dhormomongol-shibayon-kabyo
Class-11

ধর্মমঙ্গল আর শিবায়ন কাব্য । মধ্যযুগে বাংলার সমাজ সাহিত্য

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)


এর আগে অন্নদামঙ্গল কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা ধর্মমঙ্গল আর শিবায়ন কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করবো।

এবারে আমরা গৌণ বা অপ্রধান মঙ্গলকাব্যের মধ্যে আরও দুটি মঙ্গলকাব্য নিয়ে আলোচনা করবো। ধর্মমঙ্গল আর শিবায়ন কাব্য। প্রথমটি তবু নাম দেখে বুঝতে পারছো আশা করি যে এটা মঙ্গলকাব্যেরই একটা রূপভেদ। কিন্তু দ্বিতীয়টির বেলায় নাম দেখে বোঝার উপায় নেই। নামের মধ্যে ‘মঙ্গল’ শব্দটাই যে নেই। কিন্তু তবু একে মঙ্গলকাব্য ধারার অন্তর্গত হিসেবেই ধরা হয়। সে নিয়ে পরে তো আমরা আলোচনা করবোই। এখন প্রথমে জেনে নিই ধর্মমঙ্গলের ব্যাপারে।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

আগের সবকটি মঙ্গলকাব্যেরই একজন করে দেবী ছিলেন, একমাত্র ধর্মমঙ্গলে দেখা যায় এখানে এখন দেবতা রয়েছেন – ধর্মঠাকুর।

লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচারের উদ্দেশ্যেই এই মঙ্গলকাব্য রচিত। ধর্মমঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হলেন ঘনরাম চক্রবর্তী।

তাঁর লেখা ধর্মমঙ্গল কাব্যটিই সর্বাধিক প্রচারিত ও জনপ্রিয়। বর্ধমান জেলার দামোদর নদের তীরে কৃষ্ণপুর কুকুড়া গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম গৌরীকান্ত এবং মায়ের নাম সীতাদেবী। গুরু শ্রীরামদাসের আদেশেই ঘনরাম ধর্মমঙ্গল কাব্য লিখতে শুরু করেন।

বর্ধমানের রাজা তাঁর এই কাব্য রচনায় অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘কবিরত্ন’ উপাধি দেন।

মোটামুটিভাবে আন্দাজ করা যায় যে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই ঘনরাম চক্রবর্তী এই কাব্যটি রচনা করেন। চণ্ডীমঙ্গলে যেমন মুকুন্দরাম কাব্যের মধ্যে কখনো অম্বিকামঙ্গল, কখনো নূতন মঙ্গল ইত্যাদি নামে কাব্যটিকে চিহ্নিত করেছেন, তেমনি এক্ষেত্রেও ঘনরাম চক্রবর্তীর লেখা কাব্যের মধ্যে ‘শ্রীধর্ম্মমঙ্গল’, ‘অনাদিমঙ্গল’, ‘মধুর ভারতী’ ইত্যাদি নানাবিধ নাম পাওয়া যায়।

তবে আসলে ঘনরাম চক্রবর্তী তাঁর কাব্যের নাম রেখেছিলেন ‘শ্রীধর্ম্মমঙ্গল’।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে কাব্যটি মঙ্গলকাব্য হলেও এই কাব্যের মধ্যে ঘনরাম কোথাও কোনো স্বপ্নাদেশের কথা বলেননি। ঘনরামের কাব্য মহাকাব্যের মতো আভিজাত্যপূর্ণ। তাঁর কাব্যে একইসঙ্গে যেমন রামায়ণ, মহাভারত কিংবা ভাগবতের ছায়া দেখা যায়, তেমনিই পাণ্ডিত্য আর কবিত্বের এক মিশেল লক্ষ্য করা যায়। চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে তাঁর মুন্সিয়ানা প্রশংসনীয়। তাঁর কাব্যের ‘লাউসেন’ এক বীর ও বলিষ্ঠ পুরুষ।

অন্যদিকে রঞ্জাবতী, লখ্যা, কলিঙ্গা, কানাড়া প্রমুখ নারী চরিত্রগুলির মধ্যে কেউ স্নেহময়ী জননী, কেউ বীরাঙ্গনা, কেউ আবার লাবণ্যময়ী প্রেমিকা।

এ প্রসঙ্গে ধর্মমঙ্গলের কাহিনিটি একটু জেনে রাখো বন্ধুরা। একেবারে গল্পের মতো করেই এটা কেবল পড়ে যাও। গৌড়ের রাজার অধীনে কর্ণসেন নামে এক সামন্তরাজা ছিলেন।গৌড়ের রাজা নিজের শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে বিপত্নীক কর্ণসেনের বিবাহ দেন। কিন্তু রঞ্জাবতীর দাদা মহামদ এই বিবাহ মন থেকে মানতে পারেননি। ধর্মঠাকুরের কৃপাবলে রঞ্জাবতীর এক পুত্রসন্তান জন্মায় এবং তাঁর নাম রাখা হয় লাউসেন।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

মহামদ বারবার চাইতেন এই লাউসেনের যাতে কোনো ক্ষতি হয়, তাই তিনি বারবার কঠিন সব যুদ্ধে পাঠাতেন লাউসেনকে। কিন্তু ধর্মঠাকুরের বরপুত্র হওয়ায় সব যুদ্ধ থেকেই তিনি অক্ষত ও বিজয়ী হয়ে ফিরে আসেন। কামরূপ জয় করে কামরূপের রাজকন্যা কলিঙ্গাকে এবং সিমুলার রাজকন্যা কানাড়াকে বিবাহ করেন লাউসেন। এবার মহামদের চক্রান্তে ইছাই ঘোষের সঙ্গে যুদ্ধে ইছাই ঘোষকে হত্যা করেন লাউসেন। এরপর মহামদ তাঁকে বলেন যে পশ্চিমদিকে সূর্য উঠিয়ে লাউসেনকে প্রমাণ দিতে হবে যে তিনি ধর্মঠাকুরের ভক্ত কিনা। হাকন্দ নামে একটি স্থানে তপস্যার বলে তিনি এই অসাধ্য সাধন করেন।

ঠিক এই সময়েই মহামদ ময়নাগড় আক্রমণ করে কালু ডোম এবং লাউসেনের প্রথমা স্ত্রী কলিঙ্গাকে মেরে ফেলেন। পরে তিনি ময়নাগড়ে ফিরে এসে ধর্মঠাকুরের স্তব করেন এবং তার ফলে আবার সকলে বেঁচে ওঠে। মহাপাপ করার জন্য মহামদ আক্রান্ত হন কুষ্ঠরোগে। পরে লাউসেনের প্রার্থনায় কুষ্ঠমুক্ত হন তিনি। এভাবে মর্ত্যে ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচারিত হয়। পুত্র চিত্রসেনকে রাজ্যভার দিয়ে স্বর্গারোহণ করেন লাউসেন। এই হল ধর্মমঙ্গলের গল্প।

শিবায়ন কাব্যে

এসো বন্ধুরা এবারে আমরা চট করে শিবায়ন কাব্যের ব্যাপারে জেনে নিই। তাহলেই আজকের ক্লাস আমাদের ছুটি। আগে যে বলছিলাম, শিবায়ন কাব্যটিকে কেন মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভুক্ত ধরা হল, সেই আলোচনাই করবো এখন। শিব আর্য দেবতা হলেও অস্ট্রিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে কৃষিকাজের প্রতীক রূপেই পূজিত হন তিনি। বহু বহু কাল ধরেই এই রীতি চলে আসছে। সেই শিবকে নিয়েই রচিত হয় মধ্যযুগে শিবমঙ্গল তথা শিবায়ন। শিবের মাহাত্ম্য প্রচারই এই মঙ্গলকাব্যের উদ্দেশ্য।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

কিন্তু মঙ্গলকাব্যের গঠনকাঠামো এখানে মানা হয়নি। এই কাব্যের নামের মধ্যেও কবিরা মঙ্গল শব্দটি ব্যবহার করেননি। কিংবা কোনো শাপভ্রষ্ট দেব-দেবীর কাহিনির প্রসঙ্গ এই কাব্যে আসেনি। কাব্যের প্রথমাংশে দেখা যাবে শিবের কিছু পৌরাণিক কাহিনি আর দ্বিতীয়ার্ধে দেখা যাবে একেবারে লৌকিক শিবকে। ষাঁড়ের পিঠে চেপে দোরে দোরে ভিক্ষা করে বেড়ানো, তারপর পার্বতীর পরামর্শে কৃষিকাজে মন দেওয়া, অবৈধ প্রেম, পরকীয়া, দাম্পত্য-কলহ ইত্যাদি সবই এই কাব্যের মধ্যে উঠে এসেছে একেবারে সাধারণ মানুষের জীবনের অনুরূপে। শিব এখানে দেবতার মাহাত্ম্যে উন্নীত নন কোনোভাবেই।

গ্রামবাংলার কৃষিনির্ভর জীবনের রোজনামচাই শিবের জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে ‘শিবায়ন’ কাব্যে। সপ্তদশ শতাব্দীতে রামকৃষ্ণ রায় এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে রামেশ্বর ভট্টচার্য শিবায়ন কাব্যের দুইজন উল্লেখযোগ্য কবি। রামকৃষ্ণ রায়ের কাব্যে যেমন পুরাণ এবং লোকজীবনের এক আদর্শ সমন্বয় দেখা যায়, অন্যদিকে রামেশ্বর ভট্টাচার্য তাঁর কাব্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর উচ্ছৃঙ্খলতা ও রুচিহীনতাকেই তুলে ধরেছেন। এভাবেই শিবায়ন এক গৌণ মঙ্গলকাব্যের অভিধায় ভূষিত হয়েছে। ব্যস আজ আর নয়। বাকি কথা পরে হবে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বৈষ্ণব পদাবলী


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_11