বাংলা – একাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)
এর আগে ধর্মমঙ্গল আর শিবায়ন কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা বৈষ্ণব পদাবলী সম্পর্কে আলোচনা করবো।
আবার সাহিত্যের ইতিহাস। আরেকটি নতুন পর্ব নিয়ে চলে এলাম বন্ধুরা। আজকে আমরা একটু পদাবলী নিয়ে কথা বলবো। পদাবলী কী জিনিস, তা তো তোমরা জানো না। চলো তাহলে আর দেরি না করে শুরু করি আজকের ক্লাস।
প্রাচীনকালের বাংলা সাহিত্যে সমস্ত রচনাই নির্দিষ্ট ছন্দে কবিতার আকারে বা গানের আকারে লেখা হতো। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনই বলো বা মঙ্গলকাব্যই বলো। তোমরা দেখেইছো যে কাহিনি বা গল্পকে প্রাচীন কবিরা কাব্যের রূপ দিতেন। ঠিক একইভাবে ভাবমূলক কোনো কবিতাংশকে ‘পদ’ বলা হতো আগে।
খেয়াল করে দেখো চর্যার কবিতাগুলিকেও আমরা পদ বলতাম,তাই তার নাম চর্যাপদ। এখন এই পদের সমাহারই হল পদাবলী। তবে যে কোনো কাব্য বা কবিতাংশের পদ সমাহারকেই পদাবলী বলা হয় না। পদাবলীর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ভাববস্তু থাকতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ভাব হল আধ্যাত্মিক ভাব। বাংলাদেশে প্রথম পদাবলীকে লিখেছেন যদি বলতে হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে উঠে আসবে কবি জয়দেবের নাম। কিন্তু তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্য সংস্কৃতে লেখা, বাংলায় নয়।
[সেই কাব্যেই জয়দেব লিখেছিলেন ‘মধুরকোমলকান্ত পদাবলীম্’ যা থেকেই পরে পদাবলী কথাটির উদ্ভব ও প্রচলন ঘটে।]
এখন বাংলা সাহিত্যে পদাবলী দুই ধরণের-
১) বৈষ্ণব পদাবলী
২) শাক্ত পদাবলী
এই পর্বের ক্লাসে আমরা অতি সংক্ষেপে দুই ধরনের পদাবলীর ব্যাপারেই জানবো। আলোচনা যখন সংক্ষিপ্ত, তখন পয়েন্টভিত্তিক হলেই ভালো হয়।
দুই পদাবলীর ক্ষেত্রেই আলোচনাকে আমরা এভাবে ভাগ করে নিতে পারি –
- মূল ভাব
- পর্যায়
- কবি ও কবি প্রতিভা
বৈষ্ণব পদাবলী
বৈষ্ণব পদাবলীর মূল ভাব
মূলত বৈষ্ণব ধর্মের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাই এই পদাবলীর মূল ভিত্তি। রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমের মধ্য দিয়ে আসলে এখানে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের কথাই বলা হয়। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণনায় বৈষ্ণব কবিরা বেশ কিছু রস পর্যায় তৈরি করেছেন। এগুলি আসলে প্রেমেরই বিশেষ বিশেষ পর্যায়, মিলনের পথে যাত্রার মূহুর্ত বিশেষ।
বৈষ্ণব পদাবলীর পর্যায়
বৈষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রে কবিরা বেশ কিছু সুস্পষ্ট পর্যায়ের আধারে পদ রচনা করেছেন। এই পর্যায়গুলি হল – পূর্বরাগ ও অনুরাগ, মান, অভিসার, আক্ষেপানুরাগ, মাথুর ও ভাব-সম্মিলন। এছাড়াও রয়েছে গৌরচন্দ্রিকা ও গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদ এবং কৃষ্ণের বাল্যলীলা। এই পর্যায়গুলি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের প্রথম পর্যায় পূর্বরাগ। প্রেমিক ও প্রেমিকার পারস্পরিক আকর্ষণের ফলে মানসিক ব্যাকুলতা ও ভালো লাগা তৈরি হওয়াই পূর্বরাগ।
তারপরে উভয়ের ঘনিষ্ঠতা যত বাড়তে থাকে, মান-অভিমানের পালা চলতে থাকে। প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার সাক্ষাতের যে ঘটনা, তাকেই অভিসার বলে। প্রিয় প্রেমিকের উদ্দেশে প্রেমিকারা যে সংকেত-কুঞ্জে যাত্রা করেন তাই হল অভিসার। বৈষ্ণব পদাবলীতে এই অভিসারের পদগুলির আলাদা মাহাত্ম্য আছে। রাত্রিকালীন অভিসার, তিমিরাভিসার, জ্যোৎস্নাভিসার, দিবাভিসার, বর্ষাভিসার ইত্যাদি অভিসারের অনেক ধরণ আছে।
তারপরের পর্যায় আক্ষেপানুরাগ যেখানে প্রেমের সূচনার কারণেই প্রেমিক ও প্রেমিকা আক্ষেপ করেন অথচ তাতেই যেন উভয়ের মধ্যে অনুরাগ আরও বেড়ে যায়। মাথুর পর্যায় আসলে বিরহের পর্ব। প্রেয়সীকে ছেড়ে প্রেমিক চলে গেছে বহু দূরে, হয়তো সে আর নাও ফিরে আসতে পারে। প্রেমিকের স্মৃতিকে বুকে নিয়ে তার কথা ভেবে ভেবে রাত-দিন প্রেমিকার বেদনা অনুভব করাই হল মাথুর।
একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
সবশেষে আছে ভাব-সম্মিলন। বিচ্ছেদ ঘুচে গিয়ে এখানেই কৃষ্ণ ও রাধার মধ্যে প্রেমের পূর্ণতা দেখা দেয়। এ নিয়ে আরও কথা বলা জরুরি ছিল, কিন্তু সময় ও স্থানাভাবে আশা করি এই আলোচনার মধ্যেই বিষয়টি অনুধাবন করে নিতে তোমাদের কোনো অসুবিধে হয়নি। এখন চৈতন্য-পরবর্তী সময়ে যে সব কবিরা বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেছেন, তার মধ্যে শ্রী-চৈতন্য বিষয়ক পদ রচনা করেছেন যেগুলিকেই গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদ বলা হয়।
অন্যদিকে গৌরচন্দ্রিকা মানে হল ভণিতা। পদাবলী কীর্তনের রূপে আগে গাওয়া হত। পদাবলী গান পরিবেশনের আগে এই গৌরচন্দ্রিকা করে নেওয়া হতো যার মাধ্যমে বৈষ্ণব পদাবলী প্রেমকে আধ্যাত্মিক প্রেমের মহিমায় ভূষিত করা হত। আবার পদের মধ্যে কৌশলে পদকর্তারা যেভাবে নিজেদের নাম সংযুক্ত করে দিতেন তাকেও গৌরচন্দ্রিকা বলা হয়ে থাকে।
কবি ও কবি-প্রতিভা
বৈষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রে কবিদের জানতে হলে দুটি কাল-পর্যায়ে ভেঙে নিতে হবে – ক. চৈতন্য-পূর্ব এবং খ. চৈতন্য-পরবর্তী। চৈতন্য-পূর্ব যুগের বৈষ্ণব পদকর্তা হলেন – চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি; অন্যদিকে চৈতন্য-পরবর্তী বৈষ্ণব পদকর্তা হলেন জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস। এই চারজন কবিকে নিয়েই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে। চলো তাহলে একে একে এই কবিদের বৈশিষ্ট্য তথা কবি-প্রতিভা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
ক) বিদ্যাপতি
মিথিলার কবি বিদ্যাপতি বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে এক অন্যতম নাম। তিনি বাংলা এবং মৈথিলি ভাষার মিশ্রণে সৃষ্ট ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদ রচনা করেছেন। মিথিলার রাজসভার কবি ছিলেন বিদ্যাপতি। নিজে শৈব হয়েও রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক পদ রচনায় তাঁর কৃতিত্ব ছিল অসামান্য। বয়ঃসন্ধি, অভিসার, মিলন, মান, মাথুর ও ভাবসম্মিলনের পদ রচনাতেই তাঁর মুন্সিয়ানা সমধিক। তবে তাঁকে মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি মনে করা হয়। তাঁর লেখা বিরহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদ হল –
‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।।’
শোনা যায়, স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদ পাঠ করে রসাস্বাদন করতেন। বিদ্যাপতির পদে মধুর ব্রজবুলি ভাষা এবং প্রত্ন-কলাবৃত্ত ছন্দ সুষমা বাঙালি পাঠককে আকৃষ্ট করেছিল।
খ) চণ্ডীদাস
চণ্ডীদাসকে পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয়। তাঁর পদাবলীতে রাধা এক পরিণত নায়িকা, কৃষ্ণের প্রেমে সে ব্যাকুলপ্রাণা। অথচ পূর্বরাগের পদগুলিতেও রাধাকে এক বিরহিনী নারীর আদলে গড়ে তুলেছেন চণ্ডীদাস। তার ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল ও আন্তরিক। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘চণ্ডীদাস সহজ ভাষার সহজ ভাবের কবি’। তাঁর পদ্গুলিতে অনেক সময়ই স্বভাবোক্তি অলঙ্কারের প্রয়োগ দেখা যায়। তাঁর পদে রাধা কৃষ্ণপ্রেমে আকুল হয়ে প্রেমের প্রথম ক্ষণ থেকেই কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পিতা।
পূর্বরাগ পর্যায়ের অধীন চণ্ডীদাসের লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদ হল –
‘রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা
বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে
না শুনে কাহারো কথা।
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে
না চলে নয়ানতারা।
বিরতি আহারে রাঙাবাস পরে
যেমত যোগিনী-পারা।।’
একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
গ) জ্ঞানদাস
জ্ঞানদাসের রচনারীতির মধ্যে পূর্বতন কবি চণ্ডীদাসের বহুল প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বলে জ্ঞানদাসকে ‘চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য’ বলা হয়। চণ্ডীদাসের মত জ্ঞানদাসের রচনাও সহজ ভাষার সহজ ভাবের পদ। রাধার চরিত্র ও রূপবর্ণনার মধ্যে উভয়ের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। চৈতন্য-পরবর্তী যুগের বৈষ্ণব পদকর্তাদের মধ্যে পূর্বরাগ, অনুরাগ ও গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদ রচনা করলেও জ্ঞানদাসের খ্যাতি মূলত তাঁর রূপানুরাগ ও আক্ষেপানুরাগের পদের জন্য। চণ্ডীদাস যেখানে ছিলেন মরমিয়া আসধক, জ্ঞানদাস সেখানে রূপশিল্পী। আক্ষেপানুরাগের পদগুলিতে জ্ঞানদাস রাধার যে অনুতপ্ত চিত্তের বর্ণনা দেন তা অতুলনীয়। চণ্ডীদাসের রাধা যেমন আত্মবিস্মৃত, জ্ঞানদাসের রাধা সেই তুলনায় অনেক বেশি রূপ সচেতন। জ্ঞানদাস লেখেন –
‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।’
ঘ) গোবিন্দদাস :
চৈতন্য-পরবর্তী কবিদের মধ্যে গোবিন্দদাস অভিসার পর্যায় এবং গৌরচন্দ্রিকার পদ রচনায় কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। বল্লভদাস তাঁকে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। বিদ্যাপতির মত গোবিন্দদাসও ব্রজবুলি ভাষাতেই সবথেকে বেশি পদ রচনা করেছেন। রাধার রূপ বর্ণনার ক্ষেত্রেও উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। গোবিন্দদাসকে তাই ‘বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য’ বলা হয়। অভিসার পর্যায়ের পদে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য রাধার যে দুর্বার ব্যাকুলতা তার বর্ণনা দিয়েছেন গোবিন্দদাস। অনেক কষ্ট সহ্য করে অভিসার যাত্রার আগে রাধার প্রস্তুতির বর্ণনা দিতে গোবিন্দদাস লেখেন –
‘কণ্টক গাড়ী কমলসম পদতল
মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি
গাগরি বারি ঢারি করি পীছল
চলতহি অঙ্গুলি চাপি।।’
সৌন্দর্যচেতনা আর গভীর হৃদয়ানুভূতিই গোবিন্দদাসের পদের মুখ্য উপজীব্য।
[এটুকু ভালো করে আয়ত্ত করতে পারলেই পরীক্ষা-বৈতরণী পেরোতে অসুবিধে হবে না তোমাদের। আজকের পর্বে এটুকুই থাক। আজকের মত ছুটি।]
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → চৈতন্যদেবঃ বাঙালি সমাজ ও সাহিত্যে চৈতন্যপ্রভাব
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_12