modhyojuge-bangla-8
Class-11

মনসামঙ্গল কাব্য | মধ্যযুগে বাংলার সমাজ সাহিত্য

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)

এর আগে মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা মনসামঙ্গল কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করবো।

আগের দিন যে মঙ্গলকাব্য নিয়ে অনেক আলোচনা করেছিলাম, তা মাথায় আছে নিশ্চয়। সেই মঙ্গলকাব্য নিয়েই পরপর পাঁচটা ক্লাসে পাঁচটা গল্প বলবো। তবে এই গল্পগুলোর মধ্যে একটা কাঠামো আছে। সেই কাঠামোটা আগেই বলে দেবো তোমাদের। তোমাদের কাজ হবে শুধু সেই কাঠামোটা মাথায় রেখে গল্পের ভিতর থেকে সারবস্তু নিয়ে নেওয়া।

মনসামঙ্গল কাব্য

চার প্রকার মঙ্গলকাব্যের কথা আগেই বলেছি, মনে আছে তো?
তার প্রথমটি নিয়ে আজ আমাদের এই গল্প। মনসামঙ্গল কাব্য। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এই কাব্যে দেবী মনসার পূজা প্রচারের কাহিনী আছে। মঙ্গলকাব্যের চিরাচরিত গঠন তো জানোই।

প্রথমে দেব বন্দনা, তারপরে গ্রন্থোৎপত্তির কারণ, আর তারপরে মূল কাহিনি। মূল কাহিনিরও আবার দুটি ভাগ – দেবখণ্ড ও নরখণ্ড।

মনসামঙ্গলেও তাইই রয়েছে। তবে এই সব মঙ্গলকাব্য নিয়ে কথা বলতে গেলে তো শেষ হবে না, তাই একটা নির্দিষ্ট পরিসরে আমাদের আলোচনাকে বেঁধে ফেলার জন্য কতগুলি পয়েন্ট করে নিয়েছি। তোমাদের এতে সুবিধেই হবে।

প্রতিটি মঙ্গলকাব্যের আলোচনায় মূলত তিনটি অংশ থাকবে –
• কাব্যের কাহিনি
• কাব্য ও কবির বিবরণ
• কবির রচনাশৈলী বা কৃতিত্ব

এই কাঠামো অনুসরণ করে আমরা আজ মনসামঙ্গল কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করবো। তবে বলে রাখি এই মঙ্গলকাব্য নিয়ে আলোচনা শুরু করলে শেষ হওয়ার জো নেই। তাই যতটুকু তোমাদের না জানলেই নয়, ঠিক ততটুকুই আলোচনায় রাখবো। নাহলে কখন দেখবো নাক ডাকিয়ে ঘুম লাগিয়ে দিয়েছ তোমরা। যাক গে আলোচনায় ফিরে আসি।


একাদশ শ্রেণি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনির প্রধান উপজীব্য বিষয় হল মর্ত্যধামে দেবী মনসার পূজা প্রচার। গ্রামে-গঞ্জে গেলে আজও তোমরা দেখতে পাবে মনসা পূজার উপলক্ষে গ্রামের মেয়ে-বউরা এই মঙ্গলকাব্য পাঠ করে থাকেন,কোথাও আবার মনসা যাত্রা, মনসার গীত ইত্যাদি অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে।

মনসামঙ্গলের মূল কাহিনিটি গড়ে উঠেছে মনসার সঙ্গে চাঁদ সদাগরের সংঘাতকে কেন্দ্র করে।

এই কাহিনি অনেক ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে আসছি। চম্পনগরের একজন বিত্তশালী ও গণ্যমান্য বণিক চাঁদ সদাগর, ভালো নাম চন্দ্রধর। পাতালনিবাসী দেবী মনসা চান যাতে চাঁদ সদাগরের মাধ্যমে তাঁর পূজা মর্ত্যে প্রচারিত হয়। চাঁদ সদাগর যেহেতু সমাজের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাই সে পূজা করলে সমাজের অন্যান্যরাও পূজায় আগ্রহী হওয়ে উঠবে। কিন্তু চাঁদ সদাগর নিজে শিবের একজন বড়ো ভক্ত। তাই কিছুতেই তিনি মনসার পূজা করতে চাননি। এজন্য অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে মনসা চাঁদের সুন্দর বাগানবাড়ি ধ্বংস করে দেন, এমনকি বাণিজ্যযাত্রায় তাঁর ছয় পুত্রের প্রাণ কেড়ে নেন। চাঁদ সদাগর তবুও নিজ লক্ষ্যে অটল। মনসার কাছে কিছুতেই তিনি মাথা নত করবেন না। পুত্রশোকে বিহ্বল হওয়ে চাঁদ মহাজ্ঞান লুপ্ত হন।

কিন্তু পুনরায় বাণিজ্যযাত্রার উদ্দেশে রওনা দেন চাঁদ। স্ত্রী তখন সন্তান-সম্ভবা, তাঁর কাছে সশরীরে ফেরার অঙ্গীকার করে চাঁদ বলে যান যেন তিনি প্রসবের পরে পুত্রের নাম রাখেন লখিন্দর।

লখিন্দরের জন্ম হয়। বাণিজ্যযাত্রায় চাঁদের সব নৌকা ডুবে যায় মনসার কোপে। ভিক্ষুকের বেশে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে চাঁদ বাড়ি ফিরে আসেন, ততদিনে লখিন্দরের বয়স বেড়ে গেছে অনেক। তাঁর সঙ্গে বিবাহ হয় উজানী নগরের সায়বেনের কন্যা বেহুলার। মনসা তাঁকেও ছাড়েননি। বিশ্বকর্মা নির্মিত লোহার বিবাহ বাসরেও একটি ছিদ্রপথে কালনাগিনী এসে ঢোকে আর তার কামড়েই লখিন্দর প্রাণ হারান।

পতিব্রতা বেহুলা স্বামীর প্রাণ ফেরানোর উদ্দেশে কলার ভেলায় লখিন্দরের মৃতদেহ নিয়ে স্বর্গের উদ্দেশে রওনা দেন। স্বর্গে গিয়ে দেবতাদের সামনে নৃত্য প্রদর্শন করে তাঁদের সন্তুষ্ট করলে মহাদেব লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে রাজি হন, কিন্তু তিনি একটি শর্ত দেন যে চাঁদ সদাগরকে মনসার পূজা করতেই হবে।

বেহুলা এই শর্ত মেনে নেয় এবং লখিন্দর পুনর্জীবিত হয়ে ওঠেন। চাঁদ সদাগরের অন্য ছয় পুত্র প্রাণ ফিরে পায়, তাঁর ডুবে যাওয়া চোদ্দোটি বাণিজ্যতরী আর সমস্ত লুপ্ত সম্পদ ফিরে পান তিনি। এরপরে বেহুলার প্রতিশ্রুতি অনুসারে স্ত্রী মেনকার অনেক কাকুতি-মিনতির পর বাঁ হাতে পিছন দিকে ঘুরে মনসার ঘটে একটি ফুল ছুঁড়ে দেন চাঁদ সদাগর। এভাবেই মর্ত্যধামে দেবী মনসার পূজা প্রচারিত হয়। এই হল মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান গল্প।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

এই কাহিনিকে কেন্দ্র করেই বহু কবি নানাভাবে মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেছেন। তোমাদের আগে বলেছি যে মঙ্গলকাব্যের প্রতিটি কাহিনিতেই দেবখণ্ড আর নরখণ্ড এই বিভাজনটা রয়েছে। তাহলে মনসামঙ্গল কাব্যের ক্ষেত্রে এই বিভাজনটা কীভাবে বুঝবে? খুব সহজেই বুঝিয়ে দিচ্ছি। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য এক্ষেত্রে আমরা উদাহরণ হিসেবে নিচ্ছি, যদিও পরে আমরা এই কবির কাব্য এবং কবি কৃতিত্ব নিয়েই আলোচনা করবো।

এখন কেতকাদাসের কাব্যে দেব বন্দনা অংশ থেকে শুরু করে মনসার পূজা প্রচারের বাসনা অংশ পর্যন্ত কাহিনিকে দেবখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয় আর তারপরে রাখালদের মধ্যে পূজা প্রচার থেকে একেবারে শেষে চাঁদের মনসা পূজা পর্যন্ত অংশ হল নরখণ্ডের অংশ।

একেবারে সাধারণভাবে এই মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনির রূপরেখাটি এক ঝলকে বুঝে নিতে হলে পাশের ছবিতে রেখাচিত্রটি ভালো করে দেখো। আশা করি এই রেখাচিত্রটি একবার দেখলেই তোমাদের কাহিনি মনে রাখার সমস্যা আর থাকবে না।

মনসামঙ্গলের প্রধান কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিজয়গুপ্ত, নারায়ণ দেব, বিপ্রদাস পিপলাই প্রমুখ। বিজয়গুপ্ত ও নারায়ণ দেবের কাব্যের নাম ‘পদ্মাপুরাণ’। হ্যাঁ বন্ধুরা, মনসামঙ্গল কাব্য অনেক জায়গাতেই ‘পদ্মাপুরাণ’ নামেও পরিচিত।

[এখন তোমাদের পরীক্ষার প্রশ্নে বেশিরভাগ সময়েই মনসামঙ্গল কাব্য ধারার একজন প্রতিনিধিস্থানীয় কবির সম্পর্কে জানতে চায়, এটা শুধু এই মঙ্গলকাব্যের ক্ষেত্রেই নয়, মধ্যযুগের প্রায় বেশিরভাগ অংশ জুড়েই এই একই ধাঁচের প্রশ্ন আসে। ফলে এই ধাঁচটিকে মাথায় রেখে আমরা প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অন্তত একজন করে কবির জীবন ও তাঁর কবি কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো। যদিও তা যথাসম্ভব সংক্ষেপেই মনে রাখার চেষ্টা করবো।]

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ

মনসামঙ্গল কাব্যধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মনে করা হয় কেতকাদাস ক্ষেমানন্দকে। তিনি নিজেকে কেতকা বা মনসার দাস হিসেবে অভিহিত করেছেন।

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দর লেখা কাব্যের নাম ‘মনসামঙ্গল’।

এই কাব্যের গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশ থেকে জানা যায় যে অধুনা হুগলি জেলার অন্তর্গত কাঁথড়া বা কেতেরা গ্রামে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের জন্ম হয়েছিল। পরবর্তীকালে কবির পরিবার এই গ্রাম ত্যাগ করে জগন্নাথপুরে থাকতে শুরু করেন। মনে করা হয় ১৫৬০ শক তথা ১৬৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দের পরে পরেই তিনি এই কাব্যটি রচনা করেন।

গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশে কবি স্পষ্টই বলেছেন যে দেবী মনসার স্বপ্নাদেশেই এই মঙ্গলকাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন তিনি। শুধু পশ্চিমবাংলা নয়, সুদূর চট্টগ্রামেও তাঁর এই কাব্যের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ ছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যে একজন সুপণ্ডিত আর তাঁর এই পাণ্ডিত্যের ছাপ লক্ষ করা যায়, এমনকি সমকালীন সংস্কৃতি, রীতি-নীতি আর ভৌগোলিক পরিবেশেরও ছাপ পাওয়া যায় তাঁর এই কাব্যে।


একাদশ শ্রেণি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

এই সমস্ত রীতি-নীতির মধ্যে প্রধান বিবাহ ও জন্মকেন্দ্রিক সংস্কারগুলি যা কেতকাদাস তাঁর কাব্যে অসাধারণ মমত্বে ফুটিয়ে তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে জেনে রাখো বন্ধুরা, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কাব্যই মনসামঙ্গল কাব্য ধারার প্রথম মুদ্রিত কাব্য।

তাঁর কাব্যে বারা খাঁ, বিষ্ণুদাস ও ভারমল্ল নামে তিনজন ঐতিহাসিক চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়।

তাঁর ভৌগোলিক জ্ঞানের পরিধিও যে বিস্তৃত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় স্বর্গপুরীর উদ্দেশে ভেলায় চড়ে বেহুলার যাত্রার বর্ণনায়। সাঁতালি পর্বত থেকে স্বর্গ পর্যন্ত যাত্রাপথে দামোদর নদীর নিখুঁত বর্ণনা এবং সেখানে ২২টি ঘাটের উল্লেখ থেকেই তা প্রমাণ হয়। এই ঘাটগুলির অনেকগুলি আজও অক্ষত রয়েছে। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কাব্যের ‘বেহুলা’ চরিত্র আত্মমর্যাদায় দৃপ্ত এক চরিত্র। এমনকি বেহুলা এই কাব্যে আদর্শপরায়ণ এবং দুঃখ-সহিষ্ণু এক নারী। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কেতকাদাস তাঁর কাব্যে ‘চৈতন্য বন্দনা’ অংশে শ্রীচৈতন্যদেবের স্তুতি করেছেন।

ফলে স্পষ্টত বোঝাই যায় যে কেতকাদাস চৈতন্য-পরবর্তী সময়ের কবি। তাঁর কাব্যে চাঁদ সদাগরের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে মূলত তিনি শৈব ও শাক্তদের বিরোধ এবং অবশেষে মিলনকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।

[মোটামুটিভাবে এই কথাগুলি মাথায় রেখে গুছিয়ে তোমরা যদি উত্তর লিখতে পারো, নিশ্চিতভাবেই অনেকের থেকে এগিয়ে থাকবে বন্ধুরা নম্বরের ক্ষেত্রে। সব সময়ের মতো আজও শেষে একটাই কথা বলবো, একটু ভালোবেসে সাহিত্যের ইতিহাসকে গল্পের মতো করে একবার যদি মাথায় নিতে পারো, দেখবে এ নিয়ে আর কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তাহলে আজ এটুকু থাক, আবার পরের ক্লাসে দেখা হবে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য নিয়ে।]
পর্ব সমাপ্ত।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_8