পৃথিবীর সবথেকে কালো পদার্থ কি?
রাতের আকাশ? মানুষের চুল? আর কি কি কালো রঙের বস্তু আপনি ভাবতে পারেন?
আসুন আজ পৃথিবীর সবথেকে কালো পদার্থের সাথে আপনার পরিচয় করাই। তবে তার আগে আপনাকে আরো একবার মনে করিয়ে দি, যে আমাদের দৃষ্টিশক্তিতে আলো কিভাবে সাহায্য করে।
আমরা বিজ্ঞানে পড়েছি যে কোন বস্তুর উপর আলো পড়লে তা প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়ে। সেই আলোর প্রতিফলন থেকে প্রতিবিম্ব গঠিত হয় এবং এর ফলে আমরা দেখতে পাই। এবার ধরুন আপনি একটা কালো রঙের মুখোশ পরলেন, এবং তা পরে দিনের আলোয় আপনি বাইরে বেড়াতে বেরোলেন। মুখোশে ঢাকা থাকার কারণে আপনার মুখ কেউ দেখতে পাবে না বটে কিন্তু আপনার নাকের জন্য উঁচু হয়ে থাকা মুখোশের অংশ, চোখের গহ্বর, ভাঁজ – খাঁজ সব অন্যরা বুঝতে পারবে।
[আরো পড়ুন – অদ্ভুত একটি প্রাণীর কথা]
কিন্তু আমরা আজ যার কথা বলছি, এই কালো পদার্থটি দিয়ে তৈরী মুখোশ পরলে সব গায়েব। এমনকি এর তৈরী মাঙ্কিক্যাপ বানিয়ে এই পদার্থেরই পর্দার সামনে দাঁড়ান। আপনার মুখটা মনে হবে ধড় ছেড়ে হাওয়ায় ঝুলে আছে। ম্যাজিশিয়ানরা এর তৈরী মুখঢাকা কাপড় পরে নিজেদেরকে স্কন্ধকাটা হিসেবে হাজির করতে পারেন মঞ্চে।
ভাবছেন এর নাম কি?
VANTABlack, VANTA শব্দটির সম্পূর্ণ অর্থ হলো Vertically Aligned carbon NanoTube Arrays মানে, উল্লম্ব ভাবে রাখা কার্বনের তৈরী ন্যানোআকারের টিউব। এর কাজ 99.96% আলোকে শোষণ করে নেওয়া। শুধু তাই নয়। ছেলেবেলা থেকে আমরা পড়ে এসেছি, কালো সবথেকে ভালো তাপের শোষক/বিকিরক। VANTA Black এতটাই আলো শোষণ করে নেয় যে সেই আলোর সাথে আসা সব শক্তিও শুষে নেয়। আর সেই শক্তি-ই তাপ শক্তি হিসেবে সঞ্চিত হয়, আর এর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ।
এর ব্যবহার কি?
মহাকাশ দর্শণে ব্যবহৃত টেলিস্কোপের ভেতরের দেওয়ালে কালো ছাড়া অন্য বর্ণের প্রলেপ দিলে, দূরাগত নক্ষত্রের সামান্য আলোর অনেকটাই প্রতিফলিত হয়ে লেন্সে সমস্যার সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে Noise বলে, সাধারণ ভাষায় ঝিরঝির। কালোরঙ, অতিরিক্ত আলো সৃষ্টি হতে দেয় না। তাই ভেতরের দেওয়ালকে কালো রঙে রাঙানো হয় (প্রযুক্তিগত ভাবে বললে কালো কোনো রং নয়, অন্য রঙের অনুপস্থিতি। কিন্তু অনুপস্থিতি তৈরী করতে গেলে কোনো একটি রাসায়নিক লাগে যার ক্ষমতা আলো শোষণ করা। এখানে সেই রাসায়নিকের প্রলেপ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।)।
বিজ্ঞাপন
আর সব সেরা কালো রঙের সাথে তো আমরা একটু আগেই পরিচিত হয়েছি – VANTA Black। টেলিস্কোপ ছাড়াও আলোক কোষে (Solar Cell) তাপশক্তি শোষণ করতে এর ব্যবহার আছে।
তাহলে এটিকে আমরা বেশি করে ব্যবহৃত হতে দেখি না কেন?
কারণ এর প্রস্তুতি পদ্ধতি, 400oC উষ্ণতায় এটিকে বানাতে হয়। আর এত গরম তরল বানানোর পর এটি স্প্রে করা মুশকিল। তাই যার ওপর এটিকে প্রলেপ দিতে হয়, তার ওপরেই এটিকে বানানো হয়। এই কারণে সবকিছুর ওপর এটির প্রলেপ দেওয়া যায়না। তবে ধীরে ধীরে এই সমস্যাও দূর হয়ে যাবে বলে বিজ্ঞানমহলের বিশ্বাস। তবে আপনাকে আরো একটি মজার তথ্য দিই, আপনি নিশ্চয়ই ক্রিস্টোফার নলেন নির্দেশিত ব্যাটম্যান ট্রিলজি (যার পোশাকি নাম The Dark Knight Trilogy) দেখেছেন? ওখানে ব্যাটম্যান যে গাড়িটি ব্যবহার করেছিল তাকে ‘খুব’ কালো বানানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল VantaBlack প্রযুক্তি।
এবার আরো একটা আজব বস্তুর সাথে আপনার পরিচয় করাই। এক VANTA Black-এর শত্রু বলতে পারেন।
এর নাম স্পেকট্রালন, VANTA Black-এর ঠিক উল্টোটা। VANTA Black যদি পৃথিবীর সবথেকে কালো পদার্থ হয় তবে স্পেকট্রালন ঠিক উল্টোটা। একটি বিশেষ ধরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে 99.9% পর্যন্ত্য প্রতিফলিত করতে পারে।
[আরো পড়ুন – JUMP ম্যাগাজিনের প্রবন্ধ বিভাগ।]
ধরুন আপনি হাতে প্লাস্টার করেছেন। পদার্থটি স্পেকট্রালন দিয়ে তৈরী। এবার আপনার হাতে ওই প্লাস্টারের ওপর দিয়ে আগুনের তীব্র শিখা (2000oC) পাঠানো হলো। আপনি ভাবলেন “এই রে খুব ছ্যাঁকা খেলাম।” কিন্তু আদপেই আপনি কিছুমাত্র গরম অনুভব করলেন না। ভাবছেন কেন? কারণ সাদা রঙ হচ্ছে আলোক ও তাপের সবথেকে বড়ো প্রতিফলক। আর স্পেকট্রালন হলো পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শ্বেত বস্তু। তাহলে বুঝতেই পারছেন যে স্পেকট্রালন আগুনের সব তাপ প্রতিফলিত করে দিয়েছে। নিচের ভিডিওটিতে স্পেকট্রালনের উপর নানারকম পরীক্ষা দেখানো হয়েছে।
ফ্লুরিনের পলিমার দিয়ে তৈরী এই স্পেকট্রালনের মধ্যে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র থাকে।
এর ফলে এর প্রতিফলন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ এখনো অবধি খুব কম। কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এর ব্যবহার হচ্ছে, কারণ এটি খুব সহজে ময়লা, জল ইত্যাদি শুষে নেয়, ফলে এর প্রতিফলন ক্ষমতা উচ্চমাত্রায় হ্রাস পায়।
ভবিষ্যতে হয়তো এমন দিন আসবে যেদিন আমরা তাপনিরোধক হিসেবে স্পেকট্রালনের তৈরী সামগ্রী বাড়িতে ব্যবহার করবো। আর তখন গরম লাগলে AC চালাতে হবে না, স্পেকট্রালনের চাদর-ই আমাদের AC-র আরাম দেবে পরিবেশ দূষণ ছাড়াই।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা