ভৌতবিজ্ঞান – দশম শ্রেনি – অধ্যায়: রাসায়নিক বন্ধন (দ্বিতীয় পর্ব)
রাসায়নিক বন্ধন অধ্যায়ের প্রথম পর্বে আমরা আয়নীয় বন্ধন ও সমযোজী বন্ধনের ধরনা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা আয়নীয় বন্ধন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
আয়নীয় বন্ধন
আমরা এই ব্যাপারটা একটা সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করবো।
ধরো, তুমি একদিন স্কুলে যাচ্ছ। দেখতে পেলে একটি মেয়ে তোমার পাড়ার একটি ফ্ল্যাট থেকে বেরোলো, পরনে তোমারই স্কুলের পোশাক। তুমি তাকে আগে কখনো দেখোনি। মেয়েটি নিশ্চয়ই তোমার স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে। তা বেশ, তুমিও স্কুলে যাচ্ছ, সেও স্কুলে যাচ্ছে। একই বাসে উঠলে একই জায়গা থেকে, একসাথে নামলে, একই বারান্দা দিয়ে হাঁটছো। তুমি দেখছো তুমি যেদিকে যাবে, সেও সেদিকেই যাচ্ছে। যেতে যেতে তোমারই ক্লাসে গিয়ে ঢুকলো। তুমি চমকে গেলে!! আচ্ছা, মেয়েটি তাহলে তোমার ক্লাসেই ভর্তি হয়েছে!!!
বাহ্ বেশ! এতদিনে পাড়ায় তোমার একজন ক্লাসমেট পাওয়া গেলো। এবার স্কুলের কোনো প্রয়োজন থাকলে এর সাথেই যোগাযোগ করতে পারবে। তুমি মনে মনে ভাবলে, এর সাথে আলাপ পরিচয় করতে হবে।
ওদিকে মেয়েটিও তোমাকে লক্ষ্য করেছে, এবং সেও একই কথা ভাবছে। টিফিনের সময় সে নিজেই এগিয়ে এসে তোমার সাথে কথা বলল, নিজের পরিচয় দিলো। তুমি জানতে পারলে ওর বাবা ট্রান্সফার হয়ে এখানে চলে এসেছে সদ্য। তুমি বললে স্কুলে স্যার ম্যাডামরা ভালো, কোনো চিন্তা নেই।
এরপর কি হল?
কিন্তু শুধু আলাপ করলেই তো আর বন্ধুত্ব হয় না, বন্ধুত্ব মজবুত করতে চেষ্টা করতে হয়। কয়েকদিন পরে তুমি দেখলে হঠাৎ সেই মেয়েটি তোমার বাড়িতে হাজির তার মা কে নিয়ে, তার জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করতে। তোমার মা বললো “বেশ তো! ও যাবে!”
কিন্তু, তুমি চিন্তা করছো, জন্মদিন; খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না! তুমি বাবাকে বললে নারায়ণ সান্যালের “বিশ্বাসঘাতক” বইটা কলকাতা থেকে কিনে আনতে! বাবাও বেশ ভালোমতো প্যাকিং করিয়ে বইটা নিয়ে এলো। যথাদিনে তুমি বইটা নিয়ে নাচতে নাচতে তার বাড়ি গেলে।
কলিং বেল টিপতেই সে দরজা খুলে তোমাকে আসতে বললো হেসে। তুমিও তাকে বইটা দিয়ে “Happy Birthday” বললে। তারপর কেক কাটা খাওয়া দাওয়া, নাচ গান হলো। তুমি বাড়ি চলে এলে। তোমাদের বন্ধুত্ব কিছুটা পোক্ত হলো।
এবার বলো দেখি
- বইটা কে কিনেছে?
- বইটার বিল কার কাছে?
- উপহার দেওয়ার পরে বইটার মালিক কে?
- নতুন বইটা কে পড়ছে?
যদি বুঝতে পারো, তবে আয়নীয় বন্ধনও বুঝতে পারবে।
বইটা তুমি কিনেছিলে তাই বিল তোমার কাছে।
কিন্তু বইটার মালিক আর তুমি নও, তোমার বন্ধু; আর সে ঐ বইটাকে পড়ছে।
তুমি এখানে দাতা আর ও গ্রহীতা। মাঝখান থেকে তোমাদের মধ্যে একটা টান তৈরী হয়েছে আদানপ্রদানের মাধ্যমে, বন্ধুত্বের টান। ঠিক সেরকমই হয় পরমাণুতে।
এক ধরণের পরমাণু থাকে যাদের বাইরে 1, 2 বা 3টি ইলেক্ট্রন। এরা মূলত ধাতু বা হাইড্রোজেন হয়। আরেক ধরণের পরমাণুর বাইরের কক্ষে থাকে 4, 5, 6 বা 7টি ইলেক্ট্রন। এরা সাধারণতঃ অধাতু।
ধাতুদের দ্বিতীয় কক্ষে 2 বা 8 টি ইলেক্ট্রন থাকে, এরা স্থায়ী কক্ষপথ। 1, 2 বা 3 টি ইলেক্ট্রন ছেড়ে দিলে তারা স্থায়ী কক্ষপথ লাভ করে। ঠিক তেমনই অধাতুর বাইরের কক্ষে 4, 3, 2 বা 1টি ইলেক্ট্রন প্রবেশ করলে বাইরের কক্ষের ৮টি ইলেক্ট্রন চলে আসে, ফলে স্থায়ী কক্ষপথ তৈরী হয়ে যায়।
যেমন: সোডিয়ামের (Na) ইলেক্ট্রনিক বিন্যাস 2, 8, 1।
আবার ক্লোরিনের (Cl) 2, 8, 7। তাই সোডিয়াম একটি ইলেক্ট্রন ছেড়ে 2, 8 বিন্যাসের স্থায়ী কক্ষপথ লাভ করে, আর ক্লোরিন সেই ইলেক্ট্রন নিয়ে 2, 8, 8 বিন্যাসের স্থায়িত্ব পায়। তার ফলে সোডিয়াম Na+ ও ক্লোরিন Cl– আয়ন তৈরী করে। সেই আয়নগুলি নিজেদের মধ্যে তড়িদাকর্ষণের ফলে আয়নীয় যৌগ NaCl তৈরী করে।
এখন আগের গল্পে তুমি হচ্ছ ধাতু, বই হচ্ছে ইলেক্ট্রন ও তোমার বন্ধু হচ্ছে অধাতু। তাহলে তোমাদের মধ্যে যে টান, যে বন্ধনটা তৈরী হয়েছিল, সেটি হলো এইক্ষেত্রে আয়নীয় বন্ধন। ধাতু ইলেক্ট্রন ত্যাগের ফলে হলো দাতা, অধাতু হলো গ্রহীতা, আর ইলেক্ট্রন আদানপ্রদানের মাধ্যমে তৈরী হলো বন্ধন। ধাতু ঋণাত্মক আধান ত্যাগ করে হলো positive, অধাতু ঋণাত্মক আধান গ্রহণ করে হলো negative।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
বন্ধন কিভাবে হয়?
কিন্তু, এখন ভেবে দেখ, তোমার তো একজন বন্ধু নেই, অনেক এরকম বন্ধু আছে। আবার ওকে তো খালি তুমি একাই উপহার দাওনি, অনেকে উপহার দিয়েছে। সুতরাং যে টানটি তৈরী হয়েছে সেটি তোমার আর ওর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি একটি জালের ন্যায় বিস্তৃত হয়েছে। তোমার বন্ধুরা ওর বন্ধুরা, তাদের আবার কারুর কারুর মধ্যে পারষ্পরিক এরকম টান, সব মিলিয়ে একটি দৃঢ় বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরী হয়।
সেরকমই ধাতু অধাতুর এই বন্ধনে একটি ধাতুর ধনাত্মক আয়নকে ঘিরে প্রচুর ঋণাত্মক কণা বর্তমান থাকবে, আবার ঋণাত্মক কণার চারিদিকে প্রচুর ধনাত্মক কণা; সবমিলিয়ে আয়নীয় বন্ধনের সুদৃঢ় জাল তৈরী হয়। এই জালকগুলিকে কেলাস বলা যায়।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, যেহেতু কোনো একটি বিশেষ জোড়ার মধ্যে এই বন্ধন সীমাবদ্ধ নয়, তাই এর দ্বারা সৃষ্ট যৌগের প্রকৃত অণু সাধারণ উষ্ণতায় পাওয়া যায় না। আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এই ধনাত্মক বা ঋণাত্মক আয়ন কেবলমাত্র পরমাণুর থেকে সৃষ্টি হয় না, পরমাণুগুচ্ছ থেকেও তৈরী হয়। এদেরকে মূলক বলে। যেমন NH4+ বা NO3–।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
এই দৃঢ়তার কারণে যে যে ধর্মগুলি আয়নীয় যৌগে সৃষ্টি হয় সেগুলি হল
- কঠিন দশা
- উচ্চ গলনাঙ্ক বা স্ফুটনাঙ্ক
- জলীয় বা ধ্রুবীয় দ্রাবকে দ্রাব্যতা
- প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ক্ষমতা
- গলিত অবস্থায় তড়িৎ পরিবাহীতা
পরবর্তী পর্বে পড়ো → সমযোজী বন্ধন
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-Psc-8-2b