীন সময়ে এটি ব্যাপক ভাবে ব্যবহার হতে শুরু করে।

ষ্টিম ইঞ্জিন (Steam engine)

শিল্প বিল্পবের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল স্যর জেমস ওয়াট আবিষ্কৃত ষ্টিম ইঞ্জিন। তাপ শক্তি ব্যবহার করে জলীয় বাষ্প তৈরি করা হত এবং বাষ্পচাপ ব্যবহার করে ইঞ্জিন চলতো। এই যন্ত্র এক নতুন যুগের সূচনা করে। কারখানার মেশিন, জলের পাম্প, রেলগাড়িতে এই ইঞ্জিন ব্যবহার হতে শুরু করে।

ডেভি ল্যাম্প বা নিরাপত্তা বাতি 

১৮১৫ সালে হামফ্রে ডেভি নিরাপত্তা বাতি আবিষ্কার করেন। এই বাতি খনি থেকে কয়লা উৎপাদন প্রক্রিয়া সহজ করে। কয়লা খনিতে অতি দাহ্য মিথেন গ্যাস থাকে। তাই খনির মিথেন আগুনের সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা তৈরি হয়। হামফ্রে ডেভির নিরাপত্তা বাতির সাহায্যে খনির মধ্যে নিরাপদ ভাবে আলো নিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব হয়।

এই আবিষ্কারগুলি ছাড়াও সেলাইকল (বা সেলাইমেশিন), টাইপরাইটার ইত্যাদিও এই সময়ে আবিষ্কার হয়। প্রসঙ্গত এই আবিষ্কারগুলির অধিকাংশই ইংল্যান্ডে আবিষ্কার হয়। ফলে ইউরোপের অন্য সকল দেশগুলির মধ্যে ইংল্যান্ড অনেকটাই এগিয়ে যায়।

ইংল্যান্ড ও শিল্পবিপ্লব

শিল্পবিপ্লব প্রথমে ইংল্যান্ডে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা ইউরোপের অন্য অংশগুলিতে যথা ফ্রান্স, হল্যান্ড (বা নেদারল্যান্ড), বেলজিয়াম, জার্মানি, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডে যেসময় শিল্পবিপ্লব শুরু হয়, ইউরোপের অন্যদেশগুলিতে তার থেকে আরো তিরিশ – চল্লিশ বছর পরে শিল্পবিল্পব শুরু হয়।

একদম প্রথমে শুরু করার কারণে ইংল্যান্ডকে বাজারের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়নি আবার বিরাট ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য থাকার কারণে তাদের কাঁচামালের যোগান এবং শিল্পসামগ্রী বিক্রির বাজার দুটোই সুলভ হয়।

কলকারখানায় কাজ চলছে।

একথা বলাই বাহুল্য যে ব্যাপক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির কারণেই ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলি ইংল্যান্ড থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশে শিল্পোন্নয়ন ঘটাতেন। এই কারণে ইংল্যান্ডকে ‘ইউরোপের শিক্ষক’ বলা হত।

আচ্ছা, ইংল্যন্ডের বৈজ্ঞানিকরা কি ইউরোপের অন্যান্য দেশে বৈজ্ঞানিকদের থেকে বেশি উন্নত ছিলেন?

না, তা একেবারেই নয়। ইংল্যান্ডের এই চোখধাঁধানো উন্নতির কিছু সুস্পষ্ট কারণ ছিল। ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের পিছনে ছিল তাদের দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি। তারা মূলত চারটি ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে শিল্পবিপ্লবের জমি প্রস্তুত করেছিল।

  • জনসংখ্যা বৃদ্ধি
  • কৃষি বিপ্লব
  • বাণিজ্যিক বিপ্লব
  • পরিবহণ বিপ্লব

ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের অভ্যন্তরীণ কারণ

ইংল্যান্ডের সমাজ ছিল প্রগতিশীল। এই সমাজে শ্রেণিবৈষম্য অপেক্ষাকৃত কম ছিল। ব্রিটিশ জমিদাররা (feudal lords) শুধুমাত্র কৃষিকাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তারা শিল্পে বিনিয়োগের কাজে এগিয়ে এসেছিলেন।

ইংল্যান্ডের সরকার শিল্পপতি এবং বনিকমহলকে শিল্পের প্রসারের জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন।

ইংল্যান্ডে জলপথের প্রাচুর্য থাকার কারণে জলপথের সাহায্যে একস্থান থেকে অন্যস্থানে কাঁচামাল, কয়লা প্রভৃতি বহন করা সহজ হয়েছিল।


[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]

ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের বাহ্যিক কারণ

শিল্পবিপ্লবের জন্য তিনটি প্রধান উপাদান হল – কাঁচামাল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন বাজার এবং মূলধন। ইংল্যান্ডের তিনটি উপাদানেরই প্রাচুর্য ছিল।

উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশে উপনিবেশ থাকার কারণে তারা কাঁচামাল সহজেই সংগ্রহ করতো এবং নিজেদের দেশের বাজার ছাড়াও ঐ সকল উপনিবেশের বাজারে নিজেদের পণ্য বিক্রয় করতো এবং অর্জিত মূলধন, পুনরায় বিনিয়োগ করতো।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সামন্ততন্ত্র ধ্বংসের ফলে প্রচুর সুলভ শ্রমিক সৃষ্টি হয়। তারা কলকারখায় কাজ করে বিপ্লবের গতি ত্বরান্বিত করে।


[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌত বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবন বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]

শিল্পায়ন এবং ইউরোপ

শিল্প উন্নতির ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড ভিন্ন অন্য দেশগুলির ক্ষেত্রে শিল্পোন্নয়নের গতি সমান ছিল না। অধিকাংশ দেশে তখনও সামন্ততন্ত্র প্রচলিত ছিল এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক মানসিকতার দিক দিয়ে তারা অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে প্রায় একই সময় শিল্পবিপ্লব শুরু হলেও ফ্রান্সের গতি ছিল মন্থর। ১৮৭১ সালে জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হবার পর সেখানে শিল্পবিপ্লব শুরু হয় এবং ১৮৬০ সালে রাশিয়ায় শিল্পবিপ্লবের সূত্রপাত হয়।

প্রথম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –