ভূগোল – দশম শ্রেণি – আঞ্চলিক ভূগোল (তৃতীয় পর্ব)
আগের পর্বে আমরা ভারতের ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্ব থেকে শুরু হবে ঐ ভূ-প্রকৃতিগুলির সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। এই পর্বে রইল উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল সম্পর্কিত আলোচনা।
উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখে নাই এই ভিডিও থেকে↓
ভারতবর্ষের উত্তরে অবস্থিত এই পার্বত্য অঞ্চল পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত হিমালয়, লাদাখ এবং কারাকোরাম পর্বত নিয়ে গঠিত হয়েছে।
হিমালয় পর্বতমালার এই বিশাল আকৃতি ও বিস্তৃতির জন্য উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলকে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলও বলা হয়।
উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থান ও বিস্তার
পৃথিবীর উচ্চতম হিমালয় পর্বতমালা একটি নবীন ভঙ্গিল পর্বত এবং ভারতের উত্তর পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত হয়েছে।
হিমালয় পর্বতমালা উত্তর-পশ্চিমে পামির গ্রন্থি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ধনুকের মতো বেঁকে পশ্চিমে বিস্তৃত হয়েছে।
হিমালয় পর্বত পশ্চিমে নাঙ্গা পর্বত (সিন্ধু গিরিখাত) থেকে পূর্বে নামচাবারোয়া (ব্রহ্মপুত্র গিরিখাত) পর্যন্ত বিস্তৃত।
দৈর্ঘ্য বরাবর 2,400 কিমি এবং উত্তর ও দক্ষিণে প্রস্থ বরাবর 200 থেকে 500 কিলোমিটার পর্যন্ত এই পর্বতমালা বিস্তার লাভ করেছে।
হিমালয়ের ভূপ্রকৃতি
হিমালয়ের ভূপ্রকৃতিকে প্রস্থ এবং দৈর্ঘ্য বরাবর ব্যাখ্যা করা যায়।
প্রস্থ বরাবর হিমালয়ের ভূপ্রকৃতি
হিমালয় পর্বত টেথিস সাগরের পলিতে ভাঁজ সৃষ্টির ফলে উৎপত্তি হয়েছে। তিনবার আলোড়নের ফলে বিভিন্ন উচ্চতায় হিমালয় পর্বত উত্থিত হয়েছে।
উচ্চতা অনুসারে হিমালয় পর্বতকে প্রস্থ বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে আড়াআড়িভাবে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন – শিবালিক হিমালয়, হিমাচল হিমালয়, হিমাদ্রি হিমালয় এবং টেথিস হিমালয়।
প্রথম তিনটি বাদে শেষের টেথিস হিমালয়ের অংশটি ভারতবর্ষের সীমার বাইরে তিব্বতে অবস্থিত।
এই বিভাগগুলোকে আমরা এবার বিস্তারিত আলোচনা করবো।
1. শিবালিক বা বহি: হিমালয়
শিবালিক হিমালয়, হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণতম পর্বতশ্রেণী। এই পর্বত শ্রেণী জম্মু-কাশ্মীরের দক্ষিণাংশ, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ, অরুণাচল প্রদেশ ও মেঘালয় রাজ্যে বিস্তৃত হয়েছে।
এই পর্বতমালার দৈর্ঘ্য 2,400 কিমি এবং প্রস্থ পশ্চিম প্রান্তে 50 কিলোমিটার পূর্বে 15 কিলোমিটার।
এই পর্বতশ্রেণী আজ থেকে প্রায় 20 লক্ষ থেকে 2 কোটি বছর আগে শেষ বা তৃতীয় ভূ-আন্দোলনের ফলে শিবালিক হিমালয় সৃষ্টি হয়।
শিবালিক বা বহি: হিমালয়ের বৈশিষ্ট্য
i) শিবালিক হিমালয়, হিমালয়ের নবীনতম পর্বত শ্রেণী।
ii) পশ্চিমবঙ্গে শিবালিক পর্বতে তিস্তা এবং রায়ডাক নদী উপত্যকা অংশে প্রায় 80 থেকে 90 কিলোমিটার এর একটি ফাঁক দেখা যায়।
iii) শিবালিক পর্বতমালার উত্তরে কয়েকটি উপত্যকা সৃষ্টি হয়েছে উত্তরাখণ্ডে যেগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন – দেরাদুন, কোটাদুন, পাটলিদুন।
খ. হিমাচল বা মধ্য হিমালয়
হিমাচল হিমালয় বা মধ্য হিমালয় শিবালিক হিমালয় এবং হিমাদ্রি হিমালয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। পিরপাঞ্জাল, ধউলিধর, মুসৌরি, নাগটিববা পর্বতশ্রেণীগুলি হিমাচল হিমালয়ের অংশ।
হিমাচল হিমালয়ের দৈর্ঘ্য 2,400 কিমি এবং প্রস্থ গড়ে 60 থেকে 80 কিলোমিটার। হিমাচল হিমালয়ের গড় উচ্চতা হলো 3,500 থেকে 4,500 মিটার।
আজ থেকে প্রায় 2.5 থেকে 3 কোটি বছর আগে দ্বিতীয় ভূ আলোড়নের ফলে হিমাচল হিমালয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
হিমাচল বা মধ্য হিমালয়ের বৈশিষ্ট্য
i) হিমাচল হিমালয়ের উত্তরমুখী ঢালটি মৃদু এবং দক্ষিণমুখী ঢালটি খাড়া।
ii) পিরপাঞ্জাল ও জাস্কার পর্বতের মাঝে কাশ্মীর উপত্যকা (135 কিলোমিটার দীর্ঘ 40 কিলোমিটার চওড়া), কুলু এবং কাংরা উপত্যকা অবস্থিত।
iii) এই অঞ্চলের প্রধান গিরিপথ হল পিরপাঞ্জাল, বানিহাল, রোটাং।
iv) এই অঞ্চলের প্রধান হ্রদগুলি হল সাততাল, ভীমতাল ও নৈনিতাল।
গ. হিমাদ্রি বা প্রধান হিমালয়
হিমাচল হিমালয়ের উত্তর ভারতের উত্তর প্রান্ত অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীরের উত্তর অংশ বরাবর এই পর্বতমালা বিস্তৃত হয়েছে।এর দৈর্ঘ্য 2,400 কিমি এবং গড় প্রস্থ 25 কিলোমিটার। এর পর্বতমালার গড় উচ্চতা হলো 6,100 মিটার।
হিমাদ্রি হিমালয় হল হিমালয়ের সর্বাপেক্ষা উচ্চতম অংশ।
আজ থেকে প্রায় 7 কোটি বছর আগে ইয়োসিন যুগে প্রথম ভূ আলোড়নের ফলে এই হিমালয়ের সৃষ্টি হয়।
হিমাদ্রি বা প্রধান হিমালয়ের বৈশিষ্ট্য
i) পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট (8,848 মিটার) এই হিমালয়ের অন্তর্গত।
ii) এছাড়া মাকালু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, ধবলগিরি অন্নপূর্ণা, কেদারনাথ, নন্দাদেবী, কামেট শৃঙ্গগুলি হিমাদ্রি হিমালয়ের অন্তর্গত।
iii) এই অঞ্চলের প্রধান গিরিপথগুলি হল নাথুলা, জেলেপলা, বুর্জিলা, সিপকিলা। এর মধ্যেই ডুংরিলা বা মানা গিরিপথ ভারতের সর্বোচ্চ (5,608 মিটার) গিরিপথ।
ঘ. টেথিস হিমালয়
প্রধান হিমালয়ের উত্তরে জম্মু-কাশ্মীরের উত্তর অংশে এবং হিমাচল প্রদেশের সামান্য অংশ জুড়ে বিস্তৃত। এই পর্বতমালার ভারতের মধ্যে অবস্থিত অংশটির দৈর্ঘ্য প্রায় 1,000 কিমি এবং প্রস্থ 40 থেকে 225 কিলোমিটার।
এর গড় উচ্চতা হলো 3,000 মিটার। আজ থেকে প্রায় 12 কোটি বছর আগে এই হিমালয়ের উত্থান শুরু হয়েছিল।
দৈর্ঘ্য বরাবর হিমালয়ের ভূপ্রকৃতি
দৈর্ঘ্য বরাবর হিমালয়ের শ্রেণিবিভাগ
দৈর্ঘ্য বরাবর হিমালয় পর্বতমালাকে পশ্চিম থেকে পূর্বে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
ক.পশ্চিম হিমালয়,
খ. মধ্য হিমালয়
গ. পূর্ব হিমালয়।
ক. পশ্চিম হিমালয়
পশ্চিম হিমালয় বলতে হিমালয় পর্বতের একেবারে পশ্চিমের বা বাম দিকের অংশকে বোঝায়। এই অংশটি পশ্চিমে সিন্ধু নদীর উপত্যকা থেকে পূর্বে কালি নদীর উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
এই পর্বতমালা প্রায় 880 কিলোমিটার বিস্তৃত। পশ্চিম হিমালয়কে আবার তিনটি অংশে ভাগ করা যায়।
A. কাশ্মীর হিমালয়,
B. পাঞ্জাব ও হিমাচল হিমালয়
C. কুমায়ুন হিমালয়।
A. কাশ্মীর হিমালয়
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত হিমালয়কে কাশ্মীর হিমালয় বলা হয়।
i) কাশ্মীর হিমালয়ের পর্বতশ্রেণী
কাশ্মীর হিমালয়ের অন্তর্গত পর্বতশ্রেণীগুলি হল কারাকোরাম, লাদাখ, জাস্কার, পিরপাঞ্জাল এবং সর্ব দক্ষিণে জম্মু ও পুঞ্চ পর্বতশ্রেণী। এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা 3000 মিটার।
এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি হল K2 বা গডউইন অস্টিন যা কারাকোরাম পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
ii) উপত্যকা
পিরপাঞ্জাল ও উচ্চ হিমালয়ের মাঝে অবস্থিত কাশ্মীর উপত্যকা এই অঞ্চলে অবস্থিত।
iii) মালভূমি
ভারতের উচ্চতম মালভূমি লাদাখ, জাস্কার, কারাকোরাম পর্বতের মাঝে অবস্থিত।
iv) হিমবাহ ও হ্রদ
এই অঞ্চলের প্রধান হিমবাহগুলি হল সিয়াচেন (ভারতের বৃহত্তম হিমবাহ), বলটারো, হিসপার, ফেডচেনকো ইত্যাদি।
কাশ্মীর হিমালয়ের উল্লেখযোগ্য হ্রদগুলি হল উলার ও ডাল হ্রদ।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
B. পাঞ্জাব ও হিমাচল হিমালয়
পাঞ্জাব ও হিমাচল প্রদেশের হিমালয়ের যে অংশটি অবস্থিত, তাকে পাঞ্জাব ও হিমাচল হিমালয় বলা হয়।
i) প্রধান পর্বত
এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান পর্বতগুলি হল ধউলিধর, মুসৌরি, নাগটিব্বা।
ii) প্রধান উপত্যকা
কুলু, কাংড়া, লাহুল, স্পিতি উপত্যকাগুলি এই অঞ্চলে অবস্থিত।
iii) প্রধান গিরিপথ
এই অঞ্চলের প্রধান গিরিপথ হল রোটাং।
C. কুমায়ুন হিমালয়
পশ্চিমে শতদ্রু নদী এবং পূর্বে কালী নদীর মাঝে উত্তরাখণ্ডে অবস্থিত হিমালয়কে কুমায়ুন হিমালয় বলা হয়।
i) প্রধান পর্বত
নাগটিব্বা ও মুসৌরি হল এখানকার প্রধান পর্বত। নন্দাদেবী (7,816 মিটার), কামেট (7,756 মিটার) ও ত্রিশূল হল এই অঞ্চলের প্রধান পর্বত শৃঙ্গ।
ii) উপত্যকা ও হ্রদ
এখানকার উপত্যকাগুলি ‘দুন’ নামে পরিচিত। যেমন – দেরাদুন।
এই অঞ্চলের হিমবাহ সৃষ্ট হ্রদগুলি ‘তাল’ নামে পরিচিত। যেমন – নৈনিতাল, সাততাল, ভিমতাল।
খ. মধ্য হিমালয়
হিমালয়ের এই অংশটি নেপাল রাষ্ট্রের অন্তর্গত। এই অংশের প্রধান পর্বতশৃঙ্গ হল ধবলগিরি, অন্নপূর্ণা, গৌরীশংকর, মাউন্ট এভারেস্ট (8,848 মিটার) এবং মাকালু।
গ. পূর্ব হিমালয়
পূর্ব হিমালয় পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা, সিকিম, অসম, অরুণাচল প্রদেশ বিস্তৃত হয়েছে। পশ্চিমে তিস্তা নদী উপত্যকা থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদীর উপত্যকা পর্যন্ত প্রায় 700 কিলোমিটার এই হিমালয় প্রসারিত হয়েছে।
সিকিমের অন্তর্গত কাঞ্চনজঙ্ঘা (8,586 মিটার) হলো ভারতের দ্বিতীয় এবং পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। কাঞ্চনজঙ্ঘা ভারতে অবস্থিত হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ রূপেও পরিচিত।
i) পাহাড় ও পর্বতশ্রেণী
সিঙ্গালিলা শৈলশিরা দার্জিলিং ও নেপাল সীমান্তে অবস্থিত। আসাম এবং অরুণাচল প্রদেশের হিমালয়কে অরুণাচল হিমালয় নামেও অভিহিত করা হয়।
নামচাবারোয়া (7,756 মিটার) এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এছাড়া কুলাকাংড়ি (7,838 মিটার) ও চামলহরী (7,326 মিটার) এখানকার উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গগুলির মধ্যে অন্যতম।
ii) গিরিপথ
এই অঞ্চলের প্রধান গিরিপথ হল জেলেপলা, নাথুলা, বামলা, টুঙ্গা প্রভৃতি।
iii) পূর্বাচল
পূর্বাচল হল হিমালয় পর্বতের পূর্ব প্রান্তের প্রসারিত বাহু যা অরুণাচল প্রদেশের নামচাবারোয়া থেকে বেঁকে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রসারিত হয়েছে।
পাটকোই,নাগা, লুসাই কোহিমা হল এই অঞ্চলের প্রধান পর্বত। নাগা পাহাড়ের (সরাবতী 3,826 মিটার) এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
iv) মালভূমি
মেঘালয় মালভূমির গারো, খাসি জয়ন্তিয়া হলো ক্ষয়জাত পাহাড়ের নিদর্শন। শিলং (1,965 মিটার) হল এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → উত্তরভারতের সমভূমি
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-Geo-5-a-3