money-bank
Class-11

অর্থ ও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা

Economicsএকাদশ শ্রেণি – অর্থ ও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা


কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ও তার ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি

ভারতের অর্থনীতির আলোচনায় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের অর্থ ও ঋণের জোগান নিয়ন্ত্রিত হয়। কোন দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, যে দেশের পুরো অর্থ জোগানকে নিয়ন্ত্রিত করে। এখন আমরা এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করব।

কেন্দ্রীয় (Central Bank) ও বাণিজ্যিক (Commercial Bank) ব্যাঙ্কের মধ্যে পার্থক্য

অর্থনীতিতে যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহ করে, সাধারন মানুষকে ঋণ প্রদান করে, মানুষের অতিরিক্ত অর্থ সঞ্চয় করতে সাহায্য করে ইত্যাদি কাজগুলি করে তাকেই ব্যাঙ্ক বলা হয়।

ব্যাঙ্ক প্রধানত দুই রকমের হয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এবং বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক।

যে কোনো দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে পরিচালনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।

যেমন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কটি হল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (Reserve Bank of India or RBI)। এবং যে ব্যাঙ্ক আমানত গ্রহণ করে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মানুষকে ঋণ প্রদান করে, মানুষের সঞ্চিত অর্থ তুলে নেওয়ার সুযোগ করে দেন, সেই ব্যাঙ্কগুলিকে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক বলে। যেমন, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক ইত্যাদি।


একাদশ শ্রেণি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের মূল উদ্দেশ্য হল দেশের আর্থিক উন্নয়নের দিকটি দেখা কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের মূল উদ্দেশ্য হল মুলাফা লাভ করা। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক যেমন আমানতকারীদের ব্যাঙ্কার তেমনই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক হল বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির ব্যাঙ্কার। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক দেশের নোট ছাপানোর ক্ষমতা রাখে কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক নোট ছাপাতে পারে না। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক থেকে যেমন আমানতকারীরা ঋণ গ্রহণ করতে পারে তেমনই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করতে পারে, সাধারণ মানুষ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে আমানত জমা বা ঋণ গ্রহণ করতে পারে না।

আমানতের (Deposit) প্রকারভেদ

বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির একটি কাজ হল সাধারণ মানুষ বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমানত সংগ্রহ করা ও জমা রাখা। যারা আমানত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে জমা রাখে তাদের আমরা আমানতকারী বলে থাকি।

আমানত আবার বিভিন্ন ধরনের হয়। সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায় আমানতকে স্থায়ী আমানত (Fixed Deposit) এবং চাহিদা আমানত (Demand Deposit)। চাহিদা আমানত আবার দুই প্রকার হয়, সঞ্চয়ী আমানত (Savings Deposit) এবং চলতি আমানত (Current Deposit)।


একাদশ শ্রেণি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

স্থায়ী আমানতের ক্ষেত্রে আমানতকারীরা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য এবং একটি নির্দিষ্ট সুদের হারে নিজেদের আমানত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে জমা রাখে। ওই নির্দিষ্ট সময়সীমা শেষ না হওয়া অবধি আমানতকারীরা নিজেদের আমানত তুলতে পারেন না। এই সময়সীমা এক মাস থেকে শুরু করে পাঁচ বা তার বেশিও হতে পারে। এই ধরনের স্থায়ী আমানতের ক্ষেত্রে সুদের হারও অন্যান্য আমানতের তুলনায় বেশি হয়। বর্তমানে স্থায়ী আমানতের উপর সর্বোচ্চ সুদের হার 5.5%।

চাহিদা আমানত কাকে বলে?

ব্যাঙ্কে জমা যে ধরনের আমানত থেকে কোনো ব্যাক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠান চেকের মাধ্যমে টাকা তুলতে পারে অথবা চাহিদা অনুযায়ী টাকা তুলতে পারে, সেই ধরনের আমানতকে চাহিদা আমানত বলা হয়। চাহিদা আমানত দুই প্রকার হয় সঞ্চয়ী আমানত এবং চলতি আমানত। সঞ্চয়ী আমানতে যেকোনো সময়ে টাকা জমা রাখা যায়। এবং চাহিদা মাত্রই সেই টাকা তোলাও সম্ভব। সঞ্চয়ী আমানতের উপর সুদের হার স্থায়ী আমানতের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম। বর্তমানে ব্যাঙ্কে সঞ্চয়ী আমানতে আমানতকারীকে অন্ততপক্ষে পাঁচশো টাকা জমা রাখতেই হয়।

তবে বর্তমানে সরকারের উদ্যোগে শূন্য টাকার ব্যালান্সে সঞ্চয়ী আমানতও খোলা হচ্ছে।

যে ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন খুব বেশি হয় তারাই সাধারণত চলতি আমানত খোলে। এই চলতি আমানত থেকেও চাহিদা মাত্রই টাকা তোলা যায়। এই আমানতের উপর সরকার কোন প্রকার সুদ প্রদান করে না বরং আমানতের হিসাব রক্ষার জন্য পরিসেবা মূল্য কেটে নেয়। চলতি আমানতের টাকা তোলার পরিমাণে কোন সীমাবদ্ধতা নেই কিন্তু সঞ্চয়ী আমানতে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।

সুদের (Interest Rate) প্রকারভেদ

মূলধনের শতকরা যে অংশ ঋণদাতা তার অর্থ ব্যবহারের জন্য দাবি করে তাকে সুদের হার বলা হয়।

সুদ বিভিন্ন প্রকার হয়, সরল সুদ এবং চক্রবৃদ্ধি সুদ।
সরল সুদ শুধুমাত্র পরিমাপ করা হয় আসলের উপর।
চক্রবৃদ্ধি সুদ পরিমাপ করা হয় আসল এবং আসলের ওপর যে সুদ ঋণগ্রহীতা লাভ করে তার ওপর।

এছাড়াও স্থায়ী সুদ প্রদান করা হয় স্থায়ী আমানত জমার উপর।

কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপায়সমূহ

ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন হাতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ব্যবহার করে আমরা সেগুলিই এখানে আলোচনা করব।

1. ব্যাঙ্ক বাট্টার হার বা ব্যাঙ্ক রেট (Bank Rate)

বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক যদি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ সংগ্রহ করে তখন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে যে হারে সুদ দেয় তাকেয় ব্যাঙ্ক রেট বলা হয়। দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ব্যাঙ্ক রেট বাড়িয়ে দেয়। আবার মন্দার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক রেট কমিয়ে দেয়। এই পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক অর্থনীতির বিভিন্ন অবস্থাকে মোকাবিলা করে ঋণ নিয়ন্ত্রণ নীতির মাধ্যমে।

2. পরিবর্তনশীল নগদ জমা অনুপাত (Cash Reserve Ratio or CRR)

যে কোন দেশের ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে বনিজ্যিক ব্যাঙ্ককে তার কাছে গচ্ছিত মোট আমানতের যেমন চাহিদা আমানত বা স্থায়ী আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কাছে জমা রাখতে হয়, সেই নির্দিষ্ট অংশকেই নগদ জমা অনুপাত বলে। দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক নগদ জমা অনুপাত বৃদ্ধি করে, আবার দেশে মন্দা অবস্থা দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক নগদ জমা অনুপাত হ্রাস করে।

3. খোলা বাজারে কারবার (Open Market Operation or OMO)

দেশে মুদ্রাস্ফীতি এবং মন্দা অবস্থা দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক খোলা বাজারে সরকারি ঋণপত্র যথাক্রমে বিক্রয় ও ক্রয় করে, একেই খোলাবাজারে কারবার বলা হয়। মুদ্রাস্ফীতির সময়ে মোট অর্থ প্রবাহ থেকে অর্থ সংকোচনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সরকারি ঋণপত্র বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে বিক্রি করে। মন্দার সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি থেকে সরকারি ঋণপত্র ক্রয় করার মাধ্যমে অর্থ প্রবাহের বৃদ্ধি ঘটায়।

4. বিধিবদ্ধ তরল জমা অনুপাত (Statutory Liquidity Ratio or SLR)

যে কোন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে পরিবর্তনশীল নগদ জমা অনুপাত ছাড়াও সেই ব্যাঙ্কের তরল সম্পদের যেমন ব্যাঙ্কের কাছে গচ্ছিত নগদ অর্থ, সোনা, সরকারি লগ্নিপত্র ইত্যাদির একটি নির্দিষ্ট অংশ ব্যাঙ্কের কাছে রাখতে হয়, সেই অনুপাতকেই বিধিবদ্ধ তরল জমা অনুপাত বলা হয়। দেশের মুদ্রাস্ফীতির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এই বিধিবদ্ধ তরল জমা অনুপাত বৃদ্ধি করে এবং দেশের মন্দা অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এই তরল বিধিবদ্ধ তরল জমা অনুপাত হ্রাস করে।

5. রেপো হার ও বিপরীত রেপো হার (Repo Rate and Reverse Repo Rate)

কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক যদি লক্ষ্য করে যে টাকার বাজারে ঋণের চাহিদা খুব বেশি তখন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি থেকে অল্প সময়ের জন্য সরকারি ঋণপত্র ক্রয় করে এবং তার বদলে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণ প্রদান করে। এই ঋণের উপর ধার্য সুদের হারকেই বলা হয় রেপো হার। এই Repo শব্দটির পুরো রূপটি হল Repurchase Agreement। চুক্তিমাফিক নির্দিষ্ট সময়ের পর বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কাছ থেকে আবার ওই ঋণপত্রগুলি পূর্বনির্ধারিত দামে ক্রয় করতে হয়।


একাদশ শ্রেণি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক যখন ঋণের বাজারে ঋণের চাহিদা কমিয়ে আনতে চায়, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক অল্প সময়ের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণপত্র বিক্রয় করে, এই সময়ে ঋণপত্রের ওপরে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে যে সুদ দেওয়া হয়, সেই সুদের হারকে বিপরীত রেপো রেট বলা হয়।

6. প্রান্তিক অর্থ জমা (Margin Money)

ব্যাঙ্ক থেকে যে বা যারা ঋণ গ্রহণ করে তাদের ঋণ গ্রহিতা বলা হয়, এই ঋণ গ্রহিতাদের মোট গৃহীত ঋণের একটি অংশ ব্যাঙ্কে জমা রাখতে হয়, এই অংশকেই প্রান্তিক অর্থ জমা বলা হয়। অনেক সময় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রান্তিক অর্থ জমার পরিমাণ কমানো হয়।

7. নৈতিক প্রণোদন (Moral Suasion)

উপরে আলোচিত ঋণ পদ্ধতি ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে বিশেষ সময়ে ঋণ নিয়ন্ত্রণের নৈতিক আবেদন জানায়, একেই নৈতিক প্রণোদন বলা হয়।
পর্ব সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতি

শ্রীরামপুর কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তনী শুভ্রা পাল। স্নাতকোত্তরের পড়াশোনার পাশাপাশি গান শুনতে এবং বাগান পরিচর্যা করতে ভালবাসেন শুভ্রা।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_eco_8a