dwipantworer-bondini-bishode-alocona
Class-11

দ্বীপান্তরের বন্দিনী । বিশদে আলোচনা

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – দ্বীপান্তরের বন্দিনী (বিশদে আলোচনা)

এর আগে দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতার সারসংক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতাটি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করবো।

দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতার প্রেক্ষাপট

১৯৪৫ সাল নাগাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আন্দামানের সেলুলার জেলের সকল বন্দিদের মুক্ত করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু স্বয়ং। কাজী নজরুলের কবিতাতেও ‘দ্বীপান্তর’ বলতে আন্দামান ও সেলুলার জেলকেই বোঝানো হয়েছে। আন্দামানকে ‘বন্দিনী’ বলার মধ্যে দিয়ে দেশ-মায়ের সঙ্গে এর সরাসরি তুলনা করেন তিনি।

কবি লিখেছেন ‘বাণী যেথা ঘানি টানে নিশিদিন, বন্দী সত্য ভানিছে ধান’ – এই রকম অত্যাচারের পরিবেশেই সমস্ত প্রতিবাদী বিদ্রোহী বিপ্লবীদের ধরে ব্রিটিশরা বন্দি করছিল আন্দামানে।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির প্রান্তরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। বাংলার নবাবের পরাজয়ের মধ্য দিয়েই বাংলা তথা সমগ্র ভারতে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজালে পড়ার আগে ভারত ছিল স্বাধীন, মুক্ত। কিন্তু সেই স্বাধীনতা হরণ করে নিয়েছিল ব্রিটিশরা। স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য বহু বিপ্লবী বন্দি হয়েছেন, দেশান্তরী হয়েছেন। দেশপ্রেমের জয়গান গেয়ে বহু বিপ্লবী স্বাধীনতার লক্ষ্যে আত্মাহুতি দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর অকথ্য অত্যাচার, প্রতিবাদ আর বিদ্রোহের কণ্ঠরোধ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা নির্মম অত্যাচার করছিল ভারতবাসীর উপর।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

মোটামুটিভাবে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা হয়, এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ব্রিটিশদের মনে তা তীব্র আঘাত হানতে পেরেছিল। যে সময়ে এই কবিতা লিখছেন নজরুল তার আগে গান্ধীজির নেতৃত্বে তিনটি বৃহৎ আন্দোলন ঘটে গেছে। ১৯২০ সালে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, ১৯৩১ সালে আইন অমান্য আন্দোলন এবং ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ইত্যাদি ভারতের অন্যতম প্রধান সংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল।

আপাতভাবে তিনটি আন্দোলনই ব্যর্থ হয়, কিন্তু সর্বশেষ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরেই ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে ভারতবর্ষে বলপূর্বক শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা আর সম্ভব হবে না। এমন এক আইনের শাসনে দেশ বাঁধা ছিল সেই সময়ে যেখানে সত্য কথা বললে বন্দি হতে হয়। দেশের শাসকের অত্যাচারের প্রতিবাদ করলে ‘বিদ্রোহী’ আখ্যা পেতে হয়। নিষ্পেষণ আর অত্যাচার কায়েম রাখাই ব্রিটিশ শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।

দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতার বিশদে আলোচনা

এই কবিতার ছত্রে ছত্রে ধ্বনিত হয়েছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। বারবার কবি যেন পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন রাখেন যার মাধ্যমে তৎকালীন সময়ের দোলাচলতার মধ্যে কবির মনের যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তা ফুটে ওঠে। কবিতার শুরুতেই কবি প্রশ্ন রাখেন যে ‘ভারত-ভারতী’ দেশে ফিরে এসেছেন কিনা। প্রশ্ন হল কে এই ‘ভারত ভারতী’? ভারতবর্ষের যিনি ধারক, ভারতের যিনি ত্রাতা- তাকেই কবি ‘ভারতী’ বলে সম্বোধন করেছেন কবি।

এক অর্থে সেই ‘ভারতী’ হলেন দেশমাতা।

তিনি আর দেশে নেই, তিনি দ্বীপান্তরিত। কবি মনে করেন ভারতের স্বাধীনতাকামী বন্দি বিপ্লবীরা দেশ-মায়ের প্রতিভূ। ব্রিটিশের শাসন শৃঙ্খলে বন্দি দেশমাতা। বন্দি সকল বিপ্লবীকে সেই সময় পাঠিয়ে দেওয়া হতো আন্দামানের সেলুলার জেলে। ‘আন্দামান’কেই কবি এখানে ‘দ্বীপান্তর’ বলে চিহ্নিত করেছেন। কবি লিখেছেন –

‘পুণ্য বেদীর শূন্যে ধ্বনিল ক্রন্দন – দেড়শত বছর!’

ব্রিটিশ শাসনের সূচনা লগ্ন থেকেই ভারতমাতা যেন পরাধীন হলেন, দ্বীপান্তরের বন্দি বিপ্লবীদের মতো তিনিও যেন দেড়শো বছর ধরে বন্দি আছেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে। ঠিক এর পরিপ্রেক্ষিতেই কবি সেই দ্বীপান্তরের বর্ণনা দিয়েছেন-

‘সপ্তসিন্ধু তেরো নদী পার দ্বীপান্তরের আন্দামান
রূপের কমল রূপার কাঠির কঠিন স্পর্শে যেখানে ম্লান’

সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে তবে পৌঁছানো যায় সেই দ্বীপান্তরের আন্দামান জেলে। এই সাত সমুদ্র তেরো নদী আসলে একটি রূপক যা অলঙ্ঘ্য দূরত্বকে বোঝায়। ভারতের মানচিত্রের শেষ বিন্দুর কাছাকাছি মূল ভূখণ্ড থেকে বহু দূরে মহাসাগরের মধ্যে এক অজানা দ্বীপের প্রতিকূল পরিবেশে গড়ে ওঠা কারাগারে বন্দি করে রাখা হতো বিপ্লবীদের। বন্দিদের পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পরে এই কারাগারটি স্থাপিত হয়।

আন্দামানের ভাইপার দ্বীপে প্রথম এই জেলটি স্থাপিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে সেলুলার অঞ্চলে এই জেল গড়ে ওঠে। ভারতের চরম দণ্ডনীয় অপরাধীদের দ্বীপান্তরে পাঠানো হতো এখানে। প্রথমদিকে ২৩ বছর তাদের জেলে বন্দি করে রেখে ছেড়ে দেওয়া হতো। কিন্তু তারা আর দেশে ফিরতে পারতো না। দেশে পালিয়ে আসারও কোনো সুযোগ ছিল না। এভাবে আন্দামানের দ্বীপে বহু কয়েদিদের বাসস্থান গড়ে উঠেছে যা পড়ে এক বিরাট জনবসতির রূপ নেয়। তখন এই ব্যবস্থাকে বলা হতো ‘পেনাল্টি সেটেলমেন্ট’।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

মোটামুটিভাবে বঙ্গভঙ্গের পর থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের বিপ্লবী সন্তানদেরই রাজবন্দী হিসেবে এই কারাগারে বন্দি করে আনা হতো। মূলত ‘যুগান্তর দল’, ‘অনুশীলন সমিতি’র সদস্যরা এই বিপ্লবীর পরিচয়ে আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হতেন। তাছাড়া ছিল ভগৎ সিং পরিচালিত ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি’ নামে আরেকটি বিপ্লবী সংগঠন। ইতিহাস থেকে জানা যায় আলিপুর বোমা মামলা, ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা, রাজাবাজার বোমা মামলা ইত্যাদি ঘটনার বিচারে অভিযুক্ত বিপ্লবীদেরকে নির্বাসিত করা হয়েছিল আন্দামানে। উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো, বীরেন্দ্র সেন, অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, শিশির ঘোষ, পুলিনবিহারী দাস মুখরা এই সময়েই আন্দামানে বন্দি হন আর সেই আন্দামান জেলের অত্যাচারের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে গা শিউরে ওঠে।

এই প্রসঙ্গে আন্দামানের সেলুলার জেলের অত্যাচার কাহিনীঃ
বিখ্যাত বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’য় দেখা যায় প্রত্যহ কয়েদিদের নারকেলের ছোবড়া পিটিয়ে তার থেকে দুইবার দড়ি বের করতে হতো এবং সেই দড়ি পাকাতে হতো এবং ঘানিতে সরষের তেল বের করার মতো অমানুষিক পরিশ্রমের কাজও করতে হতো। প্রতিদিনের কাজে ঘাটতি দেখা দিলে ভয়ঙ্কর শাস্তি জুটতো। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তকে এই জেলেই এমন অত্যাচার করা হয় যে তিনি সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যান। এছাড়াও জেলের বাইরের প্রাঙ্গণে রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে মাটি কাটা, কাঠ কাটা, রিকশা টানার কাজ করানো হতো কয়েদিদের দিয়ে। সেই অনুপাতে খাবার দেওয়া হতো যৎসামান্য। কখনো কখনো পেনাল ডায়েটের নামে দু’বেলা আধ পাউণ্ড করে চালগুঁড়ো সেদ্ধ পর্যন্ত খাওয়ানো হতো কয়েদিদের। সেলের মধ্যেই মলমূত্র ত্যাগ করার স্থান ছিল। জল দেওয়া হতো খুবই সীমিত, ফলে এত অমানুষিক পরিবেশে বিপ্লবীদের পক্ষে মানসিক স্থিতি ঠিক রেখে বেঁচে থাকা দুষ্কর ছিল। তাই জেলের মধ্যেই বহু বিপ্লবী আত্মহত্যা করতেন।

শুধু তাই নয় আন্দামান ছাড়াও দেশের মধ্যেই আরো বহু কুখ্যাত কারাগার তৈরি হয়েছিল। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল, হিজলি জেল, কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ইত্যাদি সব কারাগার বিপ্লবী বন্দিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবীদের বন্দি করার বাসনায় ব্রিটিশরা পুরো ভারতকেই গড়ে তুলেছিল একটা বন্দিশালা। নজরুল তাই বলছেন দ্বীপান্তরের আন্দামানে রূপ-সৌন্দর্যের, সুন্দরের, স্বাধীনতার প্রতীক যে পদ্ম তা যেন রূপকথার সেই রূপার কাঠির স্পর্শে সুপ্ত ঘুমন্ত হয়ে আছে। সুন্দরের অস্তিত্ব নেই সেইসব কারাগারে।

রূপকথার রাজকন্যা যেমন রূপার কাঠির স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়তেন, ঠিক সেভাবেই ব্রিটিশের পরাধীনতার শৃঙ্খলে ভারতমাতার সব সৌন্দর্য, সব স্বাধীনতা যেন সুপ্ত হয়ে আছে। নজরুলের কবিচেতনায় ‘আন্দামান’ হয়ে উঠেছে সেই শোষণ-অত্যাচারের প্রতীক। আন্দামান ছিল রাজদ্রোহী বিপ্লবীদের নির্বাসন ক্ষেত্র। ব্রিটিশ শাসনের রূপার কাঠির স্পর্শে ভারতের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বিবশ হয়ে পড়ে।

কবি লেখেন –
‘শতদল যেথা শতধা ভিন্ন শস্ত্র-পাণির অস্ত্র ঘায়’

পদ্ম রূপ স্বাধীনতার পাপড়ি শতচ্ছিন্ন হয়ে যায় ইংরেজদের অস্ত্রের আঘাতে। ‘শস্ত্রপাণি’ বলতে এই কবিতায় বলা হয়েছে ব্রিটিশের পুলিশ প্রশাসনকে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের এক নগ্ন চরিত্র ফুটে উঠেছে এখানে। কবি প্রত্যাশা করেন বন্দিনী বাণী মুক্ত হোক, এই বাণী আসলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার পক্ষে বিদ্রোহী দেশবাসীর সমবেত কণ্ঠস্বর।

আন্দামানের কারাগারের সামনে সর্বদা অতন্দ্র প্রহরী রয়েছে। কবির ভাষায় ‘যন্ত্রী’ অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের মোতায়েন করা সান্ত্রী সেখানে বীণার তন্ত্রী কাটে। ব্রিটিশরাজের অত্যাচারকে বিদ্রুপ করে বীণা বাজানোর সঙ্গে তুলনা করেছেন কবি এখানে। কবি প্রশ্ন রাখেন –

‘মুক্ত কি আজ বন্দিনী বাণী? / ধ্বংস হল কি রক্ষপুর?’

ব্রিটিশদের রাক্ষসপুরী ধ্বংস হল কিনা তার জন্য কবি উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থায় জাতীয় কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদন নীতির প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন কবি এবং সক্রিয় সশস্ত্র আন্দোলনে বিশ্বাস রাখতো যে সকল চরমপন্থীরা তাদের হয়েই কবি নজরুল যেন তার আরেক গানে লিখেছিলেন –

‘কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙে ফেল কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী’

কবি চান এক মুক্ত স্বাধীন ভারতভূমি সমাজে শান্তি এবং শুচিতা, সভ্যতা ফিরিয়ে আনতে কেবলমাত্র সশস্ত্র আন্দোলনই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপূরণ করতে পারে বলেই কবির বিশ্বাস। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর কবি জানেন যে, স্বাধীনতা অর্জন সহজসাধ্য নয়। বহু আত্মবলিদানের মধ্য দিয়েই সেই স্বাধীনতার পথ তৈরি হয়। রামায়ণের কাহিনিতে যেমন লঙ্কার রাজা রাবণ সীতাকে বন্দি করে রেখেছিলেন সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কার অশোকবনে, ব্রিটিশ সরকারও যেন তেমনভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমুদ্রপাড়ের আন্দামান জেলে বন্দি করে রেখেছে।

তাই নজরুল ব্রিটিশ শাসনকে ‘রক্ষপুর’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।

কবি প্রশ্ন রাখেন যক্ষপুরী আন্দামানে কি রূপের পদ্ম, মুক্তির পদ্ম ফুটে উঠেছে? কামান গোলার সীসার স্তূপে শান্তির বাণী স্থাপিত হয়েছে কি? রক্তস্নাত বিপ্লব, সংগ্রামের শেষে ভারতে কি শান্তি এসেছে? যদি না এসে থাকে, তবে মন্দিরে মন্দিরে এত সমারোহে আরতির প্রয়োজন নেই বলেই কবি মনে করেন। এই কবিতায় নজরুলের ‘বাণীর শিশ্‌মহল’ এই বাক্যবন্ধের প্রয়োগে বোঝা যায় যে তিনি বিশ্বাস করেন সুসজ্জিত ইংরেজ সৈন্যের কামান গোলার আঘাতে ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নের প্রাসাদ ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।

ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছিল কবির মনে। ‘শিশ্‌মহল’ কথার আক্ষরিক অর্থ ‘কাচের বাড়ি’। কাচের বাড়ি যেমন ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর ঠিক তেমনি কবি মনে করেন বিপক্ষ ইংরেজদের পরাস্ত করতে কংগ্রেস নেতাদের নরমপন্থী মনোভাব এবং মিষ্টভাষণও অত্যন্ত ভঙ্গুর, ঠুনকো। এর মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা লাভ কখনোই সম্ভব নয়।

১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স জারি করে ইংরেজ সরকার স্বরাজ্য দলের কর্মীদের ধরপাকড় শুরু করে। কলকাতার মেয়র সুভাষচন্দ্র বসু জেলখানায় বন্দি হন। কারাগারে আর তিলমাত্র স্থান নেই। মূলত স্বরাজ্য দলের কার্যকলাপ দমন করতেই এই অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছিল |আর এই সময়ই ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় ‘বিজলী’ পত্রিকায় নজরুল লিখেছিলেন এই ‘দ্বীপান্তরের বন্দিনী’ কবিতাটি। কারাগারে বন্দি বিপ্লবীদের করুণ অবস্থাকে উদ্দেশ্য করে নজরুল তাই এই কবিতায় লেখেন –

‘বাণী যেথা ঘানি টানে নিশিদিন / বন্দি সত্য ভানিছে ধান’

আন্দামানের কারাগারে বন্দি বিপ্লবীদের প্রবল অত্যাচার সহ্য করে ঘানিতে সরষের তেল নিষ্কাশন করতে হতো। অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এই কাজ করতে করতে ভারতের বিপ্লবীদের সমস্ত জীবনী শক্তি নিঃশেষ হয়ে যেতো, হারিয়ে যেতো সংগ্রামের শক্তি। বিপ্লবের জন্য বলিদানের তেজ। জীবনীশক্তিকে নষ্ট করে দেওয়া এই ঘানিকে কবিতায় তিনি ‘জীবন-চুয়ানো’ ঘানি বলেছেন।

কিন্তু কবি জানেন, দিনের পর দিন এই অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করলেও বন্দি বিপ্লবীদের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ কখনোই বিফল হবে না। তাদের তিতিক্ষা আর আত্মদানকে দৃষ্টান্ত করে অন্য আরও ভারতবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিন, কণ্টকাকীর্ণ পথকেই তাদের জীবনের পাথেয় করে তুলবে। বন্দি বিপ্লবীদের এই আত্মত্যাগকে রূপক অর্থে নজরুল লেখেন –

‘জীবন-চুয়ানো সেই ঘানি হ’তে / আরতির তেল এনেছ কি?’

কবির বিশ্বাস এই আরতির তেলই একদিন স্বাধীনতার আলোক শিখা জ্বালিয়ে তুলবে। স্বাধীনতার যজ্ঞে ভারতমাতার সকল বীর সন্তানদের রক্ত-ঘাম অশ্রু যেন চর্বি-ঘিয়ের মতো হোমাগ্নিকে জ্বালিয়ে রেখেছে। তাদের জীবনই যেন এই যজ্ঞের নৈবেদ্য। কিন্তু এই স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ছাড়াও দেশের আরো অন্যান্য নরমপন্থী নেতাদের কটাক্ষ করে নজরুল তাদের ‘শৌখিন পূজারী’ বলে সম্বোধন করেন।

কবি জানেন দেশের স্বাধীনতার যজ্ঞই দেশ-মায়ের পূজা আর দেশমাতা আজ বীর সন্তানদের আত্মবলিদান চায়। সক্রিয় সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ না হয়ে যে সকল নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ বিরোধিতার ভাণ করেছিলেন, তাদের বিদ্রুপবাণে বিদ্ধ করেন নজরুল। সমাজের একাংশের মানুষ কেবল নাম-যশ অর্জনের আশায় রাজনীতিতে এসেছিলেন, দেশের মানুষের সামনে তারা ভ্রান্ত আত্মবলিদানের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তারা স্বার্থান্বেষী, সুযোগসন্ধানী আর তাদের এই ভ্রান্ত পূজা কেবলই ছিল দেখনদারি মাত্র। স্বাধীনতা আন্দোলনের নামে যারা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আন্দোলনের ময়দানে নেমেছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে কবি বলেন –

‘হায় শৌখিন পূজারী, বৃথাই / দেবীর শঙ্খে দিতেছ ফুঁ,
পুণ্যবেদীর শূন্য ভেদিয়া / ক্রন্দন উঠিতেছে শুধু!’

এই ‘শৌখিন পূজারী’ একদিকে যেমন ভণ্ড স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতীক, আবার দেশের অগণিত ধর্মভীরু মানুষেরও প্রতীক। পরাধীন দেশের দুর্দিনে প্রধান পূজাই হল দেশ-মায়ের পূজা। সেই পূজার নাম প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, সশস্ত্র বিপ্লব। সেখানে দিবারাত্র মন্দিরে মসজিদে কল্পিত ঈশ্বরের আরাধনা বৃথা। পৃথিবীতে কখনোই কোনো ঈশ্বর বা কোনো আল্লাহ সমাজ বদল করতে পারেনি। সমাজ বদলাতে হলে চাই মানুষ আর ভারতমাতার বন্দিদশায় ধর্মভীরু পুরোহিত সম্প্রদায় সেই কল্পিত ঈশ্বরের পূজাতেই নিয়োজিত। সে পূজা অর্থহীন, কারণ ভারতের একমাত্র ঈশ্বর ভারতের পরমপূজ্য আসলে তার বীর বিপ্লবীরাই।

তারাই কবির ভাষায় ‘ভারত-ভারতী’।

ভূ-ভারতের এক কদর্য ছবি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ‘দ্বীপান্তরের বন্দিনী’ কবিতাতেও। কবি লক্ষ করেছেন স্বাধীনতার কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করতে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের নারকীয় অত্যাচার। আইন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দেশে ন্যায় বজায় রাখার জন্য, কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে আইনের দ্বারা ন্যায়ভাষণ, সত্যভাষণের পথ রোধ করা হয়। সত্য বললে নিদারুণ শাস্তি পেতে হয়।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

অত্যাচারিত মানুষ তার অত্যাচারের প্রতিবাদ করতেই পারে না শাসকের বজ্র-আঁটুনিতে। ফলে অন্যায়ের বিচার করে না যে আইন, তা কেবলই রঙ্গ-তামাশামাত্র, এক জীবন্ত প্রহসন। শোষণ আর অত্যাচার জারি রাখার কাজেই আইনকে ব্যবহার করা হয়। নীতিহীন অত্যাচারী শাসনব্যবস্থার প্রসঙ্গেই কবি লেখেন –

‘আইন যেখানে ন্যায়ের শাসক, / সত্য বলিলে বন্দী হই’

সত্যবাদীকে সত্য বলার অপরাধে বন্দি করে রাখা হতো যাতে আর কেউ সত্য কথা বলে অন্যকে উদ্দীপিত করতে না পারে। এইরকম দমবন্ধ করা পরিবেশে যে বা যারা স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা বলে, তাদেরই ‘বিদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া হয়। কবি তাই মনে করেন যারা দেশমাতৃকার বন্দনা করতে চান, তাদের সকলকেই সেই বন্দিত্বের কাহিনি থেকে প্রেরণা নিতে হবে। এই প্রসঙ্গে কবি অসাধারণ একটি উপমা সংযোজন করেছেন কবিতার মধ্যে-

‘সিংহেরে ভয়ে রাখে পিঞ্জরে, / ব্যাঘ্রেরে হানে অগ্নিশেল’

ভারতের বীর বিপ্লবীরা যে একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিভুমি টলিয়ে দিতে পারে তা জানতো ইংরেজরা। তাই সেই বিপ্লবীদের শক্তি ক্ষয় করতে তাদের বন্দি করা শুরু হয়। সিংহ খাঁচার ভিতরে থাকলে তার যতই শক্তি থাক, সে কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আবার বাঘও যতই শক্তিশালী হোক না কেন আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে সেও দূর্বল।

এখানে কবি বীর বিপ্লবীদের পরাক্রমকে যথাক্রমে ‘সিংহ’ ও ‘বাঘ’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।

বাঘকে ‘অগ্নিশেল’ হানার রূপকে বিপ্লবীদের ফাঁসি দেওয়ার কথাই বলতে চেয়েছেন কবি আর অন্যদিকে সিংহসম বিপ্লবীদের পিঞ্জর অর্থাৎ খাঁচায় তথা কারাগারে বন্দি করাকেই ইঙ্গিত করেছেন কবি নজরুল।

যুগান্তরের ধর্মরাজ পদ্মে পা রেখেছেন আর এর মধ্য দিয়েই যুগান্তর ঘটবে অর্থাৎ নতুন দিকের সূচনা হবে। পরাধীনতার গ্লানি মুছে গিয়ে নতুন দিনে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হবে। কবি তাই এক যুগসন্ধির কথা বলেছেন এই কবিতায়।

সমাপ্ত। সুয়েজখালে হাঙর শিকার বিশদে আলোচনা

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XI-Beng-Dipantworer-Bandini-2