বাংলা – একাদশ শ্রেণি – ভাষা (প্রথম অধ্যায়)
এর আগে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, এই পর্বে আমরা বিশ্বের ভাষা ও পরিবার সম্পর্কে আলোচনা করবো।
এইবারে শুরু হয়ে গেল তোমাদের সবথেকে অপছন্দের বিষয়। গল্প-কবিতা-নাটক তবু একরকম করে পড়ে উদ্ধার পেয়েছো, বলা ভালো পরিত্রাণ পেয়েছো। কিন্তু এই একাদশ-দ্বাদশ দুই বছর ধরে যে নতুন পরিবারের সঙ্গে তোমাদের থাকতে হবে, কিছুটা বাধ্য হয়ে, কিছুটা ভয়ে আর কিছুটা ভালোবেসে পড়ে বৈতরণী পেরোতে হবে তা হল গিয়ে বিচ্ছিরি সাহিত্যের ইতিহাস আর ভয়ানক কিম্ভূতমার্কা ‘ভাষা’। নাম শুনলেই গায়ে জ্বর আসার মতো দশা হয় সবার। একে তো বাংলা, তার উপর এইসব ‘অনাবশ্যক’ জিনিস কেন যে পড়তে হয়!
তাহলে বলি, প্রত্যেক ভাষারই তো একটা ইতিহাস আছে। ভাষা বলতে শুধু গল্প-কবিতা নয়, তার একটা তত্ত্বের বিষয় রয়েছে, ইতিহাস রয়েছে। তোমরা তো এখন বড়ো হয়ে গেছো, তাই সেগুলি জানা দরকার কিছুটা। তবে এই বিষয়গুলি ততটাও নীরস নয়। একটু গল্পের মতো বুঝে নিলেই হল। ক্ষমা-ঘেন্না করে কিছুদিন ধরে এই ক্লাসগুলিতে তোমাদের সঙ্গে যে সাহিত্যের-ভাষার গল্প করবো তা শুনলে আর বুঝলেই পরীক্ষা নামক বৈতরণীটি অনায়াসে তোমরা পেরিয়ে যাবে আশা রাখি। তাহলে আজকের নতুন ক্লাস শুরু করা যাক।
একাদশ শ্রেণি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
আজ আমরা ভাষার একেবারে প্রাথমিক কিছু ধারণা নেবো।
ভাষা কী?
এক কথায় বললে, ভাষা হল ভাবের বাহন। তবে তো অঙ্গভঙ্গি দিয়েও ভাব প্রকাশ করা যায়, সেগুলিও কি ভাষা? হ্যাঁ, সেই অঙ্গভঙ্গিও একপ্রকার ভাষা। আমরা পরে জানবো এই অঙ্গভঙ্গিকে বলে ‘প্যারা-ল্যাঙ্গুয়েজ’।
তাহলে, বলতে হয় ঠিক করে আমাদের বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবহ ধ্বনিসমষ্টিকে ভাষা বলে।
তার মানে দাঁড়ালো ভাষা মুখে বলতে হয়। কীভাবে বলবো? ধ্বনির সাহায্যে। এখন প্রশ্ন হল, কুকুর-বিড়াল-হাতি-বাঘ-সিংহ ইত্যাদি যত পশু-পাখি আছে তারাও তো নিজের নিজের মত করে মুখ দিয়ে ধ্বনি বের করে, তাহলে ওগুলি কি ভাষা?
এক অর্থে ভেবে দেখো বন্ধুরা, ওরা কিন্তু ঐ শব্দের সাহায্যেই পরস্পরের মধ্যে ভাব বিনিময় করে, ফলে তা ভাবের বাহন আর তাই এক অর্থে পশু-পাখিদের ধ্বনিকে ভাষা বলা চলে।
কিন্তু মানুষের ভাষার সঙ্গে তার কিছু পার্থক্য তো আছেই। আমরা মানুষরা যখন ব্যথা পাই তখন তা প্রকাশ করি বিশেষ ধ্বনি উচ্চারণ করে। ধরা যাক, তোমায় কেউ পেন দিয়ে খুঁচিয়ে দিল হাতে, কিংবা মাথায় হাত দিয়েই জোরে চাঁটি মারলো, কিংবা পেটে গদাম করে একটা ঘুষি চালিয়ে দিলো বা ধরো একটা স্কেল দিয়ে তোমার মাস্টারমশাই পড়া না পারার জন্য বেদম পেটালেন (চিন্তা নেই আমার কাছে আন্তর্জালীয় মার খাবার অবকাশ নেই, পড়া না পারলেও ছুটি) তাহলে সবসময় কি তুমি একইরকম শব্দ করে ব্যথা প্রকাশ করবে?
ভেবে দেখো, একদমই নয়। প্রত্যেকবারই তোমার অনুভূতি প্রকাশের ধরন আলাদা আলাদা হবে। এটাই মানুষের ভাষার বৈচিত্র্য। একটা কুকুর দেখবে খুব বেশি অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না আলাদা আলাদাভাবে। কিন্তু মানুষ পারে। তাই তার ভাষাও অনেক উন্নত। এই হল আমাদের ভাষা নিয়ে ভাসা-ভাসা জ্ঞান।
তা বাংলা তো আমাদের মাতৃভাষা। ভালো লাগলেও তাই, না লাগলেও তাই। কী করা যাবে! এই ধরো তোমাদের কত ইচ্ছে হয় যদি স্পেনে জন্মাতে, বা ফ্রান্সে, কিংবা টেমস নদীর ধারে একটা ছোট্ট কটেজে থাকতে, ইচ্ছে হয় স্প্যানিশ ভাষা শিখতে, ইচ্ছে হয় ফ্রেঞ্চ শিখে পাড়া-পড়শিদের ভড়কে দিতে। কিন্তু জানো কি, এই সব ভাষাই আসলে বলতে গেলে ভাই-বোন আরকি! প্রত্যেকেই আসলে একই মায়ের সন্তান।
পৃথিবীতে যত ভাষা আছে দেখতে গেলে সবকটাই একটা পরিবারের অন্তর্গত।
হ্যাঁ ফ্যামিলি আছে মানে, এক্সটেণ্ডেড ফ্যামিলিও আছে। মাসি-পিসি-কাকা-জ্যাঠা-ভাইপো-ভাইঝি-ভাগ্নে-ন’কাকিমা-সেজ পিসিমা-ভালো দিদা-রাঙা মাসি সব্বাই আছে। আরে হাসির কথা নয়। সত্যি বলছি। মজা-তামাশা নয়। আরে দেখো বিশ্বাসই করতে চায় না। দাঁড়াও তাহলে আসল কথায় আসি। পৃথিবীতে অজস্র ভাষা রয়েছে আর ভাষাবিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন এইসব ভাষার মধ্যে কয়েকটার সঙ্গে কয়েকটার কিছু সাদৃশ্য আছে।
তাই অনুমান করা হয়েছে এরা একই ভাষাবংশ থেকেই জন্ম নিয়েছে। সকলেরই মত হল, পৃথিবীতে বহু প্রাচীনকালে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকেই সব প্রধান ভাষাগুলির জন্ম হয়েছে।
এইবারে তো খুব সহজেই ইতিহাসে চলে যাওয়া যায়। সেই কত প্রাচীনকালে উরাল পর্বতের পাদদেশ থেকে একদল যাযাবর ঘুরতে ঘুরতে বহু ভূখণ্ডে গিয়েছিল। তাদের কাজ ছিল পশুপালন। তারা কৃষিকাজ মোটে জানতো না। এদেরকেই তো আর্য নামে চিনি আমরা।
সেই আর্যরা যে ভাষায় কথা বলতো সেটাকেই ধরে নেওয়া হয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা।
ইন্দো মানে ইণ্ডিয়া বুঝলে পুরোটা বোঝা হয় না। তবে এই ভাষার বেশিরভাগটাই ইউরোপ জুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল আর একটা অংশ এসেছিল ভারতে।
তাই এর নাম দিয়েছেন ভাষাতাত্ত্বিকেরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ।
তাহলে এই আর্যরা যেখানে যেখানে পা রেখেছে সেখানেই এই ভাষা ছড়িয়ে পড়েছিল। আর্যরা ভারতেও এসেছিল আমরা জানি সেটা। তাহলে ভারতের যে সমস্ত ভাষা রয়েছে তারাও কিন্তু এই ভাষাবংশেরই অন্তর্গত। তাহলে ব্যাপারটা সহজ করে দাঁড়ালো এই যে ভারতের ভাষাই হোক বা ইউরোপের আসলে তারা একই ভাষাবংশজাত। ফ্যামিলি মেম্বার না হলেও এক্সটেণ্ডেড ফ্যামিলি মেম্বার বলা যায় আরকি! একটা তালিকার মাধ্যমে এই ব্যাপারটা তোমাদের পরিস্কার হয়ে যাবে –
তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের জন্ম হচ্ছে প্রায় ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তারপর মোট নয়টি শাখায় এটি ভেঙে যাচ্ছে এবং একেক অঞ্চলে এক একটি নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছে।
এই নয়টি শাখার নাম একটু কষ্ট করে মনে রাখতে হবে তোমাদের – ইতালীয়, গ্রিক, জার্মানিক, কেলতিক, তোখারীয়, আলবেনীয়, বালতো-স্লাভিক, আর্মেনীয় ও ইন্দো-ইরানীয়।
এই নয়টি ভাষা থেকে তালিকায় দেখো আরো কতো নতুন নতুন ভাষা জন্মেছে। অর্ধেক ভাষার নামই শুনিনি আমরা। আজ্ঞে হ্যাঁ ভাষার এই পরিবার নক্ষত্রপুঞ্জের মতোই বিস্তৃত।
প্রতি মুহূর্তে যেমন গ্যালাক্সিতে একটি নক্ষত্র জন্মাচ্ছে, আবার একটি নক্ষত্র বিস্ফোরণের ফলে মরে যাচ্ছে; তেমনিই পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে প্রত্যহ একটি করে নতুন ভাষার জন্ম হচ্ছে বলে জানা যায়। আর ভাষা জন্মালেই তো হল না, সেই ভাষায় কথা বলার মতো লোক চাই তো যাকে বলে ‘নেটিভ স্পিকার’। সেই বক্তারা যদি না থাকে বা এককালে থাকলেও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, মারা যাচ্ছে তাহলে সেই ভাষাও আস্তে আস্তে মরে যাবে।
এবারে একটা ভাষা পরিবারই শুধু নেই পৃথিবীতে। এই ইন্দো-ইউরোপীয় ফ্যামিলি ছাড়াও পাঁচতলা কমপ্লেক্সে আরো কয় ঘর ফ্যামিলি আছে বন্ধুরা। সবুর করো পরিচয় করাচ্ছি। একেবারে পাঁচতলায় সামনের দিকে থাকেন ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবার – অভিজাত, একটু নাক উঁচু জানো তো।
একাদশ শ্রেণি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
ঐ তলাতেই গায়ে গায়ে থাকে সেমীয়-হামীয় পরিবার – ফ্যামিলির সবাই ‘সেম’, হামাগুড়ি দিয়ে আড়ি পাততে এরা ওস্তাদ। চলে আসুন পাঁচতলার একেবারে পিছনের প্লটে, পাবেন বান্টু পরিবারকে – পরনিন্দা করতে এরা একপায়ে খাড়া।
তারপর চারতলায় থাকেন ফিনো-উগ্রীয় আর আলতাইক পরিবার, এরা রোজ উগ্র ধূপের গন্ধে কমপ্লেক্সের মাথা খান।
তারপরে তিন তলায় রাজার হালে থাকেন ককেশীয় পরিবার, এতই পরিস্কার এরা যে কাকও এদের ছায়া মাড়ায় না আর ঐ তলাতেই থাকে আরো দুটি পরিবার দ্রাবিড় আর অস্ট্রিক। না না রাহুল দ্রাবিড়ের কথা ভেবো না, এরা আলাদা।
দোতলায় ভোট-চিনীয় আর প্রাচীন এশীয় পরিবার চাউমিন রাঁধতে ভালোই পারে।
সবশেষে একতলায় এস্কিমো পরিবারের এ.সি- কতবার যে খারাপ হয় ইয়ত্তা নেই আর তার পাশে আমেরিকার আদিম ভাষা পরিবারকে দেখলে গুহাবাসী মানুষের কথা মনে পড়বে নিশ্চিত।
একাদশ শ্রেণি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
তাহলে আশা করি পরিবারগুলিকে চিনে নিতে পেরেছো। চিনে রাখো কিন্তু, ভালো করে চিনে রাখো। এবারে এই যে এত পরিবারের কথা বললাম জানো বন্ধুরা পৃথিবীর সব ভাষার পরিবার নেই।
তাই ভাষাকে দুইটি ভাগে ভাগে করা হয়েছে – বর্গীভূত আর অবর্গীভূত ভাষা। অর্থাৎ পরিবারসহ ভাষা আর পরিবারহীন ভাষা।
এই যে ভাষাগোষ্ঠীগুলির কথা বললাম এগুলি সবই কিন্তু বর্গীভূত ভাষা। আর কিছু কিছু অবর্গীভূত ভাষা হল – জাপানি, কোরীয়, বাস্ক, ভারতের আন্দামানি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের খজুনা ইত্যাদি।
এগুলির আসলে হয়েছে কি একে অপরের সঙ্গে কোনো সাদৃশ্যই পাওয়া যায়নি, পরিবারে থাকবে কি করে। মিল না থাকলে কি আর পরিবার হয়! জাপানি হোক বা কোরীয় একে অপরের সঙ্গে অনেক ফারাক।
প্রথম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → দ্বিতীয় পর্ব
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XI_Beng_Bhasa_1