আজকের এই বিশেষ প্রবন্ধটি একজন মহান ভারতীয়কে নিয়ে লেখা, যিনি তার অভূতপূর্ব জীবনে ভারতকে বিশ্বের দরবারে বহু খ্যাতি এনে দিয়েছেন, এমনকি পরাধীন ভারতে থেকেও স্বমহিমায় ব্রিটিশদের থেকে পেয়েছেন অজস্র সম্মান। উপরের ছবি দেখে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছেন যে কার কথা বলছি; ঠিক ধরেছেন, আজ আমরা এই স্বাধীন ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ও লেখক, ভারতরত্ন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনণের জীবনের কিছু ঘটনা ফিরে দেখবো।
শুরুর কথা
সালটা তখন ১৮৮৮, পরাধীন ভারতের মাদ্রাজ প্রভিন্সের (বর্তমানে তামিলনাড়ু রাজ্য) তিরুত্তানি নামক একটি ছোট গ্রামে ৫ই সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন শ্রী রাধাকৃষ্ণনণ। তাঁর বাবা ছিলেন স্থানীয় জমিদারের এক সাধারণ কর্মী, তাই পরিবার একেবারেই স্বচ্ছল ছিল না।
কিন্তু অভাবে কি আর প্রতিভা বাঁধ মানে?
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ডঃ রাধাকৃষ্ণনণ সব পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করতেন, ফলত নানা স্কলারশিপের মাধ্যমে তাঁর জ্ঞান আহরণ এগিয়ে চলত। স্নাতক স্তরে ভর্তির আগেই ডঃ রাধাকৃষ্ণনণ তাঁর দূর সম্পর্কের এক দাদার কাছ থেকে দর্শনের বই পান এবং তখনই ঠিক করেন তিনি দর্শন নিয়ে পড়বেন।
প্রতিভার বিচ্ছুরণ
তিনি তৎকালীন মাদ্রাজ খ্রিষ্টান কলেজ থেকে অসাধারণ সাফল্যের সাথে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতকোত্তর পড়াশোনার সময়ে “বেদান্ত দর্শনের বিমুর্ত পূর্বকল্পনা” (The Ethics of the Vedanta and its metaphysical Presuppositions) বিষয়ে একটি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ লেখেন, যা সেই সময়কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ হিসাবে বিবেচিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য “বেদান্ত” একটি ভারতীয় দর্শন যার মূল প্রবক্তা ছিলেন শঙ্করাচাচার্য, পরবর্তী সময়ে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী শিবানন্দ ইত্যাদি মনিষীগণ বেদান্ত দর্শনের পথিক ছিলেন।
শিক্ষকতা ও কর্মজীবন
মাত্র একুশ বছর বয়সে ডঃ রাধাকৃষ্ণনন, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে তাঁর শিক্ষক জীবন শুরু করেন। এর পর একে একে তিনি পড়িয়েছেন, মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময়ে, তিনি বিখ্যাত International Congress of Philosophy তে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এই সভায় তিনি ভারতীয় দর্শনকে আন্তর্জাতিক স্তরে বিশেষ পরিচিতি এনে দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ হিসাবে কাজ করেন। স্থায়ীভাবে অধ্যাপনা করা ছাড়াও তিনি দেশ – বিদেশের নানান বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন।
ভারত স্বাধীন হবার পর
ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পরে তিনি ভারতের প্রথম উপ – রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। তিনি কিন্তু রাজনীতির সাথে কোনভাবেই যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর সুবিশাল পাণ্ডিত্য, আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতি ও সম্মান তাঁকে এই পদের দাবীদার করে তোলে। দশ বছর ডঃ রাধাকৃষ্ণনন উপ – রাষ্ট্রপতি পদ অলংকৃত করার পর, রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনীত হন। তিনি ছিলেন স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। এছাড়া তিনি ভারতের সংবিধান রচয়িতা কমিটির (Constituent Assembly of India) একজন সদস্য ছিলেন এবং ভারতের সংবিধান রচনায় উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করেন।
সম্মান
ডঃ রাধাকৃষ্ণনন তাঁর বর্ণময় জীবনে বহু সম্মান পেয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম নাইটহুড (যদিও ভারত স্বাধীন হবার পরে তিনি ‘Sir’ উপাধি ত্যাগ করেন), ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির ফেলোশিপ, জার্মান বুক ট্রেড শান্তি পুরস্কার এবং ভারতরত্ন পুরষ্কার বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর জীবনকালে মোট ষোল বার নোবেল সাহিত্য পুরষ্কার এবং এগারো বার নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন।
শিক্ষক দিবস
সারা বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের ভুমিকা স্মরণ করে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। ডঃ রাধাকৃষ্ণনন রাষ্ট্রপতি হবার পরে, তাঁর ছাত্রছাত্রী ও শুভানুধ্যায়ীরা তাঁর জন্মদিন পালনে উদ্যত হলে তিনি তাঁর জন্মদিন পালনের বদলে দিনটিকে ভারতের শিক্ষক দিবস হিসাবে পালনের পরামর্শ দেন। তাঁর পরামর্শ মত সেই থেকে তাঁর জন্মদিন ৫ই সেপ্টেম্বর ভারতের শিক্ষক দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে। তাঁর কথায় –
“Teachers should be the best minds in the country”
শেষকথা
অভাব – দারিদ্র – সমস্যা কাউকে দমিয়ে রাখতে পারে না। অধ্যাবসায় ও জ্ঞানের তৃষ্ণা মানুষকে শীর্ষে উন্নীত করতে পারে। ঠিক যেমনভাবে ডঃ রাধাকৃষ্ণনন তাঁর সমস্ত সমস্যাকে অতিক্রম করে, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছিলেন সারা বিশ্বকে, গর্বিত করেছিলেন আপামর ভারতবাসীকে। চেষ্টা করলে আমরাও হয়ত এই শিক্ষকের দেখানো পথের পথিক হতে পারবো।
তথ্য সহয়তাঃ Wikipedia.org, NDTV.com
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা