varoter-vasha-poribar-bangla-vasha
Class-11

ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা- প্রথম পর্ব

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা (দ্বিতীয় অধ্যায়)


এর আগে বিশ্বের ভাষা ও পরিবার – দ্বিতীয় পর্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, এই পর্বে আমরা ভারতের ভাষা পরিবার ও বাংলা ভাষা- প্রথম পর্বটি আলোচনা করে নেব।

নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান

ভালো আছো তো বন্ধুরা?
ভাষা সাহিত্যের ক্লাস তোমাদের কেমন লাগছে জানিও। আশা করছি, তোমরা সহজ করে বিষয়গুলো বুঝতে পারছো। ভাষার ইতিহাসই হোক বা সাহিত্যের ইতিহাস, স্পষ্ট একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়াই এই ক্লাসের উদ্দেশ্য। সাহিত্যের ইতিহাসের ক্লাসে আমরা যেমন গল্পের ছলে কত শত কাব্য, পদাবলি, গীতিকা এসব পড়ে ফেলি, ভাষার ক্ষেত্রে এই কাজটা একটু জটিল লাগতে পারে তোমাদের কাছে। তাই যথাসম্ভব সহজ করে উদাহরণ দিয়ে পড়াটা বুঝে নিতে হবে তোমাদের।

আগের ভাষার ইতিহাসের ক্লাসে আমরা বিশ্বের ভাষা পরিবার সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছিলাম তোমাদের। পুরো পৃথিবী জুড়ে যে অসংখ্য ভাষা ছড়িয়ে আছে, তা যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকেই এসেছে, মূলগতভাবে সমস্ত ভাষাই যে এক সেটা আশা করি তোমরা বুঝতে পেরেছো। এবারে বিশ্বের ভাষা থেকে এবারে আমরা আরেকটু ফোকাস করে ভারতের ভাষার আলোচনায় ঢুকবো। ক্যামেরার ভাষায় বা সিনেমার ভাষায় বলতে গেলে লং শট থেকে এবারে ক্লোজ আপ শট নেবো। লং শটে আমরা দেখে নিয়েছি আগের ক্লাসে যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশেরই একটি শাখা ভারতে এসেছিল যার নাম ইন্দো-আর্য।

এখন এই ইন্দো-আর্য শাখাটির বিবর্তনের ফলে ভারতে কীভাবে সমস্ত ভাষা তৈরি হল সে আলোচনাই করবো আজকের ক্লাসে। ভারতের যে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, তাই তার শক্তি বলা যায়। এই বৈচিত্র্য ভাষাতেও রয়েছে। ভারতবাসীর পোশাক, মানসিকতা, ভারতের ভৌগোলিক পরিবেশ, জলবায়ু সবকিছুর বদলের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাও বদলে যায়।

উত্তরের পার্বত্য প্রদেশের যে ভাষা তার সঙ্গে দক্ষিণের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের ভাষা মেলে না। আবার পশ্চিমের মরু অঞ্চলের মানুষদের ভাষার সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের মানুষদের ভাষাও মেলে না। প্রধান ভাষা ছাড়াও আরো কত আদিম ভাষা রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কোনো একটা নির্দিষ্ট ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বন্ধুরা।

রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে অনেকগুলি প্রধান ভাষা।

একটা কথা চালু আছে, অনেকে এখনও মনে করেন যে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হল হিন্দি। কিন্তু একথা সর্বাংশে ভুল এবং মিথ্যা। হিন্দি তো নয়ই, বরং কোনো একটি ভাষা ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নির্বাচিত হয়নি সংবিধানে।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

এখন ভারতের ভাষার কথা বলতে হলে একটা উক্তিকে সামনে রেখে আমরা আলোচনাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। কী উক্তি? বলছি, বলছি। উক্তিটি হল –

‘ভারত চার ভাষাবংশের দেশ’

বিভিন্ন সালের প্রশ্নপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলেই তোমরা দেখতে পাবে এই উক্তিটি ধরে কতবার প্রশ্ন এসেছে। ফলে এটা একটা পরিচিত প্রবাদ হয়ে গেছে বলতে পারো। চলো দেখা যাক, এর আসল অর্থ কী। বিশ্বের ভাষা পরিবার যখন পড়েছিলে বন্ধুরা, নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো সেখানে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের কথা বলা ছিল।

সেই রকমই ভারতের মধ্যেও যে অজস্র পৃথক পৃথক ভাষা আছে তাদেরকে ভাষাবিজ্ঞানীরা মোট চারটি ভাষাবংশের অধীনে বিন্যস্ত করেছেন। সেগুলি হল-
• অস্ট্রিক ভাষাবংশ
• দ্রাবিড় ভাষাবংশ
• ভোটচিনা ভাষাবংশ
• ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ

এই চারটি নাম বন্ধুরা একেবারে জলবৎ তরলম্‌ করে মুখস্থ রাখতে হবে কিন্তু। ভাবছো হয়তো ভাষাবংশের নাম তো নাহয় মনে রাখবো, কিন্তু এগুলিকে চিনবো কীভাবে? মানে কোন ভাষা কোন ভাষাবংশের অন্তর্গত বুঝবে কী করে, তাইতো? দাঁড়াও খুব সহজ করে বলে দিচ্ছি।

ভারতের একটা ম্যাপ নাও দেখি আগে। নিয়েছো? ব্যাস, সামনে রাখো। এবারে একটা স্কেল আর পেন্সিল নাও। ঝটপট নাও। এবার ভারতের ম্যাপকে নীচের ছবির মতো লাইন টেনে ভাগ করো।

দেখো প্রথমে উত্তর আর দক্ষিণে রয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় আর দ্রাবিড় ভাষাবংশ। এবার ভারতের একেবারে উত্তর-পূর্ব দিকে দেখতে পাচ্ছো ভোটচিনা ভাষাবংশের অঞ্চলকে। এই তিনটে বাদে সমগ্র ভারতেই বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু অঞ্চলে অস্ট্রিক ভাষাবংশের ভাষাগুলির অস্তিত্ব রয়েছে।

মনে রাখার সুবিধার্থে বলি, আমাদের দক্ষিণ ভারতীয় যে সব ভাষা আছে তা সবই কিন্তু দ্রাবিড় ভাষার অন্তর্গত। যেমন – তামিল, তেলুগু, মালয়ালম, কন্নড় ইত্যাদি। আবার হিন্দি, পাঞ্জাবি, হরিয়ানভি, রাজস্থানি, গুজরাতি, মাগধী, মৈথিলি, সিন্ধ্রি, বাংলা, ওড়িয়া এগুলো সবই কিন্তু ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের অন্তর্গত।

ভোটচিনা নাম দেখেই আশা করি বুঝতে পারছো। খুব সহজ করে মনে রাখবে ভারতের যে অঞ্চলের মানুষদের দেখতে খানিকটা চিনের মানুষদের মতো, ঐ অঞ্চলের ভাষাগুলি সবই ভোটচিনা ভাষাবংশের মধ্যে পড়ে। যেমন – নাগা, বর্মি, অসমিয়া, ত্রিপুরি ইত্যাদি।

সবশেষে বলি অস্ট্রিক কথার মানে বুঝে নিতে হবে প্রাচীন বা আদিম ভাষা। এখন ভারতের যে সমস্ত আদিবাসী সম্প্রদায় রয়েছে তাদের ভাষাকেই অস্ট্রিক ভাষাবংশের মধ্যে ধরা হয়। যেমন ধরো মুন্ডারি, সাঁওতালি, শবর, ভূমিজ ইত্যাদি ভাষাগুলি অস্ট্রিক ভাষাবংশীয়। তাহলে আশা করছি ভারতের সমগ্র ভাষার শ্রেণিগুলি সম্পর্কে তোমাদের একটা প্রাথমিক ধারণা হয়েছে। এবারে আমরা এক এক করে এই সব ভাষাবংশগুলি সম্পর্কে জেনে নেব।

• অস্ট্রিক ভাষাবংশ

ভারতীয়দের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় সম্পর্কে আমরা একটা ক্লাসে আগেই আলোচনা করেছিলাম। সেখানে তোমরা নিশ্চয়ই জেনেছো আদি-অস্ত্রাল বা প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের কথা? সেই আদি-অস্ত্রালদের ভাষা হল অস্ট্রিক। ভারতের সবথেকে প্রাচীন জনগোষ্ঠী হল নেগ্রিটো। মনে করা হয় এই অস্ট্রিক ভাষাবংশের জন্ম হয়েছে এই নেগ্রিটোদের হাত ধরেই। বর্তমান ভারতে এই ভাষাবংশ থেকে জাত প্রায় ৬৫টি ভাষা বিস্তৃত রয়েছে। এই ভাষাবংশের অনেকগুলি প্রকারভেদ রয়েছে। আমরা সেই প্রকারগুলি এক ঝলকে নীচের রেখাচিত্র থেকে দেখে নিই –

সমগ্র ভারতে বিস্তৃত অস্ট্রিক ভাষাবংশের মূলত দুটি শাখা – অস্ট্রোনেশীয় এবং অস্ট্রো-এশিয়াটিক। এখন এই অস্ট্রোনেশীয় শাখাটি আবার ভারতের বাইরেও বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত হয়েছে আর সেই সেই অঞ্চলের নাম অনুসারে উপশাখাগুলির নামকরণ করা হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ায় বিস্তৃত এই ভাষাবংশের শাখাটির মধ্যে প্রধান ভাষা হল মালয়। তাছাড়া ফিজি দ্বীপপুঞ্জ, ক্যারোলিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, তাহিতি ও হাওয়াই দ্বীপের ভাষাগুলি যথাক্রমে মেলানেশীয়, মাইক্রোনেশীয় ও পলিনেশীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত। সহজ করে বুঝে নাও অস্ট্রোনেশীয় বলতে ভারতের বাইরের ভাষা আর অস্ট্রো-এশিয়াটিক বলতে ভারতের অন্তর্বর্তী ভাষাগুলিকে বোঝায়। একইভাবে অস্ট্রো-এশিয়াটিক শাখাটি কেবলমাত্র ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

এই শাখাটির স্থানভেদে তিনটি উপবিভাগ করা হয়েছে। বর্তমানে এর পূর্বী শাখাটির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না সমগ্র ভারতে। কিন্তু পশ্চিমা ও মধ্যদেশীয় শাখাগুলির যথাক্রমে ৫৮টি ও ৭টি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। পশ্চিমা শাখা বলতে বোঝাই যাচ্ছে ভারতের অন্ত্যজ ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভাষা এর মধ্যে পড়বে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার আর ওড়িশায় দেখা যায় সাঁওতালি আর মুন্ডারি ভাষা। একটা মজার জিনিস হল এই ভাষার উপবিভাগটির নাম পশ্চিমা, কিন্তু তার অবস্থান ভারতের পূর্বদিকে।

অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওড়িশায় শবর ভাষা এবং মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে কোরকু ভাষা দেখা যায়। এছাড়া খাড়িয়া, হো ইত্যাদি আদিম ভাষাগুলিও পশ্চিমা অস্ট্রো-এশিয়াটিক শাখার অন্তর্গত। এই শাখার শেষ উপবিভাগ মধ্যদেশীয়কে অনেকে ‘মন-খমের’ ভাষা বলেও উল্লেখ করে থাকেন। বন্ধুরা এই মধ্যদেশীয় ভাষা বলতে মূলত খাসি ও নিকোবরি ভাষাকে বোঝায়। একেবারে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে শিলচর, মিজোরাম, শিলং-এর দিকে তিনটে পাহাড় রয়েছে দেখতে পাবে ভারতের ম্যাপে। গারো, খাসি আর জয়ন্তিয়া পাহাড়। গারো আর খাসি পাহাড়ের পাদদেশে যে বিরাট জনবসতি গড়ে উঠেছে তাদের ভাষাকে পাহাড়ের নামেই গারো আর খাসি ভাষা বলা হয়ে থাকে। এই দুটি ভাষাই মধ্যদেশীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নিকোবরি ভাষার প্রচলন শুধুমাত্র আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেই দেখা যায়।

[এই ছিল আমাদের অস্ট্রিক ভাষাবংশের পরিচয়। পরীক্ষার উত্তর লেখার ক্ষেত্রে তোমরা অবশ্যই পয়েন্ট, তালিকা ইত্যাদি সহযোগে গুছিয়ে এই কথাগুলিই লিখবে। এ নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা যায়, কিন্তু এই পরিসরে তা অপ্রয়োজনীয়।]

• ভোটচিনা

এবারে আমরা একটু উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে তাকাই বন্ধুরা। দেখো ভারতে যে সময় আর্যরা এসেছিল বলে আমরা জানি বা ইতিহাসে পড়েছি, ঐতিহাসিকদের মতে তার অনেক আগেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মোঙ্গলয়েডদের আধিপত্য ছিল।

ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে এই মোঙ্গলয়েডদের ভাষার নামই ছিল ভোটচিনা।

এখনও আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড ইত্যাদি রাজ্যে এই ভাষাবংশ প্রচলিত।

এই ভাষাবংশও বন্ধুরা অস্ট্রিকের মতো মূলত দুটি শাখায় বিভক্ত –
• ভোটবর্মী
• তাইচিনা

ভোটবর্মীর ‘ভোট’ আর তাইচিনার ‘চিনা’ একত্রিত করে এই ভাষাবংশের নাম দেওয়া হয়েছে ভোটচিনা। আমরা একে একে এই ভাষাবংশের শাখাগুলি সম্পর্কে জেনে নিই চলো। প্রথমে আসি ভোটবর্মীর কথায়। এই শাখাটি কিন্তু আবার চারটি উপবিভাগে বিভক্ত। যথা –
ক. বোডো বা বোরো
খ. নাগা
গ. কুকিচিন
ঘ. বর্মী

গারো, কোচ, রাভা, কাছারি ইত্যাদি ভাষাগুলি সব বোডো শাখার অন্তর্গত। বোডো ভাষাবংশের মধ্যে মোট ২২টি ভাষার সন্ধান পেয়েছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। নাগাল্যান্ড ও মণিপুরে প্রচলিত আও, অঙ্গামি, সেমা ইত্যাদি ভাষাগুলি নাগা শাখার অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া আসামের লুসাই পার্বত্য অঞ্চলে প্রচলিত কুকিচিন শাখার মধ্যে রয়েছে মণিপুরের ঐতিহ্যবাহী মেইতেই ভাষা, মিজো, কুকি ইত্যাদি ভাষা।

সবশেষে বলতে হয় বর্মী শাখাটির কথা। এই ভাষাবংশটি মূলত ব্রহ্মদেশের অন্তর্গত হলেও চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে প্রচলিত যে মোঘ্‌ মরু ইত্যাদি ভাষা রয়েছে, তা সবই এই ভাষাবংশের অন্তর্গত। তাইচিনা শাখাটি ভারত ছাড়াও এশিয়ার অন্যত্র বিস্তৃত হয়েছে। ভারতে এই ভাষাবংশের অন্তর্গত ভাষাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল খামতি, অহোম ইত্যাদি ভাষা।

আসামে যে অহোম ভাষা প্রচলিত ছিল ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে, তা এই তাইচিনা ভাষাবংশেরই অন্তর্গত ছিল। মনে করা হয় অহোম ভাষা থেকেই পরে অসমিয়া ভাষার জন্ম হয়েছে।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

তবে মূলত এই দুটি ভাষাবংশ ছাড়াও ‘ইয়েনিসি’ নামে আরেকটি শাখাগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে বলে জানা যায়। ভারতের হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলেও এই ভোটধর্মী শাখাটির সন্ধান পাওয়া গেছে। কাশ্মীরের লাদাখ, হিমাচল প্রদেশের লাউল ও স্পিতি জেলার মানুষদের যে ভাষা তা কিন্তু এই ভোটধর্মী ভাষারই রূপবৈচিত্র্য বলা চলে।

• দ্রাবিড় ভাষা

এখন আমরা জানবো, দ্রাবিড় ভাষা সম্পর্কে। আগেই বলেছি বন্ধুরা, ভারতের দক্ষিণাংশের সমস্ত ভাষাই এই দ্রাবিড় ভাষাবংশের অন্তর্গত। আগে আমরা দেখে নিই ঠিক কোন কোন ভাষা বা মোট কতগুলি ভাষা এই দ্রাবিড় ভাষাবংশের মধ্যে রয়েছে।

একেবারে তালিকা ধরে দেখে নাও – তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম এগুলো হল প্রধান দ্রাবিড়ীয় ভাষা আর এছাড়া রয়েছে কোডাভা, তুলু, ব্রাহুই, গোন্ডি, কুরুখ, কুরমালি ইত্যাদি ভাষাগুলি।

এ অনেকটা আমাদের বাংলার প্রামাণ্য ভাষা আর উপভাষার মত। এখন এত্গুলি ভাষাকে ভাষাবিজ্ঞানীরা মোট চারটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছেন –
• দক্ষিণী
• উত্তরা
• মধ্যদেশীয়
• বিচ্ছিন্ন
বিষয়টা একটু সহজ করে বলে দিই তোমাদের। ভারতে অস্ট্রিক ভাষাগুলি এনেছিল আদি-অস্ত্রাল বা প্রোটো-অস্ট্রোলয়েডরা, একথা আমরা একটু আগেই জেনেছি। এখন জানবো যে, তাদের আসার পরে একদল ভূমধ্যসাগরীয় জনগোষ্ঠী ভারতে প্রবেশ করে। মূলত তাদের ভাষা হল দ্রাবিড় ভাষা।

আর্যদের আগমনের সময় ভারতে ঠিক ঐ গুজরাত, আহমেদাবাদের কাছাকাছি বিশালাকায় বিন্ধ্য পর্বত ছিল। সে পর্বত এত উঁচু ছিল যে আর্যরা উত্তর ভারতে নিজেদের বসতি বিস্তার করলেও সে পর্বত ডিঙিয়ে এ পারে দাক্ষিণাত্যে আসতে পারেনি। সে কারণেই ভারতের বুকে দুটি পৃথক ভাষাবংশ, দুটি পৃথক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড়দের সঙ্গে তাই আর্যদের সংস্কৃতির এত অমিল। ভাষাতেও অমিল।

আর্যরা ফরসা, সুন্দর, উন্নত নাসা চেহারা তাদের, একেবারে বিদেশিদের মতো আর অন্যদিকে দ্রাবিড়ীয়দের চেহারা রামায়ণে কল্পিত রাবণের মতো, ঘন কৃষ্ণকায়। কিন্তু শুনলে আশ্চর্য হবে আর্যদের সংস্কৃতির থেকেও দ্রাবিড়ীয়দের সংস্কৃতি অনেক প্রাচীন। আর্যদের যে রামায়ণ রয়েছে, রাম-রাবণ-সীতার কাহিনী রয়েছে, দ্রাবিড়ীয়দের মধ্যেও তা রয়েছে কিন্তু তার ঘটনাক্রম বা চরিত্রের পরিচয় অনেক অনেক আলাদা।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

যাক সে কথা, আমরা ভাষার ঘরে ফিরে আসি। এই যে চারটে ভাগ করলেন ভাষাবিজ্ঞানীরা, এগুলির মধ্যে আলাদা আলাদা ভাষাকে স্থান দেওয়া হল তাদের প্রকৃতি অনুসারে। ভারতে অধিক প্রচলিত তামিল, তেলুগু, কন্নড় আর মালয়ালম হল দক্ষিণী বিভাগের অন্তর্গত। তাছাড়া রয়েছে নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলে প্রচলিত টুডু ও কোটা, মহীশূরের টুলু ভাষা ইত্যাদি। এবারে দেখো বন্ধুরা উত্তরা ভাগের মধ্যে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা আর মধ্যপ্রদেশে প্রচলিত ওঁরাও ভাষা এবং ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড়ের নিকটবর্তী অঞ্চলে প্রচলিত মালপাহাড়ি ভাষা। অদ্ভুত লাগছে শুনতে হয়তো।

দ্রাবিড় ভাষা কীভাবে এই সব অঞ্চলে থাকতে পারে!

আসলে দ্রাবিড় মানেই যে দক্ষিণ ভারতের ভাষা হতে হবে তা কিন্তু নয়। এটা আমাদের একপ্রকার ভুল ধারণা। দ্রাবিড় একটা জাতির নাম, একটা সংস্কৃতির নাম। তারা যে যে অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল, সেই সেই অঞ্চলেই তাদের ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। ফলে দক্ষিণ ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে তারা উত্তর-পূর্বদিকেও যে এসেছিল কোনোভাবে সে প্রমাণ বা সাক্ষ্য বহন করছে এই ভাষাগুলো। ওঁরাও এবং মালপাহাড়ি ভাষাকে আমরা সাধারণত উপজাতিদের ভাষা বলে চিনি।

আমি আগেই বলেছি, দ্রাবিড়দের সভ্যতা অনেক প্রাচীন। ফলে সে দিক থেকে এই ভাষা দ্রাবিড় ভাষাবংশের হতেই পারে তাতে সন্দেহ কীসের! তবে এর সঙ্গে অস্ট্রিক ভাষাগুলিকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। মনে করে দেখো অন্ধ্রপ্রদেশেও কিন্তু শবর ভাষা ছিল যেটা অস্ট্রিক ভাষাবংশের অন্তর্গত। দ্রাবিড় ভাষাবংশের মধ্যদেশীয় শাখার মধ্যে রয়েছে গোদ জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত গোন্ডি ভাষা এবং ওড়িশায় প্রচলিত কুই, কোন্দ, খোন্দ ইত্যাদি ভাষা। এগুলি খুবই কম ব্যবহৃত হয়, এই সব ভাষার native speaker-এর সংখ্যা খুবই কম। আর সবশেষে রয়েছে বিচ্ছিন্ন শ্রেণিটি।

কেন এমন নাম সেটা আগে জেনে নাও, তাহলেই মনে থেকে যাবে। এই দ্রাবিড় ভাষার উপবিভাগটি পাকিস্তানের অন্তর্গত বেলুচিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে পাওয়া যায়। ভারতের একেবারে বাইরে এই উপবিভাগ পাওয়ার দরুনই একে ‘বিচ্ছিন্ন’ নামকরণ করা হয়েছে। বেলুচিস্তানের ব্রাহুই ভাষাটি মূলত এই উপবিভাগের অন্তর্গত। তাহলে আশা করি বুঝতে পারলে কী বৃহৎ পরিসরে এই ভাষাবংশগুলি বিস্তৃত রয়েছে। কত না শ্রেণি, উপশ্রেণি এইগুলির। তবে তোমাদের জন্য সহজ করে মনে রাখার সুবিধার্থে দ্রাবিড় ভাষার একটা তালিকা করে দিচ্ছি একবার শুধু চোখ বুলিয়ে নাও –

দেখো ভারতের তিনটে ভাষাবংশের কথা কিন্তু আমাদের জানা হয়ে গেল বন্ধুরা। এবারে পড়ে রইল শুধু ভারতীয় আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশটি। বিশ্বের ভাষা পরিবারে এই শাখাটির কথা খানিক শুনেছিলে। মনে করে দেখো বন্ধুরা, এই ইন্দো-ইউরোপীয় শাখারই একটি অংশের নাম ছিল ইন্দো-ইরানীয় যেটি চলে গিয়েছিল ইরান সহ মধ্য এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে আর একটি শাখা ঢুকে পড়েছিল আমাদের ভারতে।

সেটার নামই ভারতীয় আর্য।

এই ভাষাবংশের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার উৎপত্তির ইতিহাস। ভারতীয় আর্য থেকে কীভাবে বাংলার জন্ম হল সেই নিয়ে আলোচনাটা অনেকটাই বড়ো হবে, তাই তোমাদের আর ক্লান্ত না করে আজকের মতো এখানেই ইতি টানছি। ভারতীয় আর্য ভাষার উদাহরণ ও আলোচনা সহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিয়ে আবার ফিরে আসা যাবে পরের ক্লাসে। ততদিন ছুটি।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → দ্বিতীয় পর্ব

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_Bhasa_Poribar_1