আজ সকাল থেকেই রিন্টুর মনটা খুশিতে ভরপুর।
অনেকদিন পরে তার দিদি ঝন্টু বাড়ি ফিরছে। ঝন্টু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বটানি নিয়ে গবেষণা করছে। সাত সকালেই মা স্টেশনে গেছে দিদিকে আনতে। পড়ার বই মুখে করে বসে রিন্টু ভেবে চলেছে ঝন্টুর অদ্ভুত কান্ড কারখানার কথা।
সেবার পেলিং বেড়াতে গিয়ে, সবাই যখন মশগুল বরফের ওপর সূর্যোদয়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে, ঝন্টু তখন ব্যাগ বোঝাই করছে যত রাজ্যের আগাছায়। আর সে কথা বলতে গেলেই গম্ভীর গলায় বলে, এগুলো খুব Important এবং Rare তাই এগুলো পেলেই সংগ্রহ করা উচিত। হঠাৎ রিন্টুর চিন্তায় ছেদ পড়ল কলিং বেলের শব্দে। ‘নিশ্চয়ই ঝন্টুদি এসে গেছে’ ছুট্টে গিয়ে দরজা খোলে রিন্টু। খুলেই মেজাজটা খিঁচড়ে যায়। ঝন্টু নয়, গোয়ালা এসেছে দুধ দিতে।
যাই হোক, দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে এসে বাটিতে দুধটা ঢালতেই আবার মাথাটা গরম হয়ে যায়। দুধের মধ্যে খড়ের টুকরো কেন?
এ রকম আনহাইজিনিক দুধ খাওয়াটা কি উচিত?
রাগের মাথায় সব দুধটাই দিল ফেলে।
এমন সময় আবার কলিং বেল। মা এসে গেছে ঝন্টুকে নিয়ে। দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করে রিন্টু। মা তো দেখেই রেগে আগুন- ‘এরকম একটু আধটু খড়ের টুকরো সব সময়েই থাকে দুধে। তাতে ফেলে দেবার কি হয়েছে? ছোট থেকেই দেখে আসছি গোয়ালা বালতির দুধ চাপা দেয় খড় দিয়ে’।
শুনে রিন্টুর বেশ খটকা লাগল-গোয়ালারা জেনেশুনে ইচ্ছে করেই খড় দেয়? সেটা কেন? কারুর কাছ থেকেই সদুত্তর না পেয়ে অবশেষে ঝন্টুকে জিজ্ঞেস করে।
ঝন্টু তার মনের অন্ধকার দূর করে – খড়ে থাকে এক ধরনের উপকারী ব্যাকটিরিয়া যারা অন্য ব্যাকটিরিয়াকে দুধে আক্রমণ করতে দেয় না। ফলে দুধ নষ্ট হয় না। তাই দুধে খড় চাপা দেওয়া। এটা কিন্তু মোটেই আইনহাইজিনিক নয়, বরং উল্টোটা, আর তাছাড়া খড় দুধের তাপমাত্রাকে কমিয়ে রেখে ভ্যাপসানি গরমেও নষ্ট হতে দেয় না।
এরপর সারা ছুটিতে ঝন্টু রিন্টু আমাদের রোজকার দেখা, অনেকদিন ধরে শোনা কত টুকিটাকি বিষয় নিয়ে যে আলোচনা করে তার ইয়ত্তা নেই। আমরা পাঠকরাও তাহলে একটু অংশ নিই রিন্টু ঝন্টুর গল্পেঃ-
আজকাল দূষণ পৃথিবীর একটা বড় সমস্যা।
চারদিকে বিভিন্ন কনফারেন্স হচ্ছে, মানুষকে দূষণের কুফল সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা হচ্ছে, বিভিন্ন দূষণ মাপক যন্ত্র বেরোচ্ছে। এ রকম দূষণ মাপক যন্ত্র আমাদের প্রকৃতির মধ্যেও রয়েছে। একটু চোখ মেলে বাড়ির সামনের বাগানটাতে তাকালেই দেখতে পাবো লেবু গাছটার গায়ে অনেক জায়গায় ছোট ছোট সাদা খু-উ-উ-ব পাতলা তুলোর টুকরো যেন সেঁটে দেওয়া আছে।
অনেক চেষ্টা করেও একে তুলতে পারব না। এরা লাইকেন, Crustose লাইকেন। দূষণের মাত্রা যে সব জায়গায় কম সেখানে অহরহই দেখা যায় এই লাইকেন।
কিন্তু দূষণের মাত্রা যখনই বেড়ে যাবে তখনই দেখা যাবে না এই লাইকেনদের।
আমাদের চিরপরিচিত কচুরীপানাও জলের আর্সেনিক শোষণ করে নিয়ে দূষণ কমায়। আবার কিছু গাছ আছে যাদের দূষণ সহ্য করার ক্ষমতা খুব বেশি, দূষণযুক্ত অঞলেই বেশি জন্মায়। যার জন্য এদের ‘বায়োইনডিকেটর’ রূপে ব্যবহার করা হয়। এরা দূষণের মাত্রা নির্দেশ করে। যেমন – Chlamydomonas, Scenedesmus, Chlorella, Euglena প্রভৃতিরা দূষিত জলেও খুব ভালই বেড়ে ওঠে।
তাই বিভিন্ন ‘Sewage treatment plant’- এ এদের ব্যবহার করা হয়। এরা প্রচুর পরিমাণে O2 তৈরী করে যার সাহায্যে নর্দমা নিষ্কাশিত নোংরা পদার্থ খুব তাড়াতাড়ি ব্যাকটিরিয়া দ্বারা বিয়োজিত হয়ে জলকে রাখে দূষণমুক্ত। কিন্তু দূষণ মুক্ত জলে এইসব শৈবালের অতিরিক্ত বৃদ্ধিতে আবার অন্যরকম মুশকিল আছে।
এরা জলাশয়ের উপরিতলে বিস্তীর্ণ থাকে। শ্বসনের ফলে এরা প্রচুর CO2 উৎপন্ন করে, যা মাছেদের ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর শ্বসনে বিঘ্ন ঘটায় ও এদের মৃত্যু ঘটায়। কৌতূহলী রিন্টু প্রশ্ন করে, ‘এইসব শৈবাল একদিকে না হয় বর্জ্যজনিত দূষণ রোধ করল, কিন্তু এরা নিজেরা তো অন্যরকম আসুবিধা সৃষ্টি করে ফেলল। এর থেকে মাছেদের বাঁচাবে কে?’
ঝন্টু হেসে বলে, প্রকৃতিতে সে ব্যবস্থাও আছে। সায়ানোফাজ (LPP-I) ভাইরাস এইসব শৈবালকে পোষাকরূপে (Host) ব্যবহার করে। ফলে শৈবালের অতিরিক্ত বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। চুনী বসানো আংটিটা খুলতে খুলতে, বাবা ঘরে ঢুকে বলেন, সাধে কি আর গাইয়া হাইপোথেসিস (Gaia Hypothesis) বলেছে, “পৃথিবী হল Goddess Earth, সবরকম Controlling System পৃথিবী নিজেই করে রেখেছে।”
চুনী বসানো আংটিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রসঙ্গান্তরে যায় ঝন্টু,
‘এই যে দামী দামী পাথর চুনী (লাল), পান্না (সবুজ), পোখরাজ (হলুদ), পদ্মরাগ (গোলাপী) এগুলো কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য অ্যালুমিনিয়ামেরই অক্সাইড, অনার্দ্র অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের (Al2CO3) সঙ্গে সামান্য লোহা, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানীজ ইত্যাদির অক্সাইড মিশে নানারকম বর্ণের সৃষ্টি করে। এদের সৌন্দর্য, ঔজ্জ্বল্য ও কাঠিন্যের জন্য এরা মূল্যবান রত্নরূপে পরিচিত।”
ঝন্টুর কথা শেষ হতেই মায়ের ডাক শুনতে পায় ওরা, মা দুপুরের খাবার খেতে ডাকছেন। দুজনেই ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
আরো পড়ুন → প্রবন্ধ বিভাগ | বিজ্ঞানের ইতিহাস বিভাগ | প্রযুক্তি বিভাগ
ঝন্টু আর রিন্টুর বিজ্ঞানাড্ডা কিন্তু এখানেই শেষ নয়, বিজ্ঞানাড্ডার দ্বিতীয় পর্ব খুব শীঘ্রই আসছে। আপনাদের কিন্তু একটা কাজ এখনো বাকি; সেটা সম্পূর্ণ করতে আপনাকে যেতে হবে নিচের কমেন্ট বক্সে আর আমাদের জানাতে হবে যে এই লেখাটি আপনাদের কেমন লাগলো!
লেখিকা পরিচিতিঃ
ডঃ নন্দিনী ঘোষ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে অধ্যাপনারত। উনি পড়াশোনার পাশাপাশি আবৃত্তি, লেখালেখি করা ও ঘুরে বেড়াতে ভীষণ উৎসাহী।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা