dhatu
Study (পড়াশোনা)

ধাতু – সহজে ব্যাকরণ

সহজে ব্যাকরণ সিরিজ (নবম পর্ব) – ক্রিয়া


বন্ধুরা তোমরা নিশ্চয়ই জানো একটা বাড়ি যখন তৈরি হয় তখন কোন জিনিসটা একেবারে প্রথমেই দরকার পড়ে বা কোন জিনিসটা না হলে বাড়িটা তৈরি করা সম্ভবই হবে না? ভাবো দেখি।

আচ্ছা বলেই দিই। সেটা হল ইঁট।

কি ঠিক বললাম তো? ইঁট ছাড়া কখনো কোনো বাড়ি তৈরি হতে পারে একমাত্র মাটির বাড়ি ছাড়া? সত্যিই পারে না। ইঁট হল বাড়ি তৈরির প্রধান উপাদান, আরেকটু ভালো ভাষায় বললে বাড়ির প্রধান একক হল ইঁট। এর সঙ্গে সিমেন্ট, বালি মিশে গাঁথনি হয়। তাহলে অঙ্কের মতো বিষয়টা বুঝে নিই একটু –

বাড়ি = ইঁট + (সিমেন্ট + বালি)

ঠিক এই ধারণাটা কাজে লাগিয়েই আমরা বুঝে নেবো আজকের পড়ার বিষয় ‘ধাতু’। প্রথমেই বলে দিই তোমরা বিজ্ঞানে যে ধাতু পড়েছো সেই ধাতুর সঙ্গে ব্যাকরণের ধাতুর পার্থক্য রয়েছে। দুটি কিন্তু কখনোই এক জিনিস নয়। তাহলে প্রশ্ন করবে তোমরা যে ব্যাকরণে ধাতু বিষয়টি তাহলে কী? বলছি বলছি। সবুর করো। ব্যাকরণের ভাষায় ক্রিয়াপদের মূল একককে বা মূল উপাদানকে বলা হয় ধাতু। অর্থাৎ বাড়ি তৈরি করতে গেলে যেমন প্রধানত ইঁট লাগে, তেমনিই ধাতু ছাড়া ক্রিয়াপদ তৈরি হয় না। ধাতু হল ক্রিয়াপদের একক। অঙ্কের ভাষায় বুঝে নেওয়া যাক-

ক্রিয়াপদ = ধাতু + (প্রত্যয় + বিভক্তি)

তাহলে প্রথমেই একটা বিষয় ভালো করে তোমরা বুঝে নাও যে আমরা বাক্যে যে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করি তা উৎপন্ন হয় ধাতুর সঙ্গে প্রত্যয় এবং বিভক্তি যুক্ত হয়ে। এর মধ্যে ধাতু হল মূল উপাদান। একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বোঝালে আশা করি তোমরা সহজে বুঝতে পারবে।

উদাহরণ: আমি পড়ি। এই বাক্যে ক্রিয়া হল ‘পড়ি’। এখন এই ক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে যে ধাতু তা হল – ‘পড়্‌’। ‘পড়্‌’ ধাতুর সঙ্গে ‘ই’ বিভক্তি যুক্ত হয়ে ‘পড়ি’ এই ক্রিয়াপদটি তৈরি হয়েছে। এরকমভাবেই করা, খাওয়া, বসা, চলা, বলা, খাই, যাই, গাই, খেলছি, কাঁদছি ইত্যাদি সমস্ত ক্রিয়াপদকে ভাঙলেই ধাতুটি পাওয়া যাবে। তোমাদের বোঝার সুবিধের জন্য এখানে বেশ কিছু ক্রিয়াকে ভেঙে দেখানো হল –

খাওয়া = খা + আ বিভক্তি
বসা = বস্‌ + আ বিভক্তি
খাই = খা + ই বিভক্তি
খেলছি = খেল্‌ + ছি বিভক্তি

এভাবে বোঝাই যাচ্ছে প্রত্যেক ধাতুর সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হয়ে ক্রিয়াটি তৈরি হয়েছে। এখন শুধু যে বিভক্তিই যুক্ত হবে এমনটা নয়, অনেকক্ষেত্রে প্রত্যয়ও যুক্ত হতে পারে। আরেকটি জিনিস খেয়াল করো বন্ধুরা ধাতুর পাশে একটি চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে অঙ্কের বর্গমূলের চিহ্নের মতোই অনেকটা। এটি হল ধাতুর চিহ্ন। ধাতু নির্ণয়ের সময় এই চিহ্নটি অবশ্যই দিতে হবে। এখন পরপর তিনটি বাক্য লিখি। একটা অদ্ভুত জিনিস তোমরা এবারে খেয়াল করো।

আপনি খান।
তুমি খাও।
তুই খা।

তিনটি বাক্যেই মূল ক্রিয়া হল খাওয়া।

পুরুষ অনুযায়ী ক্রিয়ার রূপ বদলেছে। ‘খাওয়া’ এই ক্রিয়ার তিনটি রূপ দেখা যাচ্ছে – খান, খাও আর খা। অথচ তিনটি ভিন্ন রূপ হলেও ক্রিয়াগুলির ধাতু কিন্তু এক ‘খা’। অর্থাৎ পুরুষ ভেদে ক্রিয়ার রূপ বদলালেও ধাতু কিন্তু বদলায় না। বাড়ি যেমন এক তলাই হোক আর পাঁচ তলাই হোক কিংবা বাড়ির রঙ যাই হোক ভিতরে কিন্তু ইঁট একই থাকে। এও ঠিক একইরকম।

এই ধাতুকে ব্যাকরণে প্রকৃতি অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করা হয় – ১) মৌলিক ধাতু, ২) সাধিত ধাতু, ৩) সংযোগমূলক ধাতু। এই তিনপ্রকার ধাতু একে একে আমরা আলোচনা করবো এবারে। প্রথমেই চলে আসি মৌলিক ধাতুতে। মৌলিক কথার অর্থ যাকে ভাঙলে আর কিছু পাওয়া যাবে না অর্থাৎ যা স্বতন্ত্র। স্বয়ংসিদ্ধ এই ধাতুকেই বলা হয় মৌলিক ধাতু। যেমন – পড়্‌, কর্‌, দেখ্‌, খা, গা ইত্যাদি। এই মৌলিক ধাতুকে কিন্তু আরো তিনটি উপবিভাগে বিভক্ত করা যায়। সেগুলি হল –

ক) খাঁটি বাংলা মৌলিক ধাতু

এই ধাতুগুলি সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে আসেনি বাংলায়। যেমন – কর্‌, গা, কাট্‌, ছাদ্‌, কাঁদ্‌, জান্‌ ইত্যাদি।

খ) সংস্কৃত ধাতু

বাংলা ভাষায় সরাসরি সংস্কৃত থেকে যে শব্দগুলি এসেছে সেগুলিকে বলে তৎসম শব্দ। এখন এই তৎসম ক্রিয়াপদের যে ধাতু সেগুলিকে বলা হয় সংস্কৃত ধাতু। যেমন – কৃ, দৃশ্‌, গম্‌, বচ্‌, ত্যাজ্‌ ইত্যাদি।

গ) বিদেশি ধাতু

সবশেষে বলতে হয় বাংলায় আরবি, ফারসি, হিন্দি ইত্যাদি ভাষা থেকে আগত ক্রিয়াপদগুলির ধাতু হল বিদেশি ধাতু। যদিও এর প্রকৃত উৎস জানা যায় না বলে এগুলিকে অজ্ঞাতমূল ধাতু বলা হয়ে থাকে। যেমন – আট্‌, জম্‌, টুট্‌, টান্‌ ইত্যাদি।


আরো পড়ো→ ধ্বনির ধারণাবর্ণ | বাক্য | সন্ধি

এখন দেখে নাও বন্ধুরা কিভাবে এই ধাতুগুলি থেকে ক্রিয়াপদ তৈরি হয়।

কর্‌ + আ = করা; কাট্‌ + আ = কাটা; জান্‌ + ই = জানি
কৃ + তব্য = কর্তব্য; দৃশ্‌ + অন = দর্শন; গম্‌ + অন = গমন
আট্‌ + অক = আটক; জম্‌ + আনো = জমানো; টান্‌ + আ = টানা

একটাই পয়েন্ট মাথায় রাখো বন্ধুরা দ্বিতীয় লাইনে সংস্কৃত ধাতু থেকে ক্রিয়াপদ গঠনের ধাতুর সঙ্গে কিন্তু বিভক্তি যুক্ত হয়নি, ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রত্যয়। আর যে বিভক্তি ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্রিয়া গঠন করে সেগুলিকে বলা হয় ক্রিয়াবিভক্তি বা ধাতুবিভক্তি।

এবারে চলে আসি সাধিত ধাতুর আলোচনায়। সাধিত ধাতু হল খুব সহজে বললে মৌলিক ধাতুর সঙ্গে বিভক্তি বা প্রত্যয় যুক্ত হয়েই গঠিত হয়। মৌলিক ধাতুকে যেমন ভাঙা যায় না, এই সাধিত ধাতুকে কিন্তু ভাঙলে আরেকটি ধাতু পাওয়া যায়। অর্থাৎ ইঁটটা যদি মৌলিক ধাতু হয়, তবে ইঁটের সঙ্গে বালি-সিমেন্ট মিশিয়ে যে গাঁথনিটা তৈরি হয় সেটিকে সাধিত ধাতু বলা হবে।

এই সাধিত ধাতুও আবার তিনভাগে বিভক্ত। আমরা তালিকার মাধ্যমে ভাগগুলি উদাহরণসহ দেখে নিই –

১) প্রয়োজক ধাতু

মৌলিক ধাতু (কর্‌/দেখ্‌/নাচ্‌/দে) + প্রত্যয় (আ) কর্‌ + আ = করা, দে + আ = দেওয়া

২) নাম ধাতু

বিশেষ্য/বিশেষণ (হাত/ঘুম/চমক) + প্রত্যয় (আ) ঘুম + আ = ঘুমা, হাত + আ = হাতা

৩) ধ্বন্যাত্মক ধাতু

অনুকার শব্দ + আ কনকন + আ = কনকনায়

এই তালিকা দেখে আশা করি তোমরা বুঝতে পেরেছো ভাগগুলির বৈশিষ্ট্য। সাধিত ধাতুগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুটি বা তিনটি ধাপে তৈরি হয়। সবার শেষে রইলো পড়ে সংযোগমূলক ধাতু। এই ধাতুটি কিন্তু সাধিত ধাতুর থেকে আলাদা। এখানে কোনো ধাতুর সঙ্গে প্রত্যয় বা বিভক্তি যুক্ত হয় না। শুধু কিছু নির্দিষ্ট অক্ষর সংযুক্ত হয়ে বসে পাশে ঠিক অনুসর্গের মতো। উদাহরণ দেওয়া যাক। সাধারণত বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক ধাতুর সঙ্গে কর, হ, দে, পা ইত্যাদি যুক্ত হয়েই এই সংযোগমূলক ধাতু তৈরি হয়।

একমত + হ = একমত হ; রাজি+ হ = রাজি হ
জবাব + দে = জবাব দে; ভোট + দে = ভোট দে
ভক্তি + কর = ভক্তি কর; যোগ + কর = যোগ কর
কষ্ট + পা = কষ্ট পা; ভয় + পা = ভয় পা

এরকমভাবেই বাংলা ভাষায় ধাতুর বৈচিত্র্য দেখা যায় আর বিভিন্ন রকমের ধাতু থেকে নানা বৈচিত্র্যময় ক্রিয়াপদ তৈরি হয়। ভাষা যেহেতু প্রবহমান তাই এই ক্রিয়াপদ তৈরির কাজও বহমান। নতুন নতুন ক্রিয়া তৈরি হচ্ছে যার ধাতুর উৎস খুঁজে বের করাও কঠিন। তা যদিও ভাষাতাত্ত্বিকের গবেষণার বিষয়। আপাতত আমাদের ধাতুর আলোচনায় ইতি টানতে হল। এর পরে ধাতুর থেকে তৈরি হওয়া ক্রিয়াপদ সম্পর্কে আমরা জানবো। তবে আজ নয়। পরের ক্লাসে। ততদিন নিজেরা খুঁজে বের করো দেখি এরকম কিছু নতুন নতুন ক্রিয়াপদ।

নবম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বিভক্তি


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখাটি, অডিও, ভিডিও বা অন্য  কোন ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতিঃ

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –